স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তেষ্টায় পুড়ে যাচ্ছে মন ॥ শিল্পী নাজনীন


বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সমানতালে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতোমধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় বদলে গেছে বিশ্ব। বদলেছে মানুষের জীবনযাপন। শিল্প-সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ নিয়ে যােগসূত্রের এ আয়োজন। এবারের সাক্ষাৎকার পর্বে পড়ুন কথাসাহিত্যিক শিল্পী নাজনীনের লেখালেখি নিয়ে।

যােগসূত্র: লকডাউনে কী পড়ছেন, কী লিখছেন?
শিল্পী নাজনীন: সেই অর্থে পড়ছি না কিছুই। প্রতিদিন চারপাশে এত মৃত্যু, এত হাহাকার, কেমন শূন্য করে দিচ্ছে মন। অর্থহীন মনে হচ্ছে এই যাপন। পরিচিত মুখগুলোর এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া বিকল করে দিচ্ছে বোধের পারদ। এ অবস্থায় পড়ায় মন বসানো কঠিন। ড‍্যান ব্রাউন পড়ার চেষ্টা করছি কদিন থেকে। নতুন করে পড়ছি সুবোধ চক্রবর্তী। এছাড়া অনলাইনে সমসাময়িকদের লেখাগুলো পড়ছি চোখে পড়লে। এগুলোকে পড়া না বলে বরং ‘পড়ার চেষ্টা’ বলাই ভালো। লেখার গতিও শ্লথ। ওপার বাংলার একটা ওয়েবম‍্যাগে উপন‍্যাস প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। প্রতি বুধবার। ঐ লেখাটা চলমান রেখেছি বাধ্য হয়েই। এছাড়া গল্প লেখার চেষ্টা করছি মাঝে মধ্যে। ছোটগল্পের একটা পাণ্ডুলিপি রেডি করার চেষ্টা করছি। আমাদের প্রবীণ প্রজন্মের নানান দুঃখ-দৈন‍্য, হাসি-আনন্দ, সংকট ও সমস্যাগুলোর বহুমাত্রিক চিত্র থাকবে এখানকার একেকটা গল্পে। আপাতত এটুকুই।

যােগসূত্র: কীভাবে কাটাচ্ছেন লকডাউনের দিনগুলো?
শিল্পী নাজনীন: অনেকটা অলস সময় কাটছে এখন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই-ই বলতে গেলে। কলেজেও খুব প্রয়োজন ছাড়া যাওয়া হয় না তেমন। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি মাঝে মাঝে। টুকটাক পড়াশোনা, লেখালেখির চেষ্টা, বাচ্চাদের সময় দেওয়া, এসবেই দিন যায় এখন। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছি ভীষণ। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তেষ্টায় পুড়ে যাচ্ছে মন।

যােগসূত্র: কোভিড-১৯ শিল্প-সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলছে?
শিল্পী নাজনীন: সমসাময়িক শিল্প-সাহিত‍্য কোভিড-উনিশময় হয়ে উঠছে সম্ভবত। যদিও মন ভয়ানক বিপর্যস্ত। পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না তেমন, তবু যতটুকু পড়ছি, দেখছি, শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে কোভিড-১৯ শিল্প-সংস্কৃতিতেও থাবা বসিয়েছে শক্তভাবেই। এই সময়ের গল্প, কবিতা, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র সব শাখাতেই করোনার ছায়া লক্ষ‍্য করছি। সব জায়গাতেই হারানোর সুর, শূন্যতার হাহাকার চোখে পড়ছে খুব। আমার নিজের লেখাতেও করোনার প্রভাব পড়ছে অজান্তেই। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার যে ধরন, সেটাও অনেকটাই পাল্টে যাচ্ছে। এখন আর মানুষ আগের মতো একত্রিত হতে পারছে না বিভিন্ন প্রয়োজনে। ফলে সামষ্টিক প্রেরণা আমাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক শক্তি যোগাত তার বিকল্প ভাবছে অনেকেই। এর ফলশ্রুতিতে ইদানীং ফেসবুকে লাইভ আড্ডা, সাহিত‍্যালোচনার মতো বিষয়গুলো চোখে পড়ছে ঘন ঘন। অর্থাৎ পরিবেশ যতই বৈরি হোক, শিল্প-সংস্কৃতি এসবের মধ্যে থেকেই পথ করে নিচ্ছে, বেগবান রাখছে তার অগ্রযাত্রা। একলা থেকেও অবিচ্ছিন্ন থাকার যে চেষ্টা, তার জোরালো প্রভাব পড়ছে এ ক্ষেত্রেও।

যােগসূত্র: কীভাবে করোনা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
শিল্পী নাজনীন: আপাতত উত্তরণের চিন্তা বাতুলতা হবে আমাদের জন্য। কারণ বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দরিদ্র দেশটির সরকারের পক্ষে রাতারাতি সবাইকে টিকার আওতায় এনে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ অসম্ভব। তাছাড়া টিকার কার্যকারিতাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। আর তাই কোভিড-১৯ নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হবে আরও বেশ কিছুদিন। সে কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মানা আর মাস্ক পরার কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে কিছু নেই সম্ভবত। তবে শুধু বর্তমান সংকট কোভিড-১৯ নিয়ে না ভেবে, বিল গেটস যে বলেছেন ভবিষ্যতে করোনার মতো এমন আরও অনেক ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের টিকে থাকতে হবে, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের উচিত প্রকৃতি ধ্বংস করার যে ভয়াবহ প্রবণতা বাড়ছে সারা পৃথিবীতে, সেখান থেকে সরে আসা এবং মানবকল‍্যানমূলক খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো। সেটা করা গেলেই প্রকৃত উত্তরণ সম্ভব হতে পারে বলে আমি মনে করি।