আমি তখন আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজারে একটা দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকি। ওয়ারির পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে এই এলাকায় এসেছি নদী আর শার্লিকে নিয়ে। আমাদের সঙ্গে থাকে নদীর বয়েসী একটা মেয়ে। সে আমাদের গৃহ সহায়তাকারী। বাড়ি গুছিয়ে রাখা আর রান্নাবান্নায় শার্লির ডানহস্ত হিশেবে বেশ দক্ষ। অবসরে খেলার সঙ্গী নদীর।
১৯৯৪ সালের জানুয়ারির শেষান্তে, এক বিকেলে ছোটদের বিশেষ একটি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং শেষে রামপুরা বিটিভি ভবন থেকে আজিমপুরে ফিরছি। আমার পরনে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবির সঙ্গে নীল জিন্সের প্যান্ট আর কোলাপুরি চপ্পল। আমাকে বহনকারী সিএনজিটা মৌচাক মোড় থেকে সিদ্ধেশ্বরীর গলিতে ঢুকে পড়লো শর্টকাট মারবে বলে। কিছুক্ষণ চলার পর সিএনজির সামনের চাকাটা আচমকা ভাঙা রাস্তার একটা গর্তে পড়তেই ছিটকে পড়লাম আমি ড্রাইভারের পিঠ ঠেকানো সরু রড নির্মিত নেটের ফ্রেমের ওপর। আমার কপালটা ঠুকে গেলো রডের খোপে। নাকটা বাঁচলেও নাকের ওপর দিকে দুই ভ্রুর মাঝখানে কেটে গেলো বিচ্ছিরি রকম। মুহূর্তেই ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়লো নাক বেয়ে। বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবিটার বুকের কাছটায় টকটকে লালের ছোপ। কপালের কাটা অংশে বাঁ হাত চেপে ড্রাইভারকে শুধু বললাম–কাজটা করলা কী! রাস্তাটা দ্যাখবা না!
ড্রাইভার পেছন ফিরে আমার রক্তারক্তি অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো–ছার আমি বুঝতে পারি নাই। সামনেই একটা হাসপাতাল আছে। যামু?
আমি বললাম–যাও।
মিনিট খানেকের মধ্যেই সিদ্ধেশ্বরী মনোয়ারা হাসপাতালের সামনে এসে থামলো ওর সিএনজি। গাড়িটা থামিয়ে খুব যত্ন করে আমাকে নামিয়ে ধরে ধরে নিয়ে গেলো সে ইমার্জেন্সি বিভাগে। একজন তরুণ ডাক্তার মনে হয় অপেক্ষায় ছিলেন আমার। আমাকে দেখেই দ্রুত শুইয়ে দিলেন একটা একপ্রস্ত স্ট্রেচারের ওপর। এক্সিডেন্টের বৃত্তান্ত শুনলেন, প্রথমেই। আমি বললাম, ডক্টর, টাকাপয়সা নিয়ে ভাববেন না। আমি শুধু প্রপার ট্রিটমেন্টটা চাই।
দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার বললো, ছার আমার কাছে টাকা যা আছে নিতে পারেন লাগলে।
তরুণ চিকিৎসক হাসলেন, আরে নাহ্ টাকা পয়সা খুব বেশি লাগবে না মনে হয়। যদি লাগে, সঙ্গে না থাকলে পরে এসে দিয়ে যাবেন। বলতে বলতে আমার কপালের রক্ত মুছে ক্ষতস্থানটা ক্লিন করে তিনি দেখলাম সেলাই ফোঁড়াইয়ের এন্তেজাম করছেন। আমি তো চেঁচিয়ে উঠলাম–আরে আরে করেছেন কী! স্টিচিং লাগবে নাকি? স্টিচিং দিয়েন না!
ডক্টর বললেন, স্টিচিং তো লাগবে!
আমি বললাম, যদি লাগে তো এনেস্থেশিয়া দিলেন না যে! প্লিজ ডক্টর উইদাউট এনেস্থেশিয়া স্টিচিং আমি নেবো না। ব্যথা আমি সহ্য করতে পারবো না প্লিজ!
