কখনো ভোরের স্বপ্ন ॥ রোকেয়া ইসলাম


অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ

শিউলির কথাগুলো শুনে শিউরে উঠে অরণি। দু-হাত টেবিলে রেখে হাতের তালু দিয়ে মাথা চেপে ধরে অরণি। ওর সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে উঠে। কি করে বেঁচে আছে শিউলি। এত ঘৃণা এত ক্ষোভ যন্ত্রণা ওর বুকের ভেতর। অথচ প্রথম দেখাতেই শিউলিকে শান্ত ধীর স্থির মনে হয়েছে।কত হবে ওর বয়স আবেদন পত্রে তো কুড়ি বছর লেখা। অরণি মনে মনে আরও দুই যোগ করে নেয়। ওর এই বাইশ বছর বয়সে এত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ভেতরে অগ্নিকুণ্ড রেখে উপরটা পুরাই বরফের চাই।

অরণি একটা গ্রুপ অফ কোম্পানির চেয়ারম্যান। প্রতিদিন অফিসে আসে না। বোর্ড মিটিং ছাড়া সপ্তাহে তিন চারদিন তাও সেকেন্ড হাফে। শিউলির ডিউটি অন্য জায়গায়। আর চেয়ারম্যান ম্যাডাম এলে তার ধারে কাছে থাকা। গত দু-মাস থেকে কাজ করছে এই অফিসে। আগের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। একেবারে ফ্রেস। এত ছোট পদের নিয়োগ চেয়ারম্যান ম্যাডামের হাত দিতে হয় না।
অরণি প্রথমদিন গজগজ করছিল ভেতরে ভেতরে। একেবারে নতুন একে কাজ শেখাতেই তো তিন মাস লেগে যাবে।
অরণি অবাক হয়ে খেয়াল করে খুব অল্প সময়েই নিখুঁত পরিপাটি করে কাজ করে শিউলি। কখন অরণির পানির প্রয়োজন। পানির গ্লাসে কয় টুকরো বরফ ফেলতে হবে চায়ের কাপে ক-ফোঁটা লেবুর রস ফেলতে হবে সব জানা হয়ে গেছে শিউলির।

কয়েকদিনেই অরণির মন জয় করে নিয়েছে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু ব্যক্তিগত বিষয় জানা হয়।
-তুমি কি একাই থাক ঢাকায়?
-হ্যা ম্যাডাম। এক ফ্যামেলির লগে সাবলেট থাকি।
-বাড়িতে কে কে আছে?
-কেউই নাই আবার আছেও।
এমন হেঁয়ালি ধরনের উত্তর অবণির চেনা শিউলির কাছ থেকে আশা করেনি।

অরণি একটু কাছে ডেকে কথা বলেছে অমনি মাথায় উঠে নাচতে শুরু করলো কিনা কে জানে।
ফাইলেই চোখ নিবন্ধ রেখেই বলে
-এ কথার মানে কি?
অরণির মৃদু কণ্ঠস্বরেও কঠিন কিছু ছিল সেটা বুঝতে পারে শিউলি।
– ম্যাডাম মাফ কইরা দেন ভুুল হইলে। আমি কইলাম সত্য কথাই কইলাম।
অরণি ফাইল থেকে চোখ সরায় না। শিউলি এই ফাঁকে লেবুর রসের ফোঁটা গুণে এক কাপ চা সামনে রাখে।
লেবুর মনোহরি গন্ধে চায়ের কাপে চোখ রাখে। মিহি ধোয়া ধ্রুপদী নাচের ভঙ্গিতে উপরে উঠে মিলিয়ে যায়।
মেয়েটা সত্যি কাজের অজান্তেই মনের কথা বুঝতে পারে।
-কি বললে তখন কেউ আছে নাকি নেই।
দু-পা এগিয়ে আসে শিউলি।
-বেয়াদবি নিয়েন না কইছি আছেও আবার নাইও।

একটু থামে। ঘরে এসি চলছে। এসির বিজবিজ শব্দ আর দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছু নাইও।
-কিছু বলতে চাও আমাকে?
আঙুলে ওড়না জড়াতে জড়াতে নিঃশব্দে দু-পা এগিয়েছে শিউলি।
-আপনের কাজের ক্ষতি হইব না তো।
বেশ ভদ্রতাও জানে তো মেয়েটা। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে।
দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকায়, ঘণ্টাখানিক সময় তো আজ ঠান্ডা ঘরের চার দেয়ালে ঘুরতে দিতেই পারে। ঘুরুক সময় তার মতো। অরণি থাকুক শিউলির আছে আবার নাই এর গোলক ধাধায়।

