ঠিক ২৫ বছর পরে সম্প্রতি (মে, ২০২১) গিয়েছিলাম আমার জাপান প্রবাসী জীবনের উত্থানস্থল কিতাসেনজু শহরের আসাহিচোও মহল্লায়। এমন পরিবর্তন হয়েছে যে, অবাক না হয়ে পারিনি।
কিতানেসজু এটা আমার ওয়ার্ডের পার্শ্ববর্তী আদাচি-ওয়ার্ডের প্রধান ও সুবিখ্যাত একটি বড় শহর। মূলত শহরটির নাম সেনজু। কিতাসেনজু তথা উত্তর সেনজু এবং মিনামিসেনজু তথা দক্ষিণ সেনজু দুই মহল্লায় বিভক্ত। মিনামিসেনজু একটি সাধারণ স্টেশন কিন্তু কিতাসেনজু একটি বড় জংশন। একাধিক প্রদেশগামী এবং টোকিওর অভ্যন্তরে চলাচলকারী হিবিয়া-ছেন নামক পাতাল রেল এখানে থামে। মাটির নিচে একতলা এবং মাটির উপরে পাঁচতলাবিশিষ্ট আধুনিক একটি স্টেশন অ্যাভিনিউ হিসেবেও বিশেষভাবে পরিচিত।
কিতাসেনজু রেল স্টেশনের অভ্যন্তর এত বিস্তৃত যে অনেক দোকানপাট এবং লুমিনে নামক বিখ্যাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর বিদ্যমান। স্টেশনের বাইরে পশ্চিম দিকের প্রবেশপথে রয়েছে সুদৃশ্যমান খোলা প্রাঙ্গণ, আরেকটি সুবিখ্যাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর মারুই এবং রাস্তার দুপাশে দীর্ঘ সারি সারি বিপণী যাকে জাপানি ভাষায় বলা হয় শোওতেনগাই।
স্টেশনের পূর্বদিকেও রয়েছে দীর্ঘ সারিসারি বিপণীবিতান এবং একাধিক ম্যানশন। সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে টোকিও দেনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০৭ খ্রি.। পশ্চিম দিকের এই স্থানটির নাম আসাহিচোও বা আসাহি শহর। চোও হচ্ছে শহর।
কিতাসেনজু শহরটি ১২০০ বছর ধরে সুবিখ্যাত। হেইয়ান যুগ থেকে এই রেইওয়া যুগ পর্যন্ত গ্রামীণ সভ্যতা থেকে আধুনিক সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। তবে অবশ্যই ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যতখানি সম্ভব সুরক্ষা করে নান্দনিক নগরে রূপান্তরিত হচ্ছে শহরটি। এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রি.) চারটি জুকুবামাচি তথা পোস্ট টাউন বা উপশহর (?) ছিল, তার একটি ছিল সেনজুজুকু। অন্য তিনটি হল, ইতাবাশিজুকু, নাইতোও শিনজুকু এবং শিনাগাওয়াজুকু।
এদো বর্তমান টোকিও থেকে কিয়োতো নগর পর্যন্ত পাঁচটি প্রাচীন মহাসড়ক রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত এই চারটি জুকু বা উপশহরগুলো। এই চারটি উপশহরে গড়ে উঠেছিল সরকারি কর্মচারী, বণিক-ব্যবসায়ী, বুশি তথা যোদ্ধাদের বাসাবাড়ি, দপ্তর, বাজার, সরাইখানা, পানশালা, জৈবিক আনন্দ-বিনোদনপাড়া তথা য়োশিওয়ারা, জুকুবা জোরোও ইত্যাদি। অসাধারণ জমজমাট, রঙিন, অনন্য-সাধারণ নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল আধাগ্রাম-আধাশহররূপী এই জুকুবাগুলো, তার অনেক নির্দশন অত্যন্ত যত্মের সঙ্গে আজও সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা দেখলে বিস্ময় জাগে।
এইসকল জুকুবার অধিকাংশ স্থাপত্যই হচ্ছে কাঠ, বাঁশ, বুনো ছন, ওয়াশি-কাগজ এবং পাথরের তৈরি। নিপুণ কলাকৌশলে নির্মিত এসব। আর এগুলো স্থানীয় ও আঞ্চলিক নগর প্রশাসন দ্বারা সংরক্ষিত হচ্ছে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পরিদর্শনের ব্যবস্থাও রয়েছে। কোথাও কোথাও বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায় সংরক্ষিত প্রত্মগৃহে।