হাসলেন ডক্টর–আমার ওপর আস্থা রাখেন। মাত্র এক্সিডেন্টটা হয়েছে। যে মাত্রায় আহত হয়েছেন তাতে জায়গাটা এমনিতেই এনেস্থেটিক পজিশনেই আছে। একদম টের পাবেন না আপনি।
একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে দ্রুত আমি আমাদের বাড়ির ল্যান্ডফোন নাম্বারটা লিখে ডক্টরকে দিয়ে বললাম, যদি সেন্সলেস হয়ে যাই তো কাইন্ডলি একটা কল দিয়ে জানাবেন এইখানে, আমার কন্যা বা স্ত্রী রিসিভ করবে কলটা।
ডক্টর হাসলেন, আরে অতো ঘাবড়াচ্ছেন কেনো? ওসব কিচ্ছু হবে না।
কালো সূতোসহ একটা বাঁকা সূচ আমার নাক বরাবর নেমে আসার সময় বললাম, সেলাই না দিলে হয় না?
ডক্টর হাসলেন। বললেন, হয়। হবে না কেনো? কিন্তু তাতে করে টেলিভিশনে আপনার ভ্রুর ওপরে কপালের মাঝ বরাবর কাটা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাবে। (অর্থাৎ তরুণ এই ডক্টর আমাকে চিনতে পেরেছেন। আশ্বস্ত হলাম খানিকটা।) মাত্র দুটো সেলাই দেবো। দেখবেন দাগটা ঠিক মিলিয়ে যাবে ভবিষ্যতে। আর সেলাই না দিলে চিরস্থায়ী একটা কাটা দাগ থাকবে আপনার কপালে।
‘গাল কাটা কামালের মতো কপাল কাটা রিটন’ আমি হতে চাই না বলে দুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম নিঃশ্বাস প্রায় চেপে রেখে।
ক্ষিপ্র গতিতে দেড় মিনিটেরও কম সময়ে দুইটা সেলাই কমপ্লিট করলেন ডক্টর। সত্যি সত্যি ব্যথা তো ব্যথা, আমি টেরই পেলাম না কিছু।
সবশেষে চার্জ করলেন মাত্র সাড়ে তিনশো টাকা!
আমি বললাম, এতো কম!
ডক্টর বললেন, এটাও নিতাম না কিন্তু নিতেই হচ্ছে। সুঁই-সূতো-গজ আর সামান্য মেডিসিন কস্ট্। নিতেই হলো।
বললাম, সেলাই কাটাতে কবে আসবো?
তিনি বললেন, আসতে হবে না। পানি থেকে সাবধানে রাখবেন ড্রেসিংটা। সূঁতোটা মিশে যাবে চামড়ার সঙ্গে। ব্যথা বেশি হলে প্রেস্ক্রিপশনে লেখা ট্যাবলেটগুলো খাবেন। আর রেস্টে থাকবেন মিনিমাম দুই/তিন সপ্তাহ। এমনকি টেলিভিশনেও যাবেন না, হাহ হাহ হাহ।
বললাম, থ্যাংক ইউ ডক্টর।
সিএনজি ড্রাইভারকে আমি চলে যেতে বললেও সে যায়নি। সে অপেক্ষা করেছে। বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যা। শেখ সাহেব বাজার গলিতে নেমে ড্রাইভারকে বললাম, তুমি এতোক্ষণ থাকলে আমার সঙ্গে। কতো দিতে হবে বলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওর সঙ্গে রফা হওয়া রামপুরা-টু শিক্সা বাজারের ভাড়াটাই চাইলো সে। উলটো দুঃখ প্রকাশ করলো, আমি গর্তটা দেখি নাই বইলাই তো আপনের এতো কষ্ট হইলো ছার!
বেশকিছু অতিরিক্তসহ ওর হাতে ভাড়া মিটিয়ে আমি দরোজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সে বললো, যাইতে পারবেন তো ছার? বাড়িত দিয়া আমু? লগে আসি? আওগাইয়া দেই?
বললাম, না। আমি ঠিক আছি। যাও তুমি। তুমি একজন ভালো মানুষ। সাবধানে চালাইও।
সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে খুব সাবধানে দোতলায় পৌঁছে দরোজায় দুইবার নক করতেই কে? বলে আমার কন্ঠস্বর নিশ্চিত হয়ে কাজের মেয়েটা দরোজা খুললো। এবং দরোজা খুলেই আমার কপালে ছোট্ট ব্যান্ডেজ এবং পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ দেখে একটা চিৎকার শেষে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো মেয়েটা! ওর চিৎকার আর কান্না শুনে ছুটে এলো শার্লি আর নদী। এবং অস্থির হয়ে কাঁদতে শুরু করলো নদী আর শার্লিও। তিনজনের কান্নায় রীতিমতো একটা কেলেঙ্কারী অবস্থা!
হঠাৎ কী যে হলো আমার! কষে একটা ধমক দিলাম কাজের মেয়েটাকে–এই তুই কাঁদছিস ক্যানো!
আমার ধমকে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মেয়েটা! জোর করে ঠোঁট চেপে সে তার কান্না থামাতে সচেষ্ট হলো। ওর দুইচোখে অশ্রু টলোমল করছে। হাতের চেটোয় চোখের জল মুছে অবিশ্বাস্য বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো সে আমার দিকে।
আমার হুঁশ ফিরলো একটু পরেই! এ আমি কী করলাম! হায় হায় এটা কী বললাম আমি!
কাজের মেয়েটা একটু দূরেই দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে আমার অবস্থা অবলোকন করছে।
শার্লি আর নদী আমার সেবা শুশ্রুষা করছে সোফায় শুইয়ে দিয়ে। শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। তারপর মেয়েটাকে ডাকলাম, আয়।
দ্বিধা থরোথরো পায়ে মেয়েটা এগিয়ে এলো আমার কাছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় আর গালে আদরের স্পর্শ দিতে দিতে বললাম, খুব অন্যায় হয়েছে আমার। তোকে বকা দেয়া ঠিক হয়নি। আমার জন্যে তুই কাঁদবি না তো কে কাঁদবে? মাথার ঠিক ছিলো না বুঝলি? তুই আমাকে মাপ করে দিস? কিছু মনে করিস না রে। আমার মাথার ঠিক ছিলো না তখন……
আমাকে ওরকম ক্ষমা চাইতে দেখে দুখি ছোট্ট মেয়েটা ফের কাঁদতে শুরু করলো–খালু আপ্নে কতো কষ্ট পাইছেন! কতো রক্ত বাইরাইছে আপ্নের!…
সাতাশ বছর পরেও আমাদের আজিমপুরের ভাড়া বাড়িতে ঘটে যাওয়া সেই সন্ধ্যার ঘটনাটা আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে প্রায়ই। ছোট্ট কাজের মেয়েটার বিস্মিত হতভম্ব বেদনার্ত চোখ দু’টো আমাকে তাড়া করে ফেরে। একটা অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। কতো অকৃতজ্ঞ আর অমানুষ আমরা! আমাদের সঙ্গেই আমাদের পরিবারেই থাকে ওরা রাতদিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। কিন্তু আমরা কোনোদিনই পরিবারের একজন বলে ভাবতে পারি না ওদের!
মনোজগতে সামন্তবাদী একটা দানবকে আমরা লালন করি। সেই দানবটাই বহাল রাখে শ্রেণি বৈষম্যের দেয়ালটা।
০২
কাজের ছেলে আর কাজের মেয়েদের নিয়ে বেশ কিছু ছড়া আছে আমার। বিভিন্ন সময়ে দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতা এবং আমার সম্পাদিত ছোটদের কাগজসহ আমার বইগুলোয় মুদ্রিত হয়েছে সেগুলো।
নাম ভুলে যাওয়া সেই ছোট্ট মেয়েটাকে মাথায় রেখে ঘটনার বাইশ বছর পর ২০১৬ সালে ওর বয়েসী কাজের মেয়েদের যাপিতজীবনের কাহিনি অবলম্বনে একটা ছড়া লিখেছিলাম।
তখনও পত্রিকার পাতায় এবং স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রায় নিয়মিতই প্রচারিত হতো গৃহকর্মীদের ওপর তথাকথিত ভদ্র-শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাইকো গৃহকর্ত্রীদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয়াবহসব প্রতিবেদন। দেখে শিউরে উঠতাম। সামান্য ছুঁতোয় শারীরিক নির্যাতন তো করেই, ঠিক মতো খেতেও দেয় না কাজের মেয়েদের। অনেক বাড়িতেই কাজের মেয়েদের জন্যে থাকে আলাদা নিম্নমানের রান্নার ব্যবস্থা! কী ভয়ংকর মানসিকতা!