-আমার পাঁচ বছর আর আমার ছোট ভাইয়ের তিন বছর বয়স তহন আমাগো পানিতে ভাসাইয়া বাপে মইরা গেল।
দাদায় বংশের বাতি দেওনের লিগা ছোট ভাইকে রাইখা আকাইম্যা আমাগো মায় – ঝি রে খেদাইয়া দিল। বুইড়া নানা নানীর সংসারের চাবি মামীর শক্ত হাতের মুঠায়। দুইদিন কাইন্দা কাইটা ভালোই মমতায় থাকলাম।
মামার রিকশা চালাইয়া কতই আর আয় করে।টানাটানি সংসারে বিবেক আর মমতা থাকে না ম্যাডাম ।
লাত্থি-গুতা খাইয়া মাটি কামড়াইয়া একটা বছর টিকা আছিলাম মা আর ম্যায়া ।

মামায় মায়েরে বিয়া দিল এক কুইঠ্ঠাল ধনী ব্যাডার লগে। ব্যাডার আগের দুই বউর একজন বিয়ার পরপর আরেক ব্যাডার হাত ধইরা পলাইয়া গেছে। পরের বউ সংসার করছে দুই পোলার জন্মও দিছে।

বড় বড় পোলা বড় সংসার, সংসারে ম্যালা কাজ কাম। বউ নাই আবার ব্যাডারও বিয়ার বয়স আছে।
মামা সব দেইখ্খা মায়ের বিয়ার ব্যবস্থা করে। হ্যায় এক্কু ঢিলে তিনটা পাখি মারে। ধনী বাড়িতে বৈনের বিয়া হইলে বুইড়া বাপ-মায়ের খরচা পাওয়া যাইব। আর নগদে লাভ আমারে মায়ের লগে দিয়া দেওন যাইব।
মামার মাথায় পাক্কা বুদ্ধি আছে। বিয়ার সুময় ব্যাডারে শর্ত দেয় বৈনেরে তিনখান সুনার গয়না দেওন লাগব আর চাইর বিঘা জমি লেইক্খা দেওন লাগব।
শুইনা নানা নানি খুশি হইলো। বিয়ার দিন আমার মায়ের স্বামী কইলো তাড়াহুড়া কইরা বিয়ার দিন ঠিক হইছে তাই গয়না আনবার পারে নাই। দুই একদিন পরে গয়না বানাইয়া দিবনে। মামারে লইয়া গিয়া জমি রেজেস্টি কইরা দিব। বিয়ার দিন মামায় আমারে লগে দিয়া দেয় নাই। দশ পনেরদিন পরে ম্যায়া মায়েরে ছাড়া খালি কান্দে অজুহাতে আমারে থুইয়া আইলো।
আসোনের কালে আমার মায়ের স্বামী পকেট থিকা কিছু ট্যাকা বাইর কইরা মামারে দিয়া কইলো- বুইড়া বাপমায়ের পরতি আপনের যেরহম করতব্ব তেমুন মাইয়ারও আছে। মাঝেমইদ্দে আইসা খরচা বাবদ কিছু নিয়া যাইয়েন।
আরও দিলো এক বস্তা ধান।
মায়ে আর মামাতো খুশিতে আটখান।

আমার লিগা মায়ের ঘরের লগে ঘরের ভিতর দিয়া বরাবর টিন দিয়া বেড়া দিয়া ঘর কইরা দিল। দরজা দিয়া বারান্দায় বাইর হওয়া যায়।
স্কুলে ভর্তি কইরা দিল। নতুন কাপড় চোপর বানাইয়া দিলো।
এই বাড়িতে ম্যালা কাম আমার মায় হারাদিন কাম করে। লগে লগে আমিও কাম করি। দুইজন কামের মানুষ সকালে আহে বিকালে যায়। এত কাম করন লাগে তাতেও মায়ের মন খারাপ হয় না খুশিতে খুশিতে নাচতে নাচতে নিজের সংসারে কাম করে।

