সন্দেহ ॥ জাহীদ ইকবাল


হঠাৎ ফরিদ সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। চোখমুখ থেকে যেন ফিনকি দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরোয়। ঠোঁট দুটো সমানে কাঁপতে থাকে। তিনি দরদর করে প্রচণ্ড রকম ঘামছেন। তাঁর মনে কু ডাক দিয়ে উঠলে তিনি এমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। তাঁর মনে হচ্ছে তারেক হারামজাদাটা বাসায় ঢুকেছে! এই মুহূর্তে শিরীন ছাড়া বাসায় কেউ নেই। শিপ্রা অফিসে। কাজের মেয়েটা গেছে গ্রামের বাড়িতে। শিরীনের কোনো সর্বনাশ হওয়ার আগেভাগেই তাঁর বাসায় ফেরা দরকার। কিন্তু কীভাবে ফিরবেন! রাস্তায় যে পরিমাণে জ্যাম- বাসায় পোঁছাতেই তাঁর ঘণ্টা দুই লেগে যাবে। ততক্ষণে মেয়েটার বড় রকমের কোনো সর্বনাশ করে বদমায়েশটা সটকে পড়বে।

অস্থির ভঙ্গিতে তিনি সমস্ত পকেট হাতড়ালেন। কোনো পকেটেই ফোনটা খুঁজে পেলেন না। তাড়াহুড়োর কারণে ফোনটা বিছানায় ফেলে এসেছেন। তড়িঘড়ি করে যে কাজে এসেছিলেন, সেই কাজটাও হলো না। এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। এক সপ্তাহ পরেও যে কাজটা হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মোটাদাগের ঘুষ ছাড়া ফাইলটা বদর উদ্দিন ছাড়বে বলেও তার মনে হয় না। লোকটা একটা মুখোশধারী ধুরন্ধর ব্যক্তি। ফাইলপত্র সবকিছুই ঠিকঠাক তবু্ও এসপ্তাহ ওসপ্তাহ করে করে তিন মাস ধরে তাঁকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।

ফরিদ সাহেব গুলিস্তানের বাস থেকে এক প্রকার লাফিয়ে পড়লেন রাস্তায়। একটুর জন্য তিনি রিকশার সঙ্গে ধাক্কা থেকে গা বাঁচালেন। রিকশাঅলা দক্ষ বলেই সম্ভব হয়েছে। সে দ্রত ব্রেক কষে তাঁকে একটি বিশ্রী গালি দিল।

গালিটা তিনি গায়ে মাখলেন না। ধুলার মতো ঝেড়ে ফেললেন। পেছনেও তাকালেন না। কিছুই হয়নি এমন একটি ভঙ্গি করে দ্রুত উদ্ভ্রান্তের মতো পা ফেলে কোনো একটি ফোনের দোকান খুঁজতে লাগলেন। পেলেন না। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে একাকার। কপালে ভাঁজ ফেলে এক উঠতি তরুণের দিকে চোখ রাখেন এবং একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে তার সামনে এসে থমকে দাঁড়ান। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি শ্বাস নিতে নিতে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন-‘বাবা, তোমার ফোনটা একটু দেবে!’
‘কেন?’
তরুণ তিরিক্ষি মেজাজে খেঁকিয়ে উঠলো। তার হাতে সিগারেট। সে সিগারেটে পরপর দু’বার দম নিয়ে বিরক্তি ভঙ্গি করে সিগারেটটা তার সামনেই ছুঁড়ে ফেলে। পরক্ষণে দ্রত একটি বাসে উঠে বাঁদুরের মতো ঝুলে পড়ে। ফরিদ সাহেব এই অপমানও গায়ে চড়ালেন না। হতাশ ভঙ্গিতে সেদিকে অল্পবিস্তর তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন। জ্যাম এখনও ছাড়েনি। জ্যাম ছাড়ার আগেই হেঁটে হেঁটে শাহবাগ পৌঁছে যাবেন। ওখান থেকে মিরপুরের বাস ধরবেন।

