বসেছিলাম রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কিছু দলিলপত্র নিয়ে। আসছে রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষ নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে নিয়ে। “সাচিয়া” নামক পত্রিকার একটি কপি পড়তে গিয়ে খুঁজে পেলাম এমন একটি ছোট্ট সংবাদ যা পড়ে চমকে উঠলাম! ভীষণ মনক্ষুণ্ণ হলাম। বলে কী! নিচে মন্তব্যটির মূল জাপানি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি:
講演内容は全くの初歩的常識範囲を出ず、近代インド文学の極めて概略にも触れることなく極めて低調なものであった。
The content of the lecture did not go beyond the scope of common sense at all, and was extremely sluggish without touching on the very outline of modern Indian literature.
অবিশ্বাস্য নয় কি! এটা কি হতে পারে? অন্ততপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে! ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে কবি, কথাসাহিত্যিক এবং গবেষক অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু জাপানে এসেছিলেন সম্ভবত আমন্ত্রিত হয়ে। কারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সেই বছর ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততম জন্মবর্ষ।
জাপানে ১৯৫৭ সালেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং গ্রহণ করা হয়েছিল এক মহাপরিকল্পনা সাড়ে তিন থেকে চার বছরের জন্য। এই উপলক্ষে “তাগো-রু কিনেন কাই” বা “টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন” গঠন করা হয়েছিল গৃহীত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য।
টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় বিশিষ্ট লেখক ও রবীন্দ্রজীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই সূত্র ধরে বুদ্ধদেব বসুকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা জানা নেই। নাকি জাপান পেন ক্লাবের আমন্ত্রণে এসেছিলেন তাও সুস্পষ্ট নয়। হয়ত কোথাও সেই তথ্য আছে। এখনো খুঁজতে বাকি।
বুদ্ধদেব বসু, স্ত্রী প্রতিভা বসুসহ জাপানে এসেছিলেন এবং অবতরণ করেছিলেন ওসাকা মহানগরে। সেখান থেকে প্রাক্তন রাজধানী কিয়োতো, তারপর কোবে, কোবে বন্দরনগর থেকে টোকিওতে আসেন। এরপর য়োকোহামা, হাকোনো প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। এসব জায়গায় তিনি ৬টি বক্তৃতা দিয়েছেন। এসব তথ্য তাঁর লিখিত “জাপানি জর্নাল” গ্রন্থ থেকে জানা যায়। তিনি দশ দিন জাপানে ছিলেন।
এই গ্রন্থে তিনি জাপানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। জাপানিদের জীবনযাপন, চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি, নান্দনিকতা, নাট্যকলা, সাহিত্য, রীতিনীতি, ইতিহাস নিয়ে অসাধারণ সব অনুধাবন তুলে ধরেছেন। জাপানি নারীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সাহিত্য বিষয়ে যা বাঙালি সমাজে নেই বললেই চলে।
তুলনা করেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে। মোদ্দাকথা, জাপানকে তিনি তাঁর মতো করে আবিষ্কার করে অভিভূত হয়েছিলেন! কেন বিদেশিরা জাপানে এলে পরে জাপানের প্রেমে পড়ে যান সেই কারণও তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
এহেন বুদ্ধদেব বসু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলানামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট রবীন্দ্রঅনুরাগী হিসেবে জাপানি ভক্তদের কাছে পরিচিত ছিলেন এটাও বোঝা যায় তাঁর ভ্রমণের মাধ্যমে। সুতরাং তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এটা ছিল টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিকল্পনার অধীন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত নিয়মিত বক্তৃতামালার অন্তর্ভুক্ত। আয়োজন করেছিল তিনটি সংগঠন যথাক্রমে, টেগোর কিনেন কাই, নিচিইন বুনকা কিয়োকাই (জাপান-ভারত সংস্কৃতি সংস্থা) এবং নিহোন হিকাকু বুনগাকু কাই (জাপান তুলনামূলক সাহিত্য সংস্থা) যৌথভাবে। বক্তৃতার বিষয় ছিল, “কিনদাই ইনদো বুনগাকু তো তাগো-রু নো ইগি“ অর্থাৎ, “আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য এবং রবীন্দ্র তাৎপর্য”, তারিখ ছিল জানুয়ারি মাসের ২১, সময় দুপুর ২টা থেকে অপরাহ্ণ ৪টা পর্যন্ত। দুই ঘণ্টার দীর্ঘ বক্তৃতা! ভাবাই যায় না।
সেই বক্তৃতায় বুদ্ধদেব বসু ইংরেজিতে কী বলেছিলেন জানি না, খুঁজে পাচ্ছি না। বলাই বাহুল্য, তাঁর বক্তৃতা ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে দিয়েছেন অভিজ্ঞ দোভাষী। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণের সময় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি বক্তৃতা যদি জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়ে জাপানিদেরকে অভিভূত করতে পারে তাহলে বুদ্ধদেব বসুর বক্তৃতা শুনে কেন এমন কঠোর মন্তব্য করবেন জাপানিরা, যা টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের মাসিক মুখপত্র “সাচিয়া “(সত্য)-তে মুদ্রিত হবে। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। সংবাদে বলা হচ্ছে, বুদ্ধদেব বসু বক্তৃতার মূল বিষয়তেই যাননি। এমনকি, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য বিষয়েও কোনো কথা বলেননি। তাহলে তিনি কী বলেছিলেন বক্তৃতায়? যার জন্য রাবিশ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এই রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য আবার ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে।
আমার কাজের যেন শেষ নেই।
টোকিও ১৯.৩.২০২১