আমি তোমার আলো ॥ সালমা তালুকদার


আকাশের আজ মন ভালো নেই। পরি বলেছে ওর করোনা হয়েছে। আগামী পনেরো দিনের জন্য ঘরবন্দি। এদিকে পরির বাবাও হাসপাতালে আইসিইউতে করোনার সাথে লড়ছে। চাচাকে দেখার কেউ নেই।

সংসারে পরি আর ওর বাবা ছাড়া কেউ নেই।পরি ফোনে ফোনে যতটুকু যা পারছে করছে। তবু কতটুকুই আর। আকাশ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে।

পরির বাবার সাথে কোনোদিন ওর পরিচয় ঘটেনি। আর ওদের সম্পর্কটাও খুব বেশিদিনের নয়। দুষ্টুমির ছলেই ওদের পরিচয়। বলার মতো এখনো কিছু হয়নি। তবু আকাশের মনে তোলপাড় হচ্ছে খুব। পরির বাবার হাসপাতালে ভর্তির দুই দিনের মাথায় সিদ্ধান্ত নিল আকাশ। পরিচয় গোপন রেখে হাসপাতালের বিল হতে শুরু করে পরির বাবার সব রকম সেবা সে করলো। কেমন করে যেন লোকটার প্রতি একরকম মায়াও জন্মে গেছিলো। পরির বাবার চোখের কোনা দিয়ে পানি পরতে দেখতো আকাশ। ওটাই দোয়া ধরে নিয়েছিল। কারণ আকাশের মনে হচ্ছিল বার বার যদি উনি জানতেন, ‘আমি তার মেয়েকে ভালোবাসি’।

আকাশ পরির বাবাকে বাবা বলেই ডাকতো। শেষদিন আকাশের আপাদমস্তক পিপিইউ পরিহিত শরীরে হাত বুলিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আকাশ কিছু ছবি তুলে রেখেছিল। তারপর তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে পরির কথোপকথনে আকাশই পরির বাবার দাফন সম্পন্ন করেছিল। এর ফাঁকে পরিকে যতটুকু মানসিক সাপোর্ট দেওয়া যায় আকাশ দিতো। কিন্তু একবারের জন্যেও পরির কাছে যায়নি। আর পরি তার বাবার জন্য যে টাকা পাঠাতো তা একটা খামে ভরে রেখেছিল। সাথে বাবার সাথে তোলা আকাশের ছবি।

যেদিন পরির করোনা রেজাল্ট নেগেটিভ আসলো সেদিন আকাশ ওর বাসায় গেলো। পরির সব কান্না মনে হয় আকাশের জন্যেই জমা ছিল। আকাশকে জড়িয়ে ধরে পরির বাধভাঙা কান্নায় আকাশও শামিল হলো। ভদ্রলোককে তো আকাশ নিজের হাতে দাফন করেছে। মায়া তো আছেই। পরিকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল আর পরির বাবার চেহারা আকাশের চোখের সামনে ভেসে আসছিল। আকাশ পরিকে ধরে তার পাশে বসালো। দু্ই হাতে পরির সুন্দর মুখখানা তুলে ধরে বললো, ‘কেন ভেঙে পরছো পরি। আমি আছি না? তোমার আকাশ। তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিব। তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।’

পরি ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবলো, তেমন সম্পর্ক তো হয়নি। হলে পরির করোনার সময়ে আকাশের সাথে কথোপকথনের সময়সীমা আরো বেশি হতো। তেমন সম্পর্ক হলে পরি তার বাবার জন্য আকাশের কাছে সাহায্য চাই তো। কিন্তু সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই বলেই তো পরির বিপদে আকাশকে ডাকতে বা ডেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয়নি। পরি কিছু ভাবতে পারছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল, এখন কেন এ কথা বলছো আকাশ। এতদিন কোথায় ছিলে? এখন তুমি যাও। তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু মনে ঝড় বয়ে গেলেও মুখে কিছু আসছিল না পরির। আকাশ সব বুঝতে পারছিল। পরিকে রেখে উঠে গিয়ে খাটের পাশের জানালাটা একটু খুলে দিল। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সূর্য আজকের মতো তার পাট চুকাতে ব্যস্ত।

যেতে যেতে পরির জানালা দিয়ে ঘরে উঁকি দিল। লাল আলোটা এসে পরির মুখটা আরো লাল করে দিল। আকাশ মুগ্ধ হয়ে পরিকে দেখলো। কাছে এসে পরির লাল মুখটা তুলে ধরে বললো, ‘ঝেড়ে ফেলো মনের সব কথাগুলো। যে আলোর রশ্মিটা তোমার মুখ ছুঁয়েছে আজ। সেটা আগামীকাল বড় হয়ে তোমার ঘর আলো করবে। পরি তুমি আমায় চিনতে পারছো? আমি তোমার আকাশ। আমি তোমার আলো। আমি তোমার কাছে আসিনি ঠিক কিন্তু বাবার কাছে ছিলাম পরি। আমি তোমার বাবাকে দেখেছি। আমি তোমাকে দেখছি। আমার থেকে তোমার কোