যেকোনো ভাষা থেকে অন্য কোনো ভাষায় কোনো লেখাকে অনুবাদ করলে মনে হয় এ আর এমন কি ব্যাপার। খুবই সহজসাধ্য কাজ। শুধু ভাষাটা জানা প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টা আদপেই তা নয়। যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং মেধাসাধ্য ব্যাপার। ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন এবং ট্রান্সলিটারেশন বলে দুটো শব্দ আছে। এই ট্রান্সলেশন বা ভাবানুবাদই হচ্ছে বকলমে অনুবাদ সাহিত্য।
বিতস্তা ঘোষালের মালয়ালাম লেখিকা কমলা দাসের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই স্টোরি’র অনুবাদ বইটি এত পিচ্ছিল গতিতে পড়েছি যে একবারও মনে হয়নি আমি কোনো অনুবাদ সাহিত্য পড়ছি। আর এখানেই অনুবাদের সবকটি গুণমান একশোয় একশো পেয়ে গেছে। পড়া শেষ করেও কতগুলো অধ্যায়, কিছুকিছু লাইন ফের পড়লাম। বলা যেতে পারে পড়তে বাধ্য হলাম। মূল লেখা থেকে অনুবাদ যদি এমন সহজ, স্বাভাবিক, সাবলীলভাবে না হত তাহলে পড়া শেষ করার পরেই আবার পড়তে ইচ্ছে করতো না। ধন্যবাদ বিতস্তা ঘোষালকে এই অসাধারণ কাজটি করার জন্য। এই অনুবাদ সাহিত্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা পাঠক কমলা দাসের সঙ্গে তাকেও মনে রাখবে।
২৭টি পরিচ্ছেদে এ বইটি রচিত। প্রতিটি পরিচ্ছেদই খুব বড় নয়। কিন্তু প্রতিটি পরিচ্ছেদেই সেই সময়কার কমলা দাসের অন্তর এবং বাহ্যিক পরিস্থিতিকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘মৃত্যুর বাসনা’ নামক পরিচ্ছেদটি শেষের দুটো পরিচ্ছেদের আগে। কিন্তু সেখানেই শুরু হয় যেন বাঁচবার দুরন্ত ইচ্ছা।
“এই সময়ে আমার স্বামী আবার তাঁর পুরনো বন্ধুর কাছে ফিরে গেলেন। তাঁরা আমার সামনেই প্রেমিক-প্রেমিকার মতো আচরণ করতো। আমার জন্মদিনের দিন তাঁরা আমাকে বেডরুমের বাইরে বের করে দিয়ে নিজেরা সেখানে ঢুকে গেলেন”।
এর পর তিনি লিখছেন-
“এক মুহূর্তের জন্য আমার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল…। ঘরে ফিরলাম সেই নোংরা সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে। বসার ঘরে আলো জ্বালিয়ে আমি লিখতে বসলাম। আমার নিশ্চিত জীবন, এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের লেখা।
Wipe out the paints, unmould the clay.
Let nothing remain of that yesterday….
আমি কবিতা লেখা শেষ করে পরদিন সকালে পাঠিয়ে দিলাম ভারতীয় জার্নাল P.E.N.-এ। আমার মুঠো দিয়ে যেন মধু ঝরছিল সাদা পাতায়। সব দুঃখ উড়ে গেল”।
আবার একদম প্রথম পরিচ্ছেদে “রুল ব্রিটানিয়া” নামে উল্লেখ করেছেন যেটা সেখানে দেখতে পাই আমাদের দেশ তখন পরাধীন। কিন্তু নিজেদের আত্মগরিমাকে বজায় রাখতে কমলা দাসের পিতা ভি.এম.নায়ার তাঁকে এবং তাঁর দাদাকে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছিলেন যা তাঁর কোনদিনই ভালো লাগতো না। তাঁদের মাও ছিলেন স্বতন্ত্র একজন মানুষ। লেখিকার কথায় –
“বেশিরভাগ সময়ই তিনি তাঁর বড় খাটে শুয়ে মালয়ালাম ভাষায় কবিতা লিখতেন…। রাঁধুনি আমাদের বাড়ির খানিকটা দূরের একটা স্কুলে দিয়ে আসত। আবার দুপুরে গিয়ে নিয়ে আসত। কারও মধ্যে কোনো স্নেহ মায়া মমতা ছিল না। আমরা তাই অযত্নেই বেড়ে উঠেছিলাম”।
স্কুলে যখন উচ্চ পদে কোনো পরিদর্শকরা আসতেন ভারতীয় শিশুদের কালো চামড়ার বলে লুকিয়ে রাখা হতো। কখনও কার্পেটের পেছনে, কখনও বাথরুমের পাশের করিডোরে। এমনকি কমলা দাসের লেখা কবিতা এক ইংরেজ সহপাঠী শিশুকে দিয়ে আবৃত্তি করিয়ে প্রিন্সিপাল সহজেই বলে দেন “এটি শার্লিই লিখেছে”।
