যাওয়া-আসার পথের ধারে (পর্ব-২) ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


এক-একটা প্রাচীন শহর আমার কাছে এক-একটা প্রাচীন জাদুঘর। জাদুঘরে যেমন বহু মূল্যবান স্থবির কিন্তু আশ্চর্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক নিদর্শন থাকে যা আমাদেরকে অবাক করে, বিস্মিত করে, ভাবায়, চিন্তার খোরাক জোগায় এবং সেসবের তথ্য-উপাত্ত-ইতিহাস আমাদের মননকে ঋদ্ধ করে, জ্ঞানদান করে ঠিক তেমনি, একটি শহরে এমনকিছু পণ্ডিত, গুণী, মেধাবী এবং সংস্কৃতসেবী মানুষ থাকেন যাঁরা অমূল্য জ্ঞানকোষ এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ বলে বিবেচিত। তাঁরা আছেন বলে অথবা তাঁদের মহৎ কর্মকাণ্ডের ইতিহাস আছে বলেই সমাজ পিছিয়ে যায় না বরং বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা সেই বৈচিত্র্যময়তাকে উপভোগ করতে পারি না, ধরেও রাখতে অক্ষম।কজনইবা আমরা তাঁদের খোঁজ-খবর রাখি। অথচ তাঁরা শহরের অলিতে-গলিতে নিভৃতে তাঁদের কাজ করে চলেছেন। তাঁরা জনসম্মুখে অথবা মঞ্চে আসেন খুবই কম।

কুমিল্লা শহর একটি প্রাচীন শহর। এই শহরেও ছিলেন যুগের পর যুগ ধরে অনেক জ্ঞানী, গুণী এবং সংস্কৃতিসেবী মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন, প্রজন্ম জানেই না তাঁদের কথা। এই শহরে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতি জাদুঘর না থাকার কারণে সংরক্ষিত নেই সেসব আশ্চর্য প্রত্মমনীষীদের স্মারক বা ইতিহাস। এই অনাগ্রহ আমাদেরকে জাতিগতভাবে দুর্বল এবং অনুজ্জ্বল করে রাখে। যা কাম্য নয়।

৪৭ সালের ভারতভাগ, ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই তিনটি বড় ঘটনায় পূর্ববঙ্গ থেকে অগণন জ্ঞানী, গুণী এবং সংস্কৃতিসেবী মানুষ যাঁদের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হয়েছেন। অগণন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনা ও রাজাকার, আলবদরদের হাতে নিহত হয়েছেন। কুমিল্লা শহর তার ব্যতিক্রম নয়।

হারিয়ে যেতে যেতে এখন এই শহরে কতিপয় মানুষ নিবু নিবু হয়ে আছেন যাঁদেরকে আমরা কতখানি মূল্যায়িত করতে পারছি প্রশ্নটি আমাকে তাড়িত করে চলেছে। পণ্ডিতপ্রবর ইন্দ্র কুমার সিংহ, অধ্যাপক বিমলেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, শিশুসংগঠক অনিমা মজুমদার, আইনজ্ঞ অজিত কুমার চৌধুরী, আইনজ্ঞ, অধ্যক্ষ দিলিপ কুমার পাল এবং দুর্জয় গ্রন্থানুরাগী ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ সবে ধন নীলমণি হয়ে আমাদের সম্মুখেই আছেন কিন্তু আমরা কি তাঁদের দেখতে পাই? আমরা কি তাঁদেরকে মঞ্চে আহবান করি? আমরা কি তাঁদের মেধাশক্তিকে প্রজন্মকে গড়ে তোলার প্রকল্পের কাজে লাগাতে পারছি?

যতবারই প্রবাস থেকে বাংলাদেশে ফিরে যাই ততবারই ঘনিষ্ঠ গুণীজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার লক্ষ্য নিয়ে যাই। তেমনি ২০১১ সালে গিয়েছিলাম বাগিচাগাঁওস্থ এই শহরের প্রবীণ নাগরিক আইনজ্ঞ আমার বাবার ঘনিষ্ঠ সুহৃদ অজিত কুমার চৌধুরী তথা অজিতকাকার বাড়িতে। ব্রিটিশ ভারতের সমৃদ্ধ অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী বীর অতীন্দ্রমোহন রায় চৌধুরীর আপন ভাগিনেয় এই বয়োঃজ্যেষ্ঠ আইনজীবী অজিত কুমার চৌধুরী। যাঁকে চলমান বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে সহজেই।

তিনি কথা প্রসঙ্গে খেদের সঙ্গে বললেন, দেশ এগোবে কীভাবে যদি রাজনীতিকরা লাইনচ্যুত হয়। রাজনীতিকরা যদি ইতিহাস না জানে, ইতিহাস জানা তাঁদের মস্তিষ্কের জন্য অনিবার্য জ্বালানি, এটা তারা অনুধাবনে অক্ষম। যার জন্য অবহেলিত হচ্ছে রাষ্ট্রের, জাতির আলোকবর্তিকা জ্ঞানী, গুণী এবং মেধাবী মানুষরা, তাঁরা আজ ভূলুণ্ঠিত। কুয়োর ব্যাংক অক্সফোর্ডের টিচার হাতে পারে না, হয় মঞ্চের ক্যানভাসার। বাংলাদেশে কি আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি না? তুমি কী বলো? তুমি তো জাপানে থাকো, সেই দেশের জ্ঞানী, গুণী, সংস্কৃতিসেবীরা কি অবহেলিত? জাপানি রাজনীতিকরা কি তাঁদেরকে মানছেন না? তাঁদের কথা শুনছেন না? উন্নতির জন্য, উত্তরণের জন্য, সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য বুদ্ধিজীবীদের শরণাপন্ন হচ্ছেন না? হচ্ছেন, আমরা জানি, আমরা হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও খবর পড়ি, ছবি দেখি। তোমার মাধ্যমেও তো কত তথ্য জানতে পারছি, পারছি না? মূল্যায়ন হচ্ছে কোথায়? …..কাকে কী বলব? আগের দিনের মানুষের দেখার চোখ ছিল, বোঝার মন ছিল, দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল-এখন কী দেখতে পাচ্ছি? নিজের পাত্রের দিকেই নিবিষ্ট নজর, অন্যদিকে কোনো খেয়াল নেই!

অজিতকাকা পণ্ডিত মানুষ। বিস্তর পড়াশোনা, বিস্তর জানাশোনা এবং অভিজ্ঞতার বিশাল ভাণ্ডারী। তাঁর কথার যুক্তি আইনি ধারার, অস্বীকার করা বা প্রতিবাদ করার শক্তি আমার নেই। মাথা নত করে সায় দিলাম। চা পান করতে করতে বললেন, চলো আজ সত্যিকার একজন পণ্ডিত মানুষের কাছে তোমাকে নিয়ে যাই। দেখবে পাণ্ডিত্য কাকে বলে।

যাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। ছাত্রাবস্থায় দেখে থাকলেও বহু বছরের ব্যবধানে চিনতে পারিনি। তাঁর নাম দিলীপ পণ্ডিত। পেশায় ইতিহাসের অধ্যাপক। বাদুরতলার খ্রিস্টান পাড়ার পুরনো বাসিন্দা। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তিনি। এখানে রয়েছে বিখ্যাত শিশুমঙ্গল হাসপাতাল।

বন্ধুও ছিল কয়েকজন এই পাড়ায় আমার। সাদরে ঘরের মধ্যে আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। ছিমছাম টিনের চালাঘর। একেবারেই নিরাভরণ পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আবাস। প্রথম দর্শনেই তাঁর শান্ত, সৌম্য এবং কান্তিমান মুখশ্রী বুকের ভেতরে গভীর শ্রদ্ধা জাগিয়ে দিল। পরিচয় পর্বের পর জানালেন আমার বাবাকে চেনেন ভালো করেই। স্বল্পভাষী কিন্তু যা বলেন একেবারে তীর্যক, যুক্তিনিষ্ঠ এবং ভাবিয়ে তোলা। হাস্য-কৌতুকমিশ্রিত মন্তব্য গভীর পাণ্ডিত্যের ইঙ্গিত দেয়।

চা-পর্বের পর বিশ্বরাজনীতি, এশিয়ার ইতিহাস, এশিয়ার জাগরণে জাপানের ভূমিকা ও অবদান, ভারতবর্ষ তথা বাংলা অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সবশেষে ধর্ম নিয়ে আলোচনায় যে ধীশক্তির পরিচয় দিলেন তাতে বুঁদ হয়ে শোনা ছাড়া উপায় ছিল না। সেদিন তিনি একেবারে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন আমার কাছে। এর মূল কারণ, তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক আর আমি ইতিহাসের ছাত্র। যোগসূত্রটা সেখানেই। খাপে-খাপে মিলে গেছে। এমন জমে উঠেছিল আড্ডাটি যে সেদিন কীভাবে দু-তিন ঘণ্টা চলে গিয়েছিল টেরই পাইনি! আবার আসার আমন্ত্রণ জানালেন।

এরপর আরেকদিন অজিতকাকাসহ গিয়েছিলাম সুবক্তা, সুধাময় মানুষটির কাছে। সেদিন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কাছ থেকে অজানা অনেক তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনা জেনে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম! এত কিছু জানেন অথচ একটি গ্রন্থ রচনা করেননি! এমনকি, নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন কাউকেই বলেননি কোনোদিন! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, কলকাতার আকাশবাণী-তে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কথিকা পাঠ করেছেন। যা এই প্রথম জানলাম আমি যে, এই শহরে এমন একজন বুদ্ধিজীবী-মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।

পরিতাপের বিষয় যে, সম্প্রতি তিনি পরলোকবাসী হয়েছেন। ২০১৭ সালে গিয়ে আর দেখা পাইনি। তবে দিলীপ পণ্ডিত স্যারকে ভুলে যাইনি আমি। ফিরে এসেই অনেক দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস লিখি “প্রথম সূর্য” নামে। সেই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দিলীপ রোজারিওর ছায়া বা প্রতিভূ হচ্ছেন উক্ত আলোচিত খ্রিস্টান পাড়ার নমস্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক দিলীপ পণ্ডিত। দুই দফা সাক্ষাতকালে তাঁর প্রদত্ত বক্তব্যের অধিকাংশই দিলীপ রোজারিওর মুখ দিয়ে বলিয়েছি। আনন্দের বিষয় যে, উপন্যাসটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এবারের বইমেলায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন সহপাঠী এটা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। তাকে এবং প্রকাশককে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। তাদের কল্যাণে মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার খ্রিস্টান পাড়ার প্রতিচ্ছবি এই গ্রন্থে চিরস্থায়ী হবে।

মানুষকে আমি ছোট করে দেখতে পারি না, মনুষ্যত্বহীন মানুষকে আমি পশু বা রক্তপায়ী জানোয়ার বলেই জানি। সামান্য দোষত্রুটি থাকলেও প্রকৃত মেধাবীকে প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে আমার কোনো পক্ষপাতিত্ব বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। স্বর্গীয় দিলীপ পণ্ডিত স্যারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এই স্বাধীনতার মার্চ মাসে।

টোকিও ২.৩.২০২১