এই কিতাসেনজু স্টেশনের রেললাইন সংলগ্ন আসাহি শহরে ছিল আমার তৃতীয় কর্মস্থল ‘আসাহি কোওসোকু ইনসাৎসু কাইশা’ তথা ‘আসাহি রেপিড প্রিন্টিং কোম্পানি’ নামে একটি মাঝারি প্রতিষ্ঠান। সময়কাল ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পুরো পাঁচ বছর। চাকরিটি আমি উয়েনো হ্যালো ওয়ার্ক তথা সরকারি রিক্রুট এজেন্ট থেকে পেয়েছিলাম। নাম রেজিস্ট্রি করে একটি ভালো প্রিন্টিং প্রেসে চাকরির আবেদন করেছিলাম, যেখানে আমি আধুনিক মুদ্রণবিষয়ক প্রযুক্তি শিখতে পারি। দু-সপ্তাহের মধ্যেই খবর পেলাম যে, কিতাসেনজু শহরে একটি আধুনিক প্রিন্টিং কোম্পানিতে লোক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, বিদেশিও চাকরি করতে পারবে যদি জাপানি ভাষা মোটামুটি জানা থাকে। রিক্রুট এজেন্টের সুন্দরী কর্মচারী আমাকে পরিচয়পত্র ও ঠিকানা দিয়ে বললেন কোম্পানিতে গিয়ে জয়েন করার জন্য।
আমার ব্যবহৃত কামেআরি স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে মাত্র দুই নম্বর স্টেশনটিই হচ্ছে কিতাসেনজু স্টেশন। পরিচিত স্টেশনই, দু-একবার গিয়েছি আগে লুমিনে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখলাম মাঝারিগোছের একটি দুতলা ছাপাখানা। পরিপাটি সাজানো-গোছানো। তিনটি অফসেট প্রিন্টিং মেশিন। দুটি চার কালার ও একটি পাঁচ কালার একসঙ্গে ছাপার ফুল-সাইজ অটোমেটিক মেশিন। বাইরে থেকেই মিহি শব্দ পেলাম মেশিন চলার। সেইসঙ্গে কাগজ ও রঙের গন্ধ। মনে পড়ে গেল কুমিল্লার সিংহ প্রেস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রেস, আমোদ প্রেস, রুপসী বাংলার প্রেসের দৃশ্য। ম্যানেজার ইন্টারভিউ নিলেন। প্রেসটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। জিজ্ঞেস করলেন, মুদ্রণ বিষয়ে কেন আগ্রহ আমার? আমি জবাবে, বললাম, ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি করি, ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেছি। প্রিন্টিং ভালো লাগে, পুরো টেকনোলজিটা শিখতে চাই, ভবিষ্যতে জাপান-বাংলাদেশের মধ্যে প্রকাশনার ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখছি। ম্যানেজার চিবা সানের চোখ বিস্ফারিত হল আমার কথা শুনে। জাপানি ভাষায় কথা হচ্ছিল। বললেন, তোমার জাপানি ভাষা শুনলে বিদেশি বলে মনে হয় না! কানজি পড়তে পারো? বললাম, কিছু পারি, শিখছি এখনো। খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে। আগামীকাল থেকে কাজে লেগে পড়ো। এবিহারা সান ও হিরাজাকি সান শিখিয়ে দেবে কোনো অসুবিধা হবে না। দুজনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
জয়েন করলাম কাজে। ২৪ ঘণ্টাই কাজ হয় এখানে। অধিকাংশই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ও কালার পেইজ; টয়োটা, হোন্ডা, নিসসান, মিৎসুবিশি, মাজদা, হিনো, ফুসো, কোমাৎসু প্রভৃতি মোটর কোম্পানির বহুরঙা ক্যাটালগ, ক্যালেন্ডার, পোস্টার, নানা ধরনের ব্রুসার, প্রচারপত্র, ফেস্টুন ইত্যাদি। বইয়ের কাজ তত বেশি নেই।
আমার কাজ হল প্রিপ্রেস রুমে, ফিল্ম থেকে কম্পিউটারাইজড মেশিনে অ্যালমিনিয়মের প্লেইট তৈরি করা। অত্যন্ত ব্যস্ত এই প্রতিষ্ঠান। লক্ষ লক্ষ কাগজ ছাপা হচ্ছে বিরামহীনভাবে ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বড় বড় ট্রাক এসে কাগজ নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আবার মুদ্রিত কাগজ নিয়ে যাচ্ছে গ্রন্থ বাঁধাই কারখানায়। ছাট্ ছাট্ ছাট্ ছাট্ মিহি শব্দে মেশিন চলছে। মেশিনের পেছন দিকে হাতে এবং মেশিনের সাহায্যে কাগজ দেওয়া হচ্ছে, আর সামনের দিকে ছাপা কাগজের পাহাড় তৈরি হচ্ছে, লিফট গাড়ি দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, প্লাস্টিকের