নিখাদ ভালোবাসাবাসি নেই ॥ রকিবুল হাসান


কী সুন্দর সাজানো ভুল অঙ্ক

আমার দুচোখে লেগে থাকা মায়াবী সুন্দর দূরে সরে যাচ্ছে
অদৃশ্য নগরে আয়েসী শরীরে নিজেকে লুকোচ্ছে নকল সুখের
নরোম বিছানায়। আমার মুগ্ধতার জোনাকি আলো অভিমানে
আত্মহরণে ডোবে বিরান অন্তরে-সাদাসিধে মাটির ঘরের
মুঠোভরা জুঁইফুল-স্নেহশান্তি যান্ত্রিকতার দাবানলে পুড়ে যায়-

মাটির মানুষ মাটির থাকে না লোহা-লক্কড়ের মতো প্রাণহীন
ঘরের বউকে গভীর আলীঙ্গনে বাঁধার পদ্মাআবেগী মনঢেউ
হিসেবের মরাচরে যেনো পিচঢালা রাজপথ নকল জীবন
শিশিরে-স্নানবতী লাউডগার মতো কাঁচাবউ লাল শাড়ি ভুলে
নিজেকে নগরের নন্দিতা সাজায়-ভিজে মাটির মতো ঘ্রাণবতী
গভীর চুম্বন এখন স্বাদহীন রূপালী ইলিশের জীবন পেয়ে যায়

যৌবনা নদীর চেয়ে বালুচর শুকনো নদীই যেনো বেশি পছন্দের
নিখাদ নারীর চেয়ে ছলাকলা রমণীই কাঙ্খিত হয়ে ওঠে
পুরুষের বুকে-কী এক অদ্ভুত দৌড়ে সুন্দরেরা দ্রুত পালাচ্ছে
কলমিলতায় আটকে পড়া ডাহুকের মতো-ভোরের আলোতে
নেমে আসা ঘরের চালে পাখিদের উৎসব নেই-ঘরের চালও নেই
লতাপাতা বৃক্ষ ফলের বাগান বনফুল যেনো অতীত গল্পের কঙ্কাল

ঘরের জানালাজুড়ে লেগে থাকা সবুজেরা হারিয়ে যায়
যৌবনের আগেই যৌবন হারানো কুমারীর মতো পবিত্র সুন্দর
কতদিন ভেবেছি একটি লাল শাপলা আনবো মৃত্তিকার জন্যে
সদরপুরের বিল থেকে-এখন সেখানে বসতিনগরী ইট-পাথরের
সংসার- জীবনের রঙ কতোভাবে বদলায়- অপ্রতিরোধ্য যৌবনে
কতো ঠোঁটে চুম্বনের আগুন খেলা-সুন্দরেরা অসুন্দরের ভেতর
সুন্দরের শিরোনামে লোভের জিহ্বায় জাগে অতৃপ্তির অভিসারে

সেই কবে থেকে তোমাকে ভাবছি একদিন ভোরের রোদ্দুর
গায়ে মেখে তাঁতের সবুজ শাড়ি কুচি দিয়ে লাবণ্যশরীরে
পাশ ঘেঁষে দাঁড়াবে আমার-লাল শাপলা খোঁপায় গেঁথে
সলজ্জ আভায়-মুগ্ধচোখে তোমাকে দেখি ভেতরে বাহিরে
লাল পিপীলিকার সারির মতো কী সুন্দর সাজানো ভুল অঙ্ক

আমার অন্যায্য আসা

কী অদ্ভুতভাবে নতুন সূর্যের বুক জুড়ে তোমার সুঘ্রাণ নাম
এই প্রথম অন্যরকম কবিতার শিরোনাম
নদী উপচানো জলের মতো তোমার লাবণ্য
আমার দুচোখ ভরে স্রোতের সুনন্দা রেখা এঁকে যায়

সূর্যও দেখে তোমাকে মুগ্ধতার তৃষ্ণায়
এতটা সুন্দর নেশার মতো সূর্যকে কে কবে করেছে দখল
সাধাসিধে এক দোয়েল গহিন তৃষ্ণায় যে ডুবে থাকে
কোনো সন্ন্যাসী কী কোনদিন পুড়েছে এমন সাধনার অগ্নিকাণ্ডে

সূর্যের বুকজুড়ে সূর্যের চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা তুমি
তোমার ঠোঁটের কোণে ঢেউখেলা মধুবাঁক
ভোরের লাবণ্য আছড়ে পড়ে কবিতার লাল শাড়ি প্রিয়তমা
মুগ্ধতায় পাগলা ঢেউয়ে পেতে চাই নির্লজ্জ চুম্বনে