ষাটোর্ধ্ব ফরিদ সাহেব হাঁটছেন না যেন দৌড়াচ্ছেন। শাহবাগ কিছুক্ষণ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোনো বাসে ঠেলাঠেলি করেও উঠতে পারেননি। বিকেল মরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার সমস্ত সোডিয়াম বাতি জ্বলে উঠেছে। তিনি উন্মাদের মতো আলো-আঁধারির ভিতর দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছেন। আসাদগেট এসে অকাস্মাৎ হোঁচট খেয়ে রাস্তার মধ্যখানে সিটকে পড়লেন। কেউ তাঁকে উঠাল না। নিজেই ওঠার চেষ্টা করলেন। পারলেন না হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন।

তাঁর হাত-পা কাঁপছে। চশমাটা উড়ে কোথায় গিয়ে পড়েছে, তার কোনো হদিস নেই। তিনি চারপাশে কয়েকবার মাছির মতো চোখ ঘুরিয়ে চশমাটা খুঁজলেন। পেলেন না। হতাশ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। পড়ে যাবার ভয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলেন। নিশ্বাস নিলেন ইচ্ছেমতো।


‘তারেক কোথায়?’
‘এই মাত্র চলে গেল বাবা। তুমি ভিতরে এসো। তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে! তোমার কাপড়চোপড়ে এত ধুলোবালু কেন?’
ফরিদ সাহেব শিরীনের কোনো কথাই যেন কর্ণপাত করলেন না। তিনি চড়া গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন-
‘তুই হারামজাদাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিস কেন! যে ছেলে নিজের স্ত্রীর খবর নেয় না, ভরণপোষন দেয় না-তাকে তুই ঘরে ঢুকাবি কেন? ওকে একদম প্রশ্রয় দিবি না! শিপ্রা অসভ্যটাকে কেন যে হ্যাঙারের মতো ঝুলিয়ে রেখেছে বুঝতে পারছি না!’
‘বাবা মাথা ঠান্ডা কর। তোমার পেসার বেড়ে যাবে!’
‘শিপ্রার বোঝা উচিৎ কি-না সেইটা বল!’
‘কি বলব বাবা! তুমি তাকে আসতে নিষেধ করে দাও।’
‘নিষেধ কী কম করেছি! বদমায়েশটা কি কোনো নিষেধ শোনে! শুনেছি ওর এলাকার কোন একটা মেয়ের সাথে নাকি আবারও নতুন করে রিলেশনে জড়িয়েছে!’
‘কথাটা বাবা আমিও শুনেছি। তারেক ভাই তো সব কথাই তুলার মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এমন ভাব করে যেন বিষয়টা কিছুই না। পুরাটাই ভিত্তিহীন।’
‘বদমায়েশটাকে মোটেও পাত্তা দিবি না। বলা যায় না কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে!’

শিরীন হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ফরিদ সাহেব বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসেন।
‘ওদের বিয়ের আগের দিনই আমার মনে কু ডাক দিয়ে উঠেছিল। বিষয়টা তখন পাত্তা না দিয়ে চরম একটা সর্বনাশ করে ফেলেছি। সেই ভুলের মাশুল এখন আমরা দিচ্ছি। শিরীন!’
‘জ্বি, বাবা।’
‘তোর কিছু হয়নি তো?’
‘না বাবা, আমার আবার কী হবে! সবসময় তুমি আমাকে এই প্রশ্নটা কেন কর! আমি একদম ঠিক আছি। তোমার ফাইলটা পেয়েছ?’
‘না রে মা, অফিস পর্যন্ত যেতে পারিনি তার আগেই মনে কু ডাক দিয়ে উঠল-তারেক এসেছে।’
শিরীন একচিলতে গাল টিপে হাসল। এই হাসি ফরিদ সাহেবের চোখে ধরা পড়ল না।
‘তারেক ভাই যে আসবে-এইটা কি তুমি আগে থেকেই জানতে! জানলে আমাকে কেন আগে জানাওনি!’

