১৯৮৪ সালে দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পর বিগত ৩৬ বছরে দেশে কতবার ফিরতে পেরেছি তা আঙুলে গোনা যাবে। অবস্থানও ছিল নাতিদীর্ঘ। কখনো একদিন, সপ্তাহখানেক। দীর্ঘতর বললে মাস ছয়েক।
১৯৮৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যাওয়া-আসার মধ্যে কম স্মৃতির জন্ম হয়নি!২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে সকল ছবি আমার সংগ্রহে আছে প্রায় সবগুলোর পেছেনে রয়েছে সময়ের অম্লমধুর রূপছায়া।
ছবি মানেই স্মৃতি।
ছবি মানেই কাজের চিহ্ন।
ছবি মানেই ঘটনা।
ছবি মানেই সময়কে ধরে রাখা।
ছবি মানেই আনন্দ।
ছবি মানেই বেদনা।
ছবি মানেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
ছবিসর্বস্ব স্মৃতির কথা লেখার ইচ্ছেতে আজকে তুলে দিচ্ছি ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের একটি রাতের ঘটনা।
কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয় দৈনিক কুমিল্লার আলো নামে একটি ট্যাবলয়েড। এর পরিচালক জসিমউদ্দিন কনক, খায়রুল আনাম রায়হান, আবদুল জব্বার প্রমুখ এরা সবাই আমার অনুজপ্রতিম। তাদের সঙ্গে অগ্রজ দুজন সৃজনশীল মানুষও ছিলেন, একজন হলেন কবি, গল্পকার ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ আহমাদ তারেক এবং অন্যজন কুমিল্লার সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের সুপরিচিত মুখ মুসতাক আহমেদ শিমুল। মাঝেমাঝে ঠাকুর জিয়াউদ্দিন ঠাকুরও আমাদের আড্ডায় কিছুক্ষণের জন্য আসতেন, কুমিল্লার নানা ইতিহাস জানতে পেতাম তাঁর কাছ থেকে।
পত্রিকাটির অফিস ধর্মসাগর দিঘির পশ্চিম পাড়ে। এই পাড়ায় ছিলাম এক সময় প্রায় দশ বছর ১৯৭৪ সাল থেকে। আমার সাহিত্যচর্চার শুরু এই পাড়াতেই ১৯৭৬ সালে।
যাহোক, ২০১৩ সালের শেষদিকে আমি নিজের বাড়ির ছাদে দুটি কক্ষ নির্মাণ করিয়ে একটিতে “মানচিত্র বইঘর” পুনরায় চালু করেছিলাম। প্রথম চালু করেছিলাম ১৯৯২ সালে রামঘাটলায়।
সন্ধ্যের পর চকবাজার থেকে পায়ে হেঁটে ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ে গিয়ে উক্ত পত্রিকার অফিসে আড্ডা দিতাম সপ্তাহের প্রায় চার দিনই। অবশ্য একটি কাজও করে দিতাম, পত্রিকায় সাহিত্য পাতাটি দেখতেন তারেকভাই। আমি শুক্রবারের ওই পাতায় চার-পাঁচটি বইয়ের সচিত্র পরিচিতি তুলে ধরতাম। ডিজাইন আমি নিজেই করে পেন ড্রাইভে ভরে নিয়ে চলে যেতাম। বেশ কয়েক মাস এই কাজটি করেছিলাম।
সন্ধ্যের পর দারুণ আড্ডা জমে উঠত। আমার জন্য ছিল এক স্বর্গীয় আনন্দ। এটা ছিল আমার অনেক বছরের স্বপ্ন তাই “মানচিত্র” কাগজ এবং বইয়ের দোকান দিয়েছিলাম ১৯৯২ সালে কুমিল্লায়। নানা কারণে আমার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।
মফস্বল শহরে পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের কাজ করার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ, রোমাঞ্চ এবং মাদকতা আছে। পৃথিবীতে সাহিত্য আড্ডার মতো রসালো ও মাতাল আনন্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। বিশ্বভোলা তুমুল আড্ডা হয়ে ওঠে বিচিত্র আইডিয়ার কারখানা, সৃজনশক্তির মৃগয়া শিকার আর তর্ক-বির্তকের মৃণালফোটার সরোবর। কুমিল্লার কাগজ পত্রিকার প্রতিদিনকার এই আড্ডাটি তাই ছিল। মনে মনে আমি কল্পনা করতাম ৮০-৯০ এর সময়কার কলকাতার “দেশ” বা “আনন্দবাজার পত্রিকা”র সান্ধ্যআড্ডার কথা। হয়ত অতিশয়োক্তি আছে আমার ভাষ্যে। কিন্তু আমার স্বপ্নজারিত এই অনুভূতিটাই হত।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিদ্ধান্ত হলো হঠাৎ করেই যে, বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবো আমরা। কিন্তু সময় একদম হাতে নেই মাত্র একটি দিন ছাড়া। কী করা যায়? করতে পারলে একটি মাইল ফলক হবে। ১৬ পৃষ্ঠার সংখ্যাটি হবে কুমিল্লার ইতিহাসে প্রথম একটি উদ্যোগ। যেই ভাবা সেই কাজ। লেখা সংগ্রহ করা হল, নিজেরাও লিখলাম। ১৫ তারিখ বিকেলবেলা কাজ শুরু হলো।
আমি ডিজাইনে আর তারেকভাই অলঙ্করণে লেগে গেলাম। পত্রিকা, ম্যাগাজিনের ডিজাইন করা আমার কাছে জলবৎ ব্যাপার। রাত ১১ টার মধ্যেই প্রেসে পাঠানো হল মেটার।
ভোরবেলা পত্রিকা প্রকাশিত হলো। কনক নিয়ে এলো কয়েকটি সংখ্যা প্রেস থেকে। আমরা সারারাত জেগে জেগে তুমুল আড্ডা দিলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম পত্রিকার জন্য। ঝাঁঝালো খানাপিনা আর সিগারেটের স্তুপে একাকার অফিস। শরীরজুড়ে নিদারুণ দুর্গন্ধ! বাসায় না গিয়ে তারেক ভাই, শিমুলভাই এবং আমি তিন জনে মিলে বিজয় দিবস নিজেদের মতো করে উদযাপন করব বলে বিশেষ সংখ্যা হাতে চলে গেলাম গোমতী নদীর পাড়ে, যেতে যেতে কাপ্তান বাজারে, শিমুল ভাইয়ের বাসায় চা-বিস্কুট খেয়ে রিকশায় চেপে বাঁধের কাছে নামলাম।
তারপর হেঁটে খেয়খাটের কাছে গেলাম। সেখানে বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে সন্ধেবেলা ছাট্টিপট্টিতে গেলাম নাদের ট্রেডিংএ। সেখান থেকে রিকশায় চেপে আবার ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে। তারপর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছি। এর মধ্যে মা যে কতবার কল দিয়েছে আমাকে! কোথায় আছি, কী করছি, খেয়েছি কিনা? দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা যেমনটি করত যখন কলেজের ছাত্র ছিলাম। মায়েরা চিরকাল এরকমই, সন্তান যতই বড় হোক, বুড়ো-বুড়ি হোক, তার মনের মধ্যে তারা চিরশিশুই!
উক্ত সংখ্যাটির একটি কপি জাপানে এনেছিলাম। এক বন্ধু নিয়ে গেল এবং হারিয়ে গেল। যাওয়া-আসার পথের ধারে কতকিছুই রেখে যাব, অনাগত প্রজন্ম খুঁজে পেলে রোমাঞ্চকর ভাববে কি?
টোকিও ২২.৩.২০২১