আমি নাইনে উঠলাম।
শিউলি একটানে প্রচুর কথা বলে ফেলেছে। গলা তো শুকাবারই কথা। বাইরে যায়। অরণির চায়ের কাপের চা তলানিতে ঠেকেছে। এসির শব্দ আর ঘড়ির আওয়াজ মিলে সংগীতের মোহন আয়োজন ভালো লাগছে।
শিউলি এর মধ্যে ওর জীবনের তিনটে তিনটা পর্ব শেষ করে ফেলেছে।
অরণি ঘড়ির দিকে তাকায় খুব বেশি সময় নেয়নি।

এখনো বুঝতে পারছে না “আছেও আবার কেউ নাইও” কোথায় গিয়ে ঠেকবে।
শিউলি বোধহয় ওয়াশ রু্মে গিয়েছিল। বেশ ফ্রেশ লাগছে ওকে।
-ম্যাডাম বাসায় যাবেন না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বলে
-না বল বাকিটুকু শুনি।
-আমার মায় যদি ব্যাডার কাছে গয়না চায় ব্যাডায় কয় মাইয়া মাইনসের গয়না হইলো স্বামী। জমি দেওনের কতা কইলে কয় মইরা দুই আানী অংশ পাবি
অরণি এই বিষয়গুলো জানে। কতভাবেই না মেয়েদের ঠকানো হয়। মানসিক নির্যাতনের কথা কেউ স্বীকার করে না। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত সমান সমান এ বিষয়ে।
-আমি বুঝতে পারলাম না আমি বড় হইছি কিনা আমার মায়ের স্বামী আমার সাজোনের লিগা ছুনু পাউডার লেপেস্টিক লেন পলিশ আরো কত কি লইয়া আমার মায়ের হাতে দেয়। সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পাইয়া আমার মায়ে যে কি খুশি। আমিও খুশি। জীবনেও আসল বাপ বাইচ্চা থাকলে এত কিছু একলগে পাইতাম না।
একদিন রাইতে ঘুমাইয়া পড়ছি। মাায় জানি কেমনে টের পাইচে তার বুইড়া স্বামী আমার ঘরে হান্দাইছে।
আমি তো ব্যাডার মুখ আর হাত সামলাইতে সামলাইতে শুনি মায় জোরে জোরে দরজা ধাক্কইতাছে আর চিক্কুরইর পারতাছে।
ব্যাডা মায়ের ধাক্কানিরতে দরজা খুইল্লা দ্যাহে হ্যার বড় পুলা খাড়াইয়া আছে দরজার বোগলে।

মায়ের হাত ধইরা টাইন্যা ঘরে নিয়া গিয়া দরজা আাঁটকাইয়া গুম্মুর গুম্মুর কিল দেয়।
মায়ের চিল্লাচিল্লিতে কামের কাম কিছুই হইলো না। মইদ্দে থিকা ব্যাডার বড় পোলার কপাল খুল্লো।
পোলায় দুইদিন আইলে বাপে একদিন আমার ঘরে হান্দায়।
আমার মায়ে রাইতে কাটা মুরগির মতো দাপড়াইতো।
এই দোজকে থাইকা কলেজে ভর্তি হইলাম।

ব্যাডা ধুমধাম কইরা পুলারে বিয়া করাইলো। আমি মনে মনে কইলাম প্রতিযোগি কমাইলো। আর বাপে পুলায় এক ম্যায়ালুক নিয়া মৌজ করতেও তো শরমায়।
ততদিনে ছোটপুলা লায়েক হইয়া গেছে।
একদিন আমার মামাতো ভাই সুজন বেড়াইতে আইলে হ্যারে চাকরির কতা কই।
ততদিনে পুরুষের চোখ চিনা হইয়া গেছে আমার।
কেমনে কইরা হে এই চাকরির সন্ধান দিল। লগে নিয়া আইসা ইন্টারভু দেওয়াইলো।
চাকরি হইলো। এক ফেমেলির লগে একটা রুম লইয়া থাকি।
সুজনের লগে কতা হইছে বিয়া করুম না। বাড়িতে তারো বউ পোলামাইয়া আছে। মাসে একবার আসে।
সারাদিন এহানে ওহানে ঘুইরা বেড়াই স্বামী স্ত্রীর মতো। মাসের বাজার কইরা লই একবারে। বেকেই জানে সুজন আমার স্বামী। স্বামী না হইলে তো বাসা ভাড়া পাওন যায় না।
পাশের ঘরের ব্যাডার চোখটাও দইম্যা থাকে সুজনেরে দেইখ্খা।
দুই হাতের তালু থেকে মুখটা তোলে। আর নিতে পারছে না অরণি। হাত দিয়ে ওকে থামায়।