মেয়ের উপচেপড়া উচ্ছ্বাস দেখে ফরিদ সাহেব বিরক্তি ভঙ্গিতে চুপসে গেলেন। তাঁর ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেন। কোথায় কৌতূহল দেখাতে হয় সেইটাও সে জানে না! তিনি দাঁতে দাঁত পিষলেন। চড় মারতে গিয়েও মারলেন না। এটা তিনি পারবেন না। কোনোদিন পারেননি। মোক্ষম জবাবটা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

সেই মুহূর্তে শিরীন চেঁচিয়ে ওঠে-‘বাবা তুমি কি কিছু ভাবছো? আপা অফিস থেকে ফোন করেছিল। তার অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে। আসতে লেট হবে। তোমাকে একদম টেনশন করতে নিষেধ করেছে।’
‘হারামজাদা আবার ওর অফিসে গিয়ে কোনো ঝামেলা করছে কি-না কে জানে! বলেনি ও কখন আসবে?’
‘বলেছে। আপা এখুনি এসে পড়বে আর তুমি ফোনটা মনে করে নিয়ে যাবে না! আমি তোমার জন্য খুব টেনশন করছিলাম। তুমি ঘেমে তো দেখছি একদম গোসল দিয়ে উঠেছ!’
‘আর বলিস না মা! রাস্তাঘাটের যে অবস্থা। সবখানেই যানজট আর যানজট। তুই ভাবতে পারবি না, গুলিস্তান থেকে আসাদগেট পর্যন্ত আমি হেঁটে এসেছি।’
‘কী বলছ তুমি বাবা! কেন এত কষ্ট করতে গেলে? ধীরে সুস্থে এলেই তো পারতে!’
‘ওই যে মনের কু ডাক! তোর যদি বড় কোনো সর্বনাশ হয়ে যায়! এই কু ডাকের জন্যই সবকিছু আমার এলোমেলো হয়ে গেছে। আসাদগেট পড়ে গিয়ে হাঁটুর চামড়া ছিলে গেল।’
‘কোথায় দেখি! তুমি এমন কেন বাবা? যাও আগে কাপড় ছাড়ো। ফ্রেশ হয়ে নাও। কোনো রক্ত বেরোয়নি তো?’
‘না বেশি না, সামান্য একটু হাঁটুর কাছে ছিলে গেছে। স্যাভলন লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তুমি কাপড় ছাড়ো। পারলে গোসলটাও সেরে নাও। ভালো লাগবে। আমার খুব ভ্যাপসা গরম লাগছিল। গোসলটা করে নিয়েছি, এখন খুব ফ্রেশ লাগছে।’

ফরিদ সাহেব কিছুটা সন্দেহজনক ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো কপালে তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শিরীনের মুখের দিকে তাকালেন-‘ভালো করেছিস। শিপ্রা কখন আসবে বললি?’
‘আপা এক্ষুনি এসে পড়বে। তুমি বাথরুমে যাও। তোমার শরীর থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ আসছে!’
‘আচ্ছা, যাচ্ছি।’


তারেক দাঁড়িয়ে আছে শিপ্রার এগারতলা অফিস ভবনের সামনে। প্রথমে শিপ্রা তাকে খেয়াল করেনি। দ্রত ঢুকে যাচ্ছিল অফিসের ভেতরে। হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে তারেক তার গতিরোধ করে সামনে এসে দাঁড়ালো। তারেকের মুখভর্তি এক মাসের না কামানো দাড়ি। সে কালো প্যান্টের সঙ্গে মেরুন কালারের শার্ট পরেছে। শিপ্রা পরেছে মিষ্টি কালারের থ্রিপিস।
‘তুমি আবারও এসেছো! তোমাকে না আমার অফিসের সামনে আসতে নিষেধ করেছি!’

