মনীষী শামসুজ্জামান খানের প্রয়াণ: আমার প্রাথমিক অনুভূতি ॥ মাসরুর আরেফিন


[ সম্পাদকীয় নোট: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বুধবার (১৪ এপ্রিল ২০২১) প্রয়াত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি, সাবেক মহাপরিচালক লেখক, গবেষক, ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাসরুর আরেফিনের এই লেখাটি যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের]

চলে গেলেন শামসুজ্জামান খান। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় মাত্র বছর দেড়েকের। তিনি আমার উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ পড়লেন এবং তারপরই আমার এক বন্ধু মারফত আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমার দুই উপন্যাসই তিনি পড়েছেন—‘আগস্ট আবছায়া’ ও ‘আলথুসার’; এবং দুটো বই নিয়েই তাঁর মধ্যে অসম্ভব মুগ্ধতা ছিল।

গত বছর অক্টোবর মাসে আমার জন্মদিনে আমার লেখালেখি বিষয়ে তাঁর উচ্চপ্রশংসাভরা এক রচনা এ জীবনে আমার পাওয়া সবচাইতে বড় কমপ্লিমেন্টের একটা ছিল। কিন্তু আমার এ লেখা আমাকে নিয়ে না। তাকে নিয়ে।

আমি গত দেড় বছরে তাঁর লেখা অনেক প্রবন্ধ পড়েছি। তিনি আমাকে তাঁর অনেকগুলো বই উপহার দিয়েছেন। আগেও যে তার দু-দশটা লেখা আমার জানা ও পড়া ছিল না, তা না। কিন্তু এই নতুন করে তাকে পড়ার মধ্যে দিয়ে জানলাম যে, আইডেন্টিটি পলিটিক্সের এ রক্তাক্ত সময়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ব্যাখ্যাটা দেবার জন্য তাঁর মতো অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন মনীষী আমাদের এই কালে আর একজনও ছিলেন না। শামসুজ্জামান খানের কারণেই আমি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্রকে নতুন চোখে দেখতে শিখেছি। সেটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ এক লেখা আজই লিখতে শুরু করলাম।

আবার জয়া চ্যাটার্জির ‘বাঙলা ভাগ হল’ বইটা নিয়ে আজ থেকে মাত্র পাঁচ শুক্রবার আগে স্যারের সঙ্গে ফোনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কথা হল আমার—না, বলা উচিত বাদানুবাদই হয়ে গেল। ওই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় ‘হিন্দু ঐক্য ও মুসলমান স্বেচ্ছাচার’ নিয়ে স্যার আমাকে যা-যা বললেন তা অনেকের পায়ের তলা থেকে হয় মাটি সরিয়ে নেবে, না হয় ঘুম থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগাবে। মোটামুটি একই সময়ে স্যারই আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা পেপার ‘হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা‘। আমি পড়া শেষে দু-দিন পরেই স্যারকে ফোন করলে তিনি বললেন, ‘লেখার মধ্যে দুটো ঐতিহাসিক ভুল আছে, মাসরুর। বলতে পারলে বুঝবো মন দিয়ে পড়েছো।’ আমি বলতে পেরেছিলাম, স্যার খুশি ও বিস্মিত হয়েছিলেন। জয়া ও শাস্ত্রীর এই দুটি বিষয় ভাব ও তাৎপর্যের দিক থেকে একই ছিল। এটা নিয়েও পূর্ণাঙ্গ লেখা আমাকে লিখতেই হবে।

শামসুজ্জামান খান আমার কাছে সবচাইতে শ্রদ্ধার্হ্য তাঁর বাংলার রাজনীতিতে গ্রামের অভ্যুদ়য় নিয়ে নিজস্ব ধরনের অভিজ্ঞানের জন্য। তাছাড়া মফস্বলের সংস্কৃতি, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ, ভদ্রলোকের চোখে এই দেশ, ছোটলোকের চোখে এই বাঙালি হওয়ার স্বরূপ, কেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়, কেন এই পারস্পরিক ধর্মভিত্তিক ঘৃণা, লর্ড কার্জন তাঁর বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে কী দাঁড়াত ভারতীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেহারাটা, আর রামমোহন, আর কেশবচন্দ্র আর রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক সমন্বয়বাদ বোঝার সঙ্গে মুসলিম রাজনৈতিক চেতনাকে বোঝার ব্যাপারটা কীভাবে জড়িত, কীভাবে শরৎচন্দ্র ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষের লোক ছিলেন আর সেটা ঠিক কী প্রভাব ফেলেছিল হিন্দু মধ্যবিত্ত মানসিকতায়, এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পুনর্মূল্যায়নটা আমরা কীভাবে করব, ঠিক তাঁর কোন্ কোন্ লেখা ধরে কাজটা শুরু করব—প্রথমে এসব প্রশ্নকে জানবার এবং পরে তার প্রতিটারই সবচাইতে স্বচ্ছ উত্তর হাজির করবার বিষয়ে আমার কাছে প্রায় শেষ-কথা ছিলেন শামসুজ্জামান খান।

