কথাসাহিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি, জীবনেরই গল্প। মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি আর বিশ্ব পরিমণ্ডল সবই ফুটে ওঠে কথাসাহিত্যে। এমনই একটি উপন্যাস সোনালি ডুমুর।
উপন্যাসের কাহিনি সংক্ষেপ এ রকম : নায়িকা মাধুরীলতাকে তাড়া করে ফেরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা। কারণ শৈশবে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় নিহত হয় তার স্বজন। সেই স্বজনদের রক্তে ডুবে থেকেই বড় হতে হয় তাকে।
সে বেঁচে থাকে হৃদয়ে ভয়াবহ স্মৃতি আর বেদনাময় রক্তক্ষরণ নিয়ে। বেঁচে থাকার জন্য মাধুরীলতার প্রত্যাশা অনেক। সে পরাজিত মানুষ হতে চায় না। যে কারণে সে ভালোবাসার মানুষ অনিমেষকে খুঁজে নেয়। শ্মশানে নিজের দিদিমার সৎকারের সময় দাদুকে বলে, মুখাগ্নি করবে অনিমেষ। এ ঘটনার মধ্যে দিয়েই সমাজ দুজনের সম্পর্কে জানতে পারে।
তাদের প্রেমের সম্পর্ক বিয়েতে স্থিত হলেও হঠাৎ করেই তারা মুখোমুখি হয় আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।অনিমেষ ও মাধুরীলতা বিয়ের পর চাঁদপুর থেকে ঢাকা আসে। মাধুরীলতার ইচ্ছে ঢাকায় ওদের হানিমুন হবে। ওরা ঢাকায় এসে দেখতে পায় ডা. মন্মথনাথ নন্দীর বাড়ি দখল হয়ে গেছে শত্রু-সম্পত্তি আইনে। লুট হয়ে যায় বাড়ি। আর সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিরন্ন মানুষেরা চিৎকার করে বলে, ডাক্তার বাবু আপনি ফিরে আসুন।
সোনালি ডুমুর উপন্যাসটি যে পটভূমিতে লেখা, লেখক সেলিনা হোসেন উপন্যাসের শুরুতে কিছুটা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন : ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশ উপনিবেশের শৃঙ্খল মুক্তি ঘটে। জন্ম হয় দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই সময়ে পরিস্থিতি খুব সুস্থ এবং স্বাভাবিক ছিল না। মনুষ্যত্বের অবমাননার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। দাঙ্গায় জীবন দিতে হয়েছিল মানুষকে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কয়েক বছর পর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে প্রণীত হয়েছিল শত্রুসম্পত্তি আইন। এই পটভূমিতে লেখা হয়েছে সোনালি ডুমুর উপন্যাসটি।
উপন্যাসের সংলাপগুলো ছোট ছোট বাক্যে বিন্যাস করা হয়েছে। পাঠকের পড়তে কোনো একঘেয়েমি লাগবে না। যেমন-অনিমেষ মৃদু কণ্ঠে বলে, কেঁদো না মাধুরী। মাধুরীর ফোঁপানেরা শব্দ বাড়ে।
কেঁদো না মাধুরী।
মাধুরী দু হাতে জল মুছে নিজেকে সামলায়। দূর থেকে ওদের দেখে ছুটে আসে আবদুল মালেক। রিকশা থেকে লাফিয়ে নামে। আপনাদের দেখে ছুটে এলাম। আমাদের একি সর্বনাশ হলো দাদাবাবু। আমার বাপটা বিছানায় পড়েছে। খুব অসুখ। কথা বলতে পারে না। এখন আমার বাপকে কে দেখবে? গরিবকে যত্ন করে দেখা কি সহজ কথা?
গ্রন্থটির বাঁধাই মান উন্নত। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। উপন্যাসটি কলকাতার বাংলাভাষীরা আগে পেয়েছেন। কারণ এটি ২০১২ সালে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স প্রথম প্রকাশ করে। এবার উপন্যাসটি বাংলাদেশের পাঠকরা খুব সহজে সংগ্রহ করে পড়তে পারবেন। উপন্যাস সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে সেলিনা হোসেন বলেন, উপন্যাসটা নিয়ে আমি বছর দশেক ধরে পরিকল্পনা করেছি। আমি মূলত ধরেছি, হিউম্যান ট্র্যাজেডির একটা বড় অংশকে, যেটা মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এবং আমি মনে করেছি, তা সাহিত্যেই আসতে পারে। একাডেমিক রিসার্চ তথ্য দেবে, ইতিহাস দেবে, ঘটনা কীভাবে ঘটেছে তার বর্ণনা দেবে আর সাহিত্য এই বর্ণনা থেকে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, বেদনাকে তুলে এনে সেই কথাটিই বলবে, যেটা মানুষের জীবনের একটি চিরন্তন সত্য। যে সত্যের ভেতর দিয়ে মানুষ তার জীবন পার করে।
সেলিনা হোসেনের সোনালি ডুমুর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান শত্রু-সম্পত্তি আইন প্রণয়ন করলে মনুষ্যত্বের যে চূড়ান্ত অবমাননা হয় তারই এক উপজীব্য উপন্যাস।