ফিতে দিয়ে বেঁধে ট্রাকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ২৫ জন কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানে কিন্তু কোনো হৈচৈ নেই, কথাবার্তা নেই দরকারি কথা ছাড়া। কাস্টমার আসাযাওয়া করছেন, কোম্পানির একাধিক সেলস ম্যানেজার কাজের কোয়ালিটি দেখছেন, প্রাথমিক অবস্থায় রং ও রেজিস্ট্রেশন মেলাতে বেশকিছু কাগজ ব্যয় করতে হয় সেগুলো গুছিয়ে রাখার জন্য একাধিক তরুণ কাজ করছে নীরবে, নীরবে রঙের ড্রাম অদলবদল করছে কেউ কেউ। কারখানার ম্যানেজার চিবা-সান ৪০ বছরের এক মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ একটি বেত হাতে নিয়ে কাজের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করছেন কঠিন দৃষ্টিতে। একটা দমবদ্ধ, ভারী পরিবেশ বিরাজ করছে মনে হল। এলাহি কাণ্ড দেখে ভয় করেছিল প্রথম কিছুদিন। তারপর ডালভাত হয়ে গেল। কাজের সময় জাপানিরা অত্যন্ত সিরিয়াস এবং নীরব থাকে, অন্যসময় তাদের মতো সদালাপী, হাসিখুশি, মজলিশি এবং আড্ডাবাজ জাতি খুব কমই আছে। ভাষা জানলে জাপানিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়।
প্রতিষ্ঠানের দুতলায় অফিস ঘর, সেখানে একটি সুন্দরী মেয়ে কিয়োমি সান কাজ করছে, বয়স্ক হিসাব রক্ষকসহ দশ-বারো জন উচ্চপদস্থ কর্মচারী একমনে কাজ করে চলেছেন। অফিস রুমের সঙ্গে রয়েছে শোকুদোও বা খাবারের ঘর, রেস্ট রুম এবং ছাপ্পান শিৎসু তথা প্লেইট মেকিং রুম যেখানে আমার কাজ। প্রথম তিন মাস ছিল মিনারাই তথা কর্মসিদ্ধ হয়ে ওঠার পরীক্ষামূলক সুযোগ। এর মধ্যে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি দ্রুত কাজ ধরে ফেলেছিলাম। কী যে কঠিন কঠিন হিসাবকৃত কাজ যা ব্যাখ্যা করা কঠিন! মিলি মিটারের হিসাব! এক মিলি মিটার গড়মিল হলেই ছাপা পণ্ড হয়ে যাবে। রং মিলবে না। মেশিন অপারেটর বিরক্ত হবে, ম্যানেজার শীতল বাঁকা চোখে তাকাবেন। আর আমার যে বস এবিহারা সান মাঝবয়সী একজন হাস্যরসিক কিন্তু কড়া মেজাজী জাপানি গালাগাল করতে দ্বিধা করবেন না। নির্ভুল ভালো কাজ করলে অবশ্য সবাই খুশি, পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেন। এইরকম ছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা মাস ছয়েক। তারপর আমি নিজেই ভেটেরান হয়ে গেলাম। বুঝলাম পৃথিবীটিা এইরকমই।
যদিও এর আগে দুটি প্রিন্টিং কোম্পানিতে কাজ করেছি, একটি হচ্ছে শিনোজুকা প্রিন্টিং কোম্পানি তাতে ছিলাম রিপ্রেজেনটিটিভ আর অন্যটি ছিল রিউবি প্রসেস কোম্পানি সিল্ক প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এমন কড়াকড়ি ছিল না। যাইহোক, তিন মাসের মধ্যে যথেষ্ট ভালো কাজের সাক্ষর রাখলাম আমি। সংশ্লিষ্ট সবাই খুশি। সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেল। মাঝেমাঝে কয়েকজন মিলে পানশালায় যাই কোম্পানির কাছেই বিপণী পাড়ায়। হৈচৈ করি, আকণ্ঠ পান করি, কারাওকে গান গাই তারপর মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরি। বছরে একবার শীতকালে কোম্পানি থেকে শানাই রিয়োকোও তথা কোম্পানি-ভ্রমণে যাই সবাই মিলে বাস ভাড়া করে অন্য প্রদেশে অনছেন রিজোর্টে। হোটেলের উষ্ণ প্রস্রবণে গলা ডুবিয়ে স্নান করি, বরফ পড়া দেখি আর বিয়ার পান, মদ পান করে স্বর্গীয় আনন্দে ভেসে যাই। এরকম দিন ছিল। শত কষ্ট, শ্রমের লবাণাক্ত ভারী অনুভূতি এবং ব্যর্থতার গ্লানি জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে নতুন হয়ে উঠতাম।
আগামী কিস্তিতে সমাপ্য