কিন্তু তার চাইতেও বড় আমার কাছে তিনি ছিলেন এই বোঝাবুঝিটুকুর জন্যে যে (স্যারকেই স্মৃতি থেকে কোট করে বলছি): ‘মাসরুর, দ্যাখো এই মাটিতে বৈদিক ধর্ম ছিল, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছিল, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ধর্ম ছিল, ছিল জৈন ও বৌদ্ধ; কিন্তু হিন্দু ধর্ম বলে আলাদা কোনো ধর্ম ছিল না। আর এবার ভূগোলের দিকে তাকাও—বাংলায় বাঙালি ছিল, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, উড়িষ্যায় ওড়িয়া, তামিলনাড়ে তামিল, কিন্তু ভারতীয় জাতি নামে আলাদা কোনো জাতিসত্তা ছিল না। তাহলে কীভাবে হঠাৎ কোত্থেকে জন্ম নিল হিন্দুধর্ম, আর ভারতীয় জাতি নির্মাণ-ভাবনার বাসনা? মনে রাখবা, ভিনদেশের কেউ ভারত দখলের আগে ভিনদেশের ধর্ম ভারত দখল করেছিল। ইসলাম নামের একদম সুসংগঠিত এক ধর্ম এখানে যেই আসলো, তারই প্রতিক্রিয়ায় আসলো নিজেদের মাটির হিন্দু ধর্ম খাড়া করবার বোধ, আর আসলো হিন্দুত্বের বেসিসে এক অখণ্ড হিন্দু ভারতীয় জাতির ভাবনা। এই মাটিতে ইসলামের সবচাইতে বড় অবদান এইটা যে, সে হিন্দুধর্মের থিওলোজিক্যাল চেহারাটার অতিরিক্ত সামাজিক সাংস্কৃতিক রূপরেখাটারও জন্ম দিয়েছে। একটা কাজের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটার জন্ম হওয়া ইতিহাসে স্বাভাবিক কথা। তেমনই স্বাভাবিক যে, গ্রামবাংলায় এখন এই যে ইসলামী চেতনার নতুন এক বিরাট জোয়ার চলছে, এর প্রতিক্রিয়ায় একদিন এই রাষ্ট্র তার আধুনিকতামনষ্ক স্বতন্ত্র এক সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলিমের জাতি রাষ্ট্রচিন্তার আসল যে ব্যতিক্রমী পরিচয় “সেক্যুলারিজম”, সেটা হারাবে।’

আমি স্যারকে বলেছিলাম, ‘স্যার, ভয় লাগে। আর বলবেন না। আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন মতো হয়ে যায়।’
স্যার বলেছিলেন, ‘আমারও ভয় লাগে।…”আলথুসার”-এ তুমি পরিবেশ বিষয়ে পৃথিবীর সংগ্রামগুলো নিয়ে কী সুন্দর করে লিখেছ। এবার তুমি আমাদের এই “ভয়”-টা নিয়ে লেখো। শুরু করতে পারো সুনীতিকুমারের বই “ইরানিয়ানিজম” থেকে। আছে তোমার কাছে? না থাকলে ড্রাইভার পাঠাও। আমারটা নাও।’

আমি পরশু বা পারশ্ব নামের বৈদিক আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় আর্যদের মিথস্ক্রিয়ার কথা ভাবছি, স্যারের কাছ থেকে ক্লু নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি যে, কীভাবে সেই মিথস্ক্রিয়া থেকে জন্ম নিল আমাদের প্রিয় শব্দ ‘রিলিজিয়ন‘-এর, মানে ধর্ম, মানে রোজকার নামাজ ও পূজাপাঠের বাইরে আমাদের বড় স্বপ্ন সে, আমাদের আত্মা, আমাদের ভাত সে, আমাদের মাছ, আমাদের কলারের কাপড় সে, আর কলারের নিচে থাকা গলার কাছের এক জোট-ঘোঁট-দলা। গলার কাছে স্পষ্ট এক দলা নিয়ে আমি শামসুজ্জামান খান স্যারের জন্য কাঁদছি।