সারাটা রাত শিউলি অরণিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘুম হয় না একেবারে। এত অল্প বয়সের একটা মেয়ে! সারাটা জীবন সামনে পড়ে আছে।
আকাশে তাকায় অরণি। নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে ভেসে নিজেকে নানাভাবে রুপ দিচ্ছে। হাতী হচ্ছে পালটে ফেলছে শূর। ছোট হয়ে খৈ ফোটাচ্ছ আকাশজুড়ে। মন্থর মেঘ আকাশজুড়ে।

খৈ এর গুঁড়ো গুঁড়ো মেঘময় আকাশে মন নেই আজ অরণির
হঠাৎ ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন দেয় শিউলিকে। শিউলি ফোনটা ধরার আগেই কেটে দেয় অরণি।
আরে ও নিজেও তো সেদিন শিউলির মা যে ভুল করেছে আজ সেই ভুলটা করতে যাচ্ছিল।

পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের এপাশ আর ওপাশ ঘর ওদের। শিউলি যা ঢেকে রেখে নিরাপদে চলছে। আজ অরণির সাথে কথা বলতে গিয়ে, তার অনেকটাই উন্মোচিত হয়ে যাবে। বিপণ্ন হবে ওর আজকের গোছানো বসবাস।
অরণির ফোন বেজে ওঠে। শিউলির নম্বর জ্বলছে নিভছে জ্বলছে। রিঙ থেমে যেতেই অরণি কল করে
খুশিতে গলগলে কণ্ঠ ওর। সালাম দিয়ে ফোন না ধরার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো। ঘরের কাজ করছে তাই ফোন ধরতে পারেনি। বিনয়ের সাথে জানতে চায় কেন ফোন করেছিলেন ম্যাডাম।
-ভুলে চলে গেছে।
-আমার সৌভাগ্য।
-ঠিক আছে এখন কাজ কর। রাখি।

শিউলির সাথে কি ওর সম্পর্কটা একটু সহজ হয়ে গেল।
হোক না সহজ, অরণি জানে কিভাবে সহজ সম্পর্কের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখতে হয় ।

অরণির মগজে খোঁচাতে শিউলির যাপিত জীবন। একা লড়াই করে যাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে? প্রশ্ন মনে হতেই শিউরে উঠে অরণি।
সমাজে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে! কি শক্তি ওর?
আসলে প্রতিপক্ষ যতই ঠেলে দিয়েছে ওকে, ও ততই শক্তি অর্জন করেছে, মহাশক্তিধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠার।
কিছু প্রশ্ন ওকে করতে হবে ফিরিয়ে আনতে হবে সমাজে।
অফিসে ওর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে না। ওর নিজের বাসায় তো নয়ই।