শিপ্রার ভ্রু কোঁচকানো কণ্ঠস্বরে কড়া ঝাঁঝ। তারেক এই ঝাঁঝের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই পূর্বপরিচিত। সে এসব ঠুনকাঠানকা অপমাণ গায়ে জড়ায় না। কত বড় বড় অপমান হজম করে এপর্যন্ত এসে ঠেকেছে-তার কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই।
‘আসতে তো চাইনি! কিন্তু মাঝেমধ্যে না এসেও পারি না। পকেটটার বড্ড দুর্দিন যাচ্ছে। কিছু টাকা আমাকে ধার দাও।’
‘লজ্জাশরম তো সব অনেক আগেই ধুয়েমুছে খেয়ে ফেলেছ! টাকা যেগুলো নিয়েছ সেগুলো আগে পরিশোধ কর। আর তুমি গত মঙ্গলবার আমাদের বাসায় কেন গিয়েছিলে? বাসায় তোমার কে আছে? তোমাকে না আমাদের বাসার আশেপাশেও যেতে নিষেধ করেছি!’
তারেক ব্যক্তিত্বহীনের মতো দাঁতকেলিয়ে শব্দ করে হাসে।
‘প্রয়োজনের সময় এসব নিষেধাজ্ঞা আমার মনে থাকে না!’
‘তা থাকবে কেন! তুমি তো একটা বিশ্ববেহায়া!’
কথাগুলো বলে শিপ্রা দ্রুতগিতে অফিসের দিকে পা বাড়ায়।
‘শিপ্রা, হাজার পাঁচেক হলেই চলতো!’
‘স্যরি।’
প্লিজ,শিপ্রা!

শিপ্রা দাঁড়ায় না। দ্রত লিফটে ওঠে। মুহূর্তের ভেতরে অফিসের লিফটটা তাকে গিলে ফেলে। তারেক চোয়াল শক্ত করে হতম্ভের মতো লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।


শিপ্রার ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল। আজ সে দরোজা বন্ধ করে সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। ইদানীং তার মাথা ব্যথা ভীষণ রকম বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে না গেলেই নয়। আগামীকাল সে অফিসে যাবে না। সকালেই ডাক্তারের কাছে যাবে।

ফরিদ সাহেব কিছুক্ষণ শিপ্রার দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সন্তর্পণে শিরীনের দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার দরজা খোলাই ছিলো। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে ঢুকলেন।
‘তুই এখনও ঘুমাসনি?’
‘না বাবা! আমার পড়া আছে। ঘণ্টাখানেক পড়ে তারপর ঘুমাবো। কিছু বলতে চাইলে বল?’
‘শিরীন, তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি?’
‘বাবা ভনিতা না করে তুমি কী জানতে চাচ্ছ সেইটা বল!
আমি এখন পড়তে বসবো।’
‘বলছি। আগে আমাকে এক গ্লাস পানি দে।’
‘এই নাও।’
শিরীন গ্লাসে পানি দিল। ফরিদ সাহেব যেন এক চুমুকে পানিটা শেষ করলেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপছে। গলা কাঁপছে। ভাবছেন কথাটা মেয়েটাকে তাঁর জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কি-না! কিন্তু কথাটা না বললেও নয়। জিজ্ঞেস তাকে করতেই হবে।
‘বাবা কী বলবে বল!’
‘ভাবছি কীভাবে কথাটা তোকে বলব!’
‘কোনো সিরিয়াস কথা হলে চট করে বলে ফেল। এত ভাবাভাবির কি আছে!’
‘আজ নয় অন্য কোনও দিন বলব।’
‘বাবা! তুমি কথাটা আজ এবং এক্ষুণি বলবে। কথাটা না বলতে পারলে রাতে তুমি ঘুমাতে পারবে না। অস্বস্তিতে থাকবে। আমিও পড়াশোনায় মন বসাতে পারবো না। তুমি এতো হাঁসফাঁস না করে কথাটা চট করে বলে ফেলো।’

ফরিদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্বিধা জড়ানো গলায় বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস। কথাটা তোকে বলা দরকার। কদিন ধরে ভাবছি তোকে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু তা পারছি কই! নিজের ভিতরেই ঘুরপাক খাচ্ছি।’

শিরীনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে-‘তোমাকে একটু সহজ করে দিই বাবা!’
‘দে মা।’
‘তুমি কি কোনো বিয়েশাদি করতে চাচ্ছ বাবা?’
‘না রে মা, ওসব কিছু না।’
‘তাহলে?’
‘তুই কী মা হতে যাচ্ছিস?’
কথাটা শুনে শিরীন প্রচণ্ড রকম চেঁচিয়ে ওঠে-‘বাবা! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আমার তো এখনও বিয়েই হয়নি। মাত্র ইন্টার শেষ করলাম। আমি কীভাবে মা হবো?’
‘তা ঠিক। দোষটা আমার না।’
‘তাহলে কার?’
‘আমার মনের।’
‘তুমি আর তোমার মন কি আলাদা কিছু?’
‘না, তা না।’
‘তাহলে?’
‘সব মনের কু ডাক রে মা।’
‘আপার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর। তারই এখনও কোনো বাচ্চাকাচ্চা হলো না অথচ আমি একটা আনমেরিট মেয়ে-তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো আমি মা হচ্ছি কি-না!’
‘স্যরি মা।’
‘বাবা, তুমি আমার রুম থেকে যাও বলছি! মা মরে যাবার পর যেটুকু ছিলো- এখন রিটায়ার্ড করে তোমার মাথার পুরাটা-ই গেছে।’
অপমানে ফরিদ সাহেবের চোখের কোনায় অশ্রু জমলো। তিনি চোখ মুছতে মুছতে শিরীনের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শিরীন মুখে ওড়না চেপে কাঁদতে কাঁদতে দরজা বন্ধ করল।


পেনশনের টাকাটা হাতে আসতে ফরিদ সাহেবের হয়ত আরও তিন মাস লেগে যাবে। এটা নিয়ে আপাতত তাঁর কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি ভাবছেন শিরীনকে নিয়ে। শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ তাঁর মনে একটা কু ডাক দিয়ে উঠল। মেয়েটাকে একবার ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু শিরীন কি যাবে! যেতে না চাইলেও তিনি তাকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবেন। তার মনের কু ডাক কখনও মিথ্যা হয়নি। তবুও তিনি চাইছেন অন্তত তাঁর এই একটি কু ডাক যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

রিপোর্ট নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেরুল শিরীন। তার পা চলছে না। পা দুটো ভীষণ ভারি লাগছে। সে কিছুতেই বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। এক প্রকার জোর করে বাবা তাকে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে। কোনোক্রমেই সে আসতে চায়নি। আসতে সে বাধ্য হয়েছে। শুধুমাত্র তার বাবার জন্য। বাবার মন থেকে কু ডাকটা সরানোর জন্য। এসে এখন নিজেই ফেঁসে গেল। রিপোর্ট এসেছে পজিটিভ। বাবাকে সে এখন কি জবাব দেবে! তারেক বলেছে-‘কোনো ভয় নেই। আমি কখনও জনক হবো না। আমার বীর্যেও কেউ কোনোদিন মা হবে না। হলে এতদিনে শিপ্রা তিন বাচ্চার মা হয়ে যেত। আমি হতাম বাবা।’

কথাগুলি ভাবতেই শিরীন ক্লিনিকের সামনের রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ফরিদ সাহেব তাকে টেনে একটি সিএনজিতে উঠালেন। মধ্যাহ্নের রোদ তখন দারুণভাবে তেতে উঠেছে। তিনি প্রচণ্ড রকম ঘামছেন।

অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