‘নালাপথ হাউজ’-এর বিশাল বাড়িতে অদ্ভুত সব বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে কমলা দাসের জীবন বেড়ে উঠেছে। কদর্য যৌনতা, আভিজাত্য বজায় রাখা, এমনকি বাড়ির ভেতরে মৃতদেহ দাহ করা তাঁকে যথেষ্ট ব্যথিত করে তুলত। মানুষের মাংস, চামড়া পোড়ার কটু গন্ধ দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসে চলাফেরা করত। তিনি অন্ধকারকে ভয় পেতেন। তাই প্রতিদিন আলো জ্বালিয়ে শুতেন। তিনি নিজে জানতেন সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা তিনি ছিলেন না। এ ব্যাপারে তাঁর বাড়ির লোকেরা তাঁকে আরও সদর্থক করে তুলেছিলেন।
এমনকি তাঁর সামনের উঁচু দাঁতগুলোকে ডাক্তার দিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। লেডিস হোস্টেলে থাকতে গিয়ে এক বান্ধবীর সঙ্গে শারীরিক, মানসিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সেসময়টা খুব কম সময়ের জন্য হলেও ভালো ছিলেন। কিন্তু অদ্ভুত এক নিরাপত্তাহীনতা চিরকাল তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাঁর নিজের কথাতেই
“এটা আর সকলের মতো একটা পরিপূর্ণ পরিবার নয়…। কেউই আমার ভার নিতে চান না”।
পারিবারিক মর্যাদা বজায় রাখতে তাঁর থেকে অনেক বয়সে বড় এক অমার্জিত, নিষ্ঠুর লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল যখন তিনি খুবই ছোট। তাঁর স্বামী বাচ্চা মেয়েটির শরীর ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। দিনের পর দিন পশুর মতো আচরণ তাঁকে মনে মনে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। মানসিকভাবে এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছিলেন তাঁর সেই বান্ধবীকে ফোন করে ডেকে বলেছিলেন, “তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পার না?” তারপরে অবশ্য খুব অল্প বয়সেই এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় তাঁর। যাকে কমলার মনে হত কবি বায়রনের মতো দেখতে। ছোট্ট পুতুলটাকে নিয়ে অনেকদিন ভালো ছিলেন। কিন্তু শাশুড়ির জিম্মায় তাঁকে ফেলে রাখায় জীবনের সমস্ত তিক্ততা আবার তাঁকে ঘিরে ধরে। ঈশ্বর বিশ্বাসী, কৃষ্ণ অনুরাগী কমলাকে অনেক বার তাঁর ইষ্টের স্মরণাপন্ন হতে দেখেছি তাঁর লেখার মধ্যে।
১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করে ২০০৯ সালে ৭৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কমলা দাস। তিন সন্তান জন্ম দেওয়ার সঙ্গে জীবনে বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। এমনকি নোবেল প্রাইজের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। বহুভাবে বিতর্কিত ছিল তাঁর জীবন। তাঁর জীবনের সবথেকে চমকপ্রদ ঘটনা ১৯৯৯ সালে ৬৫ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘কমলা সুরাইয়া’ নাম নিয়ে মুসলিম লীগ এম.পি. ৩৮ বছর বয়সী সাদিক আলিকে এক মাসের প্রণয়ে বিবাহ করা। তাঁর সোজাসাপটা লেখার মতো বেঁচে থাকাও তাঁকে তুলনা করা হয় ফরাসি লেখিকা মার্গারিট ডিউরাস ও আমেরিকান কবি কথাশিল্পী সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে। ‘মাই স্টোরি’ প্রকাশ নিয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তবুও তাঁর কলমকে কেউ থামাতে পারে নি। আর এখানেই “Pen is mighter than sword”.
মাই স্টোরি
মূল রচনা: কমলা দাস
অনুবাদ: বিতস্তা ঘোষাল
প্রকাশনা: ভাষা সংসদ।
দাম: ২০০ টাকা।