আজ ওরা এসেছে শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা এক নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে।
শিউলি এমন রেস্টুরেন্টে জীবনে প্রথম। কিন্তু এখানেও ওর সাথে সাধারণ কথা ছাড়া অন্যকথা বলতে বাঁধো বাঁধো ঠেকছে।
পূর্বাঞ্চলের ওদিকে প্রচুর খালি জায়গা পড়ে আছে এমন একটা জায়গা বেছে নেয় অরণি।
অফুরন্ত নীল আকাশ নিবিড় বয়ে চলা বাতাস অনেক সবুজ তবুও অভিমানী মনে হলো এই সবুজকে।
অরণি চারপাশে চোখ বুলাতেই বুঝতে পারে নতুন এই স্যাটেলাইট শহরের জন্য সীমাহীন সংখ্যার গাছ আত্মাহুতি দিয়েছে।
একটা বোধ ওর ভেতরে জেগে ওঠেছে। এখানে দাঁড়িয়ে অরণি আর শিউলি ফাঁরাক খুঁজে পায় না। তবুও অদৃশ্য দেয়াল থাকলো।
ছুটির দিন রাজধানীর গুমোট আবহাওয়া থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে ছুটে এসেছে অনেক মানুষ।
নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পায় না অরণি।
শিউলি বুঝতে পারে অরণির অবস্থা।
-ম্যাডাম পৃথিবীতে গোপন জায়গা নাই। খালি মানুষ আর মানুষ। লন কুনু জায়গায় বসি।
বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়ায় দুজন।
শিউলি ওর ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাপড় বের করে বিছিয়ে দেয়। অরণি ওর ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে তার ওপর বিছায়।
শিউলি দূরত্ব বজায় রেখে থপ করে মাটিতে বসে পড়ে।
-তুমি সুজনকে বিয়ে কর।
কোনরকম ভূমিকা না করেই অরণি বলে ফেলে।
শিউলি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অরণিকে এখন আর বস মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর অভিভাবক। অরণিরও শিউলিকে অধস্তন কেউ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর কাছের কেউ। বান্ধবীর ছোট বোন।
-না সেইডা কোনদিন হইব না।
-তুমি সমাজ মানবে না।
-সমাজ! সেইডা কি ম্যাডাম। আর আপনেগো সমাজে আর কুনু শিউলি আর শিউলির মা য্যান না জন্মায় সেই লেইগাই আমি একলা ভালাে আছি।
-এটা কোন সমাধান হলো না।
-তাইলে দিক আপনেগো সমাজ আমারে ফাঁসি। তাও আমি আর কুনু শিউলিরে আইতে দিমু না।
উঠে পড়ে শিউলি।
-ম্যাডাম আপনেগো সমাজ আমাগো কথা ভাবে না। আমার মতো হাজার হাজার শিউলি সমাজের কাছে গেছি। সমাজ তো আমার মায়ের স্বামীর লিগা তার পোলার লিগা। আমাগো লিগা আমরাই আছি।

উঠে পড়ে দুজন। সারাটা পথ কেউ কারো মুখের দিকে তাকায় না।
যে যে যার যার ভাবনায় মশগুল থাকে।
শিউলি ভাবছে কেন ম্যাডামকে এতগুলা কথা খুলে বলতে গেলো। এতটা বয়স হলো এত লাত্থিগুতা খেল তবুও ওর শিক্ষা হলো না কেন। মিছেমিছি চাকরি হারালো। এতকিছু জানার পর ম্যাডাম হয়তো ওকে চাকরিতে রাখবে না।

অরণি ভাবছে কেন এতগুলো কথা শুনতে গেলো শিউলির কাছ থেকে। অফিসে যদি কোনদিন জানাজানি হয়ে যায় আর যদি কোনভাবে প্রকাশ পায় অরণি বিষয়টি আগেই জানতো তাহলে তো মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
অরণির এতদিনের সম্মান পজেশন টলে উঠবে।
কি করবে অরণি। শিউলির মত কর্মচারীর চাকরি নাকচ করা অরণির জন্য কোন বিষয় নয়। অ্যাডমিনে জানিয়ে দিলেই হবে।
আজ রাতে না জানিয়ে কাল সকালে জানালেই হবে।
শিউলিকে ওর বাড়ির কাছাকাছি কোন একটা গলির মুখ থেকে তুলেছিল। ড্রাইভার সেখানে এসে গাড়ি থামায়। গাড়ি থেকে নেমে পড়ে শিউলি।
অরণির সিটের কাছাকাছি এসে উইন্ডোর কাঁচে টুকটুক শব্দ তোলে
দরজা খুলে দিতেই সালাম করে অরণিকে।
-ম্যাডাম কুনু ভুল হইলে মাফ কইরা দিয়েন। আর তো কুনুদিন দেহা হইব না।
-কাল অফিসে যেতে হবে তো তোমাকে। এখন যাও তাড়াতাড়ি।
শিউলি তাকায় অরণির চোখের দিকে। সবুজ পান্নার দ্যূতি নিয়ে জ্বলছে একজোড়া চোখ।ল্যাম্পপোস্টের আলো উইন্ডো দিয়ে ভেতর ঢুকে ম্যাডামের চোখজোড়াকে আশ্বাসের ফল্গুধারা বইয়ে দিচ্ছে…
হালকা বাতাসে চুল উড়ছে শিউলির। এলোমেলো চুলগুলো এসে মুখের উপর পড়ছে। ওকে এতক্ষণের ঘাড় উঁচিয়ে থাকা লউয়ের ডগার মতো উদ্ধত মনে হচ্ছে না অরণির। নমনীয় লাগছে।
তবুও দুজনের ভেতর সুক্ষ্ম কাঁটার মতো সমাজ বিঁধে থাকলো অদৃশ্য শক্তি নিয়ে….।

অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