আজ সকাল থেকে আমাদের আজিমপুরের ভাড়াবাড়ির ছোট্ট সেই গৃহসহায়তাকারী ‘কাজের মেয়েটা’র কথা বারবার মনে পড়ছিলো। আমাকে আহত অবস্থায় দেখে কী রকম চিৎকার করে কাঁদছিলো মেয়েটা! জানি না সে এখন কোথায় আছে কেমন আছে। নিষ্ঠুর নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে কে জানে!
কাজের মেয়েদের বিষয় করে ২০১৬ সালে লেখা ছড়াটা খুঁজে বের করলাম। ফেসবুকে আমার পাঠক বন্ধুদের জন্যে ছড়াটা এখানে তুলে দিলাম–
দেখো তো আমায় চিনতে পারো কী না !
লুৎফর রহমান রিটন
তোমার বাড়ির কাজের মেয়ে আমি
দেখো তো আমায় চিনতে পারো কী না!
খুব সামান্য খুব সাধারণ মেয়ে
খুবই গরিব, বাহারী নাম ‘বীণা’ ।
আমার বাবার বাজনা ছিল প্রিয়
বীণা নামটা সেই কারণেই রাখা।
কিন্তু বাবা জানতো না যে মোটে
বীণার সুরে দুঃখ থাকে আঁকা!
এ সংসারের হাজার রকম কাজ
সূর্যোদয়ের আগ থেকে তার শুরু।
তোমার মায়ের হুংকারে ঘুম ভাঙে
সমস্ত দিন বুকটা দুরু দুরু।
পান থেকে চূন খসলে উপায় নাই
শক্ত হাতে ধরবে চুলের মুঠি।
জুটবে আরো চড় থাপ্পড় গালি
রোজ প্রতিদিন, একদিনও নাই ছুটি।
ঘর-দোর সাফ জামা কাপড় ধোয়া
রান্না ঘরে বাসন-কোসন মাজা,
শাক সবজি তরকারি মাছ কুটা
ইলিশ কিংবা রুই-এর টুকরো ভাজা–
গরুর মাংস মুরগির ঝোল আর
মাঝে মধ্যে পোলাও রান্না হয়,
পোলাও খেতে ভীষণ ইচ্ছে করে
খুশবুটা তার ছড়ায় জগতময়…
এ-সব কাজই সামলাই দুই হাতে
আমার তাতে দিন গড়িয়ে রাত।
ক্লান্ত শরীর, ক্ষুধায় শরীর কাঁপে
গোগ্রাসে খাই বাসি ডাল ও ভাত।
মাছ মাংস আমার জন্যে নয়
আমার জন্যে বরাদ্দ ঝোল-ডাল।
নেই অভিযোগ আমি তাতেই খুশি
চাই না আমি অনাহারের কাল।
বইপত্তর তোমার জামা জুতো
যত্ন করে গুছিয়ে রাখি রোজ।
রোজ প্রতিদিন অপেক্ষাতে থাকি
নাও না তুমি একটু আমার খোঁজ!
তোমার মতো আমিও পড়তে চাই
তোমার মতো ইশকুলে চাই যেতে।
তোমার পরিবারের সঙ্গে থাকি
আশ্রয় আর দু’মুঠো ভাত খেতে…
জানি না কোন কষ্ট অভিমানে
আমার চোখে জল করে থইথই–
তোমার পরিবারের সঙ্গে থাকি
(কিন্তু) পরিবারের আমি তো কেউ নই…
অটোয়া, ২৫ এপ্রিল ২০২১
[ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের ]