স্কুলের পাঠ্যবইতে যা গল্প আছে, তা তো পড়ছেই শিশুরা। কিন্তু তাতে যতটা না আগ্রহ, তার চেয়ে সেসব গল্পের জন্য রয়েছে বাধ্যবাধকতার বেড়াজাল। মিশে যায় ভয় ও আতঙ্ক! পরীক্ষার খাতায় কতটা হুবহু মুখস্থ লিখে দেওয়া যায়-সেই প্রতিযোগিতা যেন পুরো পরিবারেরই দায়িত্ব হয়ে ওঠে। শিশুদের পরীক্ষার টেনশন যখন ঘরের অভিভাবকদের করতে দেখে, তখন স্বপ্নীল ভুবনটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাঠ্যবইয়ের গল্প পাঠে শিশুকে আনন্দ যতটা দেয়, তারচেয়ে বেশি আনন্দ কেড়ে নেয়। পরীক্ষার উত্তরপত্রে তার মতো করে কিছু আর লিখতে পারে না। গল্প পড়ে তার নিজের কি বোঝাপড়া হলো, সেটা সে কখনো সে লিখতে পারে না।
স্কুল টিচার, হোম টিচার, কোচিং সেন্টারগুলো জোর করে একটা ফরম্যাট তৈরি করে দেয় এবং সে নির্ধারিত ফরম্যাটই তাকে উত্তরপত্রে লিখতে হয়-বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন সে ‘মুক্ত লেখা’ বা ‘আউট বই’ পড়তে পারে, তখন সে চাপহীন পরিবেশ থেকে চলে যেতে পারে তার জাদুর পৃথিবীতে-সেখানে সে শিক্ষার ভারে নতুন চাষাবাদের সমৃদ্ধি পায়। সে চাষাবাদ সৃষ্টি করে মস্তিষ্কের ভেতর এক কল্পজগৎ। আমরা হয়তো সেভাবে খেয়ালই করি না-একজন শিশু তার অপর বন্ধু শিশুর সঙ্গে কীভাবে সাবলীল গল্প বলছে। কেননা, শিশুরা গল্প বলতেও ভালোবাসে। কল্পনা শেয়ার করতে ভালোবাসে। সরল শিশুমন সুযোগ পেলেই কল্পনা আর রোমাঞ্চের জগতে পৌঁছে যেতে পারে।
শিশুসাহিত্যে শিশুকে সেই সারল্যের আনন্দ দিতে হবে। শিশুরা সবার আগে আনন্দটাই পেতে চায়। তা সেটা পোশাক, খেলনা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া বা বই উপহার পাওয়ার মধ্য দিয়েই হোক। কিন্তু সংসারে নিত্যদিনের বাজারের ব্যাগে, কত কেজি মাছ মাংস বা কত পরিমাণ টাকা সেখানে ব্যয় হয়েছে-এর জন্য তাদের মাঝে ততটা আনন্দ বা কৌতূহল অনুভূত হয় না।
শিশুরা একটু ছুটি পেয়ে যেমন খেলতে আনন্দ পায়, তেমনি বই পড়তেও আনন্দ পাওয়ার পরিবেশ ও ব্যবস্থা পাওয়ার অধিকার রাখে। তারা যেন খারাপ কিছু ভাবতে না পারে, নিজেদের মধ্যে যেন ন্যায়বোধ তৈরি হয়, সৌন্দর্যবোধ তৈরি হয়-তার জন্য সাহিত্যের মতো মহৌষধ পৃৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
বড় মাপের সাহিত্যিকেরা যখন ছোটদের জন্য লেখেন, তখন শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবনাটার সঙ্গে সঙ্গে থাকে রুচি ও সৌন্দর্যবোধের চেতনা । ছোট্ট পাঠকের সেই প্রথিত চেতনার মাঝে তৈরি হয় আরেক নতুন পৃথিবী। সেই ছোট্ট স্বপ্নপূরী পৃৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করে কত শহর-গ্রাম, কত অজানা দেশ-মহাদেশ, কত রকম নদী-পাহাড়-সমুদ্র- দ্বীপ ও জঙ্গল। সে জগতের কত রকম মানুষ, কত রকম পশু-পাখি। বিজ্ঞানের গল্প পড়ে চলে যায় মহাকাশে। রোবট দেখে সেও বানাতে চায় তার মতো একটা রোবট। ছোট্ট পাঠক নিজের মনে মনে সেই আপন করে পাওয়া পৃথিবীটাকে ভালোবাসতে শুরু করে। কোথায় পিরামিড, ধু ধু মরুভূমি, কোথায় সাগর-মহাসাগর, কোথায় আমাজন, কোথায় বা মিসিসিপি-পদ্মা মেঘনা যমুনা…।
সাহিত্য পড়ার অবচেতনেই শিশু হয়ে ওঠে মহাবিশ্বের অংশীদার। একুশ শতকে বিশ্বের চলমান সবকিছু ছাপিয়ে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির জয়জয়কার। সারা বিশ্বের মানুষ এক হয়ে গেছে এখানে। সেখানেও শিশুদের উপযোগী বর্ণিল উপকরণে ঠাসা। শিশুরাও সেসব সানন্দে গ্রহণ করছে। এটার খারাপ দিক সমালোচনা না করে ভালো দিকটা নিয়েই আলোচনা ও গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু তারপরও বলতে হয়, যতই টিভির নানা রঙিন চ্যানেল, কার্টুন, ইউটিউব-মুভি আর স্মার্টফোনে মোবাইল-গেম খেলা আসুক, শিশুদের আকর্ষণে সেসব বাজারি চিন্তা শিক্ষার উপকরণ গ্রহণ বর্জনের মধ্যে দিয়েই চলবে।
এতে ঘাবড়ানোরও কিছু নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ছোঁয়া ঘরের শিশুকে দিতে হবে। না দিলে সে পিছিয়ে পড়বে-সেটাও সত্য।
এখানে একটা কথা বলতেই হবে যে, শহর-গ্রামে সব শিশুর ছেলেবেলাটা একই রকম। কল্পনার দুনিয়ায় সবাই একই রকম সাবলীল, স্বচ্ছন্দ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন : ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্র্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নতুন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শতসহস্র বছর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে।
সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন তেমন সুকুমার যেমন মূঢ় যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে।’ কাজেই নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় বইয়ের সঙ্গে শিশুদের সখ্য গড়ে তুলে দিতে হবে। বইয়ের সঙ্গে তার সেই বন্ধুত্ব চিরজীবনই রয়ে যাবে। মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব ছিন্ন হতে পারে, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোনো দিন ছিন্ন হয় না।
১০ বছরের নিচের শিশুরা মূলত ছবি দেখে বই পছন্দ করে। আমরা এ বইয়ে গল্প নির্বাচনের জন্য ১০ থেকে ১৬ পর্যন্ত শিশুদের বয়স বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছি। তবে বইতে দেওয়া প্রতিটি গল্প বড়দেরও চমৎকার আনন্দ দিতে সক্ষম। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি প্রতিটি গল্পে অলঙ্করণ দিতে। এর ফলে শিশু-কিশোর পাঠকেরা গল্পের মাঝে দ্রুত একটা কল্পনার চিত্র আঁকতে পারবে। চিত্রকর্মের মাধ্যমে গল্পের কাহিনিতে যোগাযোগ ঘটাতে শিশুরা আরও একধাপ এগিয়ে যায়। এটা সারা জীবনের জন্য তাদের মনের মাঝে গেঁথেও যায়। আমরা বাস্তবেও দেখি, মানুষ শেষজীবনে এসেও ছেলেবেলার পড়া গল্পগুলো, গল্পের চরিত্রগুলো ভুলে যায় না। বাইরে একবেলা ভালো খেতে যে পরিমাণ অর্থ চলে যায় সে তুলনায় একটা গল্পের বইয়ের মূল্য খুবই নস্যি। কিন্তু এ নস্যির প্রতিদানটা বহুগুণ মূল্য পায়, যা অর্থের পরিমাপে তুলনা করা যায় না।