আজ যে নতুন সূর্য উঠেিেছল-নিভে গেছে তোমার আলোয়
তোমাকে চিনি না যদিও-অচেনা নগরে অচিন পাখির মতো
আমার অন্যায্য এই আসা ফিরে যাবে উজানে স্রোতের মতো
তবুও নতুন কবিতা হয়ে ফুটে উঠবে অদ্ভুত লাবণ্যআগুনে
পরাণরমণী তুমি

নিখাদ ভালোবাসাবাসি নেই

আকাশটাও ভেঙে গেছে-খসে গেছে
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো
স্বপ্নবুনন খোঁপাভরা বেলি জুঁই রক্তজবা
টিনের দোচালা চারচালা ঘর
শিশির ভেজা ঘাসফুল উঠোন
এখন পুরনো গল্পের জীবন

রান্নাঘরের পাশ ঘেঁষে সজনে গাছ
মানকচুর যৌবনা ডাগর শরীর
মাথা নিচু করে মমতা ছড়ানো
ঝাকড়া চুলের মতো আমগাছ
দক্ষিণের জানালা ছুঁয়ে দাঁড়ানো
ডুমুর গাছটি চোখে লেগে আছে
এসব এখন যেনো অতীতকাহন

আমার পড়ার ঘরের জানালা
মেখে থাকতো কী যে সতেজ
পুঁই আর লাউডগার আদর
শৈশবের মতো লকলকে শরীর
রান্নাঘরের ভাঙা জানালায় চড়ুইপাখি
কবিতার মতো অধরা আসা-যাওয়া
বুকের ভেতর যখন তখন
ভোরের নতুন আলো ফুটতেই
উঠোনে কৈতর শালিখের খুনসুঁটি
এখন এসব খুঁজি ছানিকাটা
পুরনো চোখের আলোতে অবেলা

গাছের ঝোপে লুকানো টিয়েপাখি
পরান মাতানো লালঠোঁটে
তৃষ্ণার অনলে পোড়ে
শরমে জড়ানো যেনো নববধূ
কাঁচামাটি দূরের গাঁয়ের পথ
মমতাজড়ানো আঁচল বিছানো
শিশির স্নাত দূর্বাঘাসের আলপথ
শহুরী নারীর মধুকলা ফেলে
টিয়েপাখি ঠোঁটের বউটির কাছে ফেরে
কণ্ঠে তুলে আব্দুল আলীমের পল্লীগীতি
এখন এমন করে কে কবে গাঁয়ের পথে ফেরে
মনবধূয়ার শরমচোখে সুখের বাতি হয়ে
এসব এখন পুরনো দিনের বাতিল জীবন

হাওর-বাওড় বিল-ঝিল
মাঠভর্তি থৈথৈ পানি
কলার ভেলায় গ্রামের পর গ্রাম
গলায় জড়ানো লাল শাপলার মালা
কণ্ঠভরা মুর্শিদী গান
এখন সেখানে বুকপোড়া বিরান ভূমি
স্বপ্নহীন বিধবাশরীর যেনো রয়েছে দাঁড়িয়ে
শহরের মতো প্রাণহীন প্রাসাদ এখন
এখানেও তোলে মাথা

হাটুরেবাজার ভেঙে গেলো
নতুন ঝড়ের কালবৈশাখী থাবায়
হাছন লালন চলে গেলো
গাঁও-গেরামের আসর ছেড়ে
রাজপ্রাসাদের সৌখিন উৎসবে
মনপাখি কেঁদে কেঁদে ফেরে
একতারা ভেঙে যায়
দোতারা ডুগি তবলা ভেঙে যায়
অন্তরভেদের খবর
অন্তরেই কেঁদে কেঁদে মরে
অন্তরের কবরেই অন্তরের দাফনকাফন
মনবেদনার খবর নিয়ে
কেউ খবর করলো না
আমি আলপথ ভেঙে
নদীর কিনার ভেঙে
ত্রিমোহিনীর মোড়ে সন্ধ্যারাতে
লালন খুঁজি হাছন খুঁজি
পীর-মুর্শিদী খুঁজি
কোন পথে চলে গেলো
আমার মনের একতারা স্বর্গসুধা

সেই আকাশটাওতো নেই
সরল প্রেমের রাতভর
গল্পের যৌবনও তো নেই
কাঁচামাটির মতো নিখাদ
ভালোবাসাবাসিও নেই
বিরহ অনলে তামাদী যৌবনও নেই