বইটির প্রকাশ প্রস্তুতি ৪-৫ বছরে ধরে। নোবেলজয়ী লেখকদের লেখা ‘ছোটদের গল্প’ খোঁজা এবং হাতে পাওয়ার অনেক কষ্টের কাহিনি জমে আছে। যেমন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্পটি। তিনি একটিমাত্র ছোটদের গল্প লিখেছেন! কিন্তু সেটি আর উদ্ধার করতে পারি না। শেষ পর্যন্ত বছর পিছিয়ে গেল। সহযোগিতার হাত বড়িয়ে দিলেন বন্ধুবরেষু আলীম আজিজ। শিল্পী ধ্রুব এষ শর্ত দিয়ে বললেন, আইজাক বশেভিস সিঙ্গারের (ফুলস প্যারাডাইস) ‘বোকার স্বর্গ’ গল্প ছাড়া এ বই প্রকাশ করা যাবে না। এ গল্প দিতেই হবে। আবার সেগুলো যথার্থভাবে আমাদের দেশের শিশুদের উপযোগী করে অনুবাদ করাটাও ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। অসাধারণ একটি ভূমিকা লিখে দিলেন কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম। যে কারণে বইটি আরও সমৃদ্ধি পেল। অপরাপর চ্যালেঞ্জ ছিল অলঙ্করণ করতে। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে রিয়াজ আহমেদ প্রচ্ছদ ও কয়েকটি গল্পের অলঙ্করণ করে দিয়েছেন। অনুবাদ করেছেন, জাহীদ রেজা নূর, লিখন রহমান, আবুল বাসার, নুসরৎ নওরিন, রাজিউল হাসান ও মো. সাইফুল্লাহ। অলঙ্করণ করেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল, বিপ্লব চক্রবর্তী, রিয়াজ আহম্মেদ, নিয়াজ চৌধুরী তুলি ও মাহফুজ রহমান। নেট থেকেও ধার করতে হয়েছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও শেষ পর্যন্ত শিশুদের প্রতি সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক হয়ে বইটিকে জয়ী করে দিয়েছেন। তাঁদের কারণেই ২০২১ বইমেলায় বইটি আলোর মুখ দেখতে পেল। তাঁরা সবাই নিজ নিজ কর্মজগতে দেশের সেরা মানুষ। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সমগ্র প্রকাশন ও এ বইয়ের পাঠকদের পক্ষ থেকে সংশিষ্ট সবাইকে আবারও বিনীত ধন্যবাদ জানাই।
গল্পগুলো পড়ে শুনিয়েছি আমার এগারো বছরের শিশুকন্যা লুবাবা শরমিন সেরাকে। তার আনন্দ, অনুভব ও ভালো লাগাকে আমি নিরীক্ষার গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি। অর্থাৎ এ বইয়ের গল্প নির্বাচনে শিশুরও সম্পৃক্ততা আছে। আমরা পরবর্তী সংস্করণে গেলে চেষ্টা করব নোবেল জয়ীদের আরও গল্প সংগ্রহ করতে এবং বইতে সংযুক্ত করতে।
শিশুদের প্রতিদিনের বাস্তব জীবনপথে চলার রসদ হিসেবেই স্মৃতিসঙ্গী হয়ে উঠুক মানসম্মত সাহিত্য। এ রসদের জোগান দেওয়া প্রতিটি অভিভাবকের দায়িত্ব। কেবল মা-বাবা হলেই অভিভাবক-এমনটি ভাবাও উচিত নয়। বন্ধু-আত্মীয়স্বজন যেখানে শিশু আছে-তার জন্য চকলেট, আইসক্রিমের মতো একটি বইও উপহার দিন। নোবেল জয়ী লেখকদের ছোটদের গল্প বইটি পড়ে, শিশুরা কল্পনার বন্ধু খুঁজে পাক বিশ্বের অন্যান্য দেশের রচিত গল্পের চরিত্রগুলোর মাঝে। পড়তে পড়তে নবীন কচি মন গেয়ে উঠুক আপনমনে, ‘এলেম নতুন দেশে’। এমনটি ঘটলে আমাদেরও খুশির সীমা নাই।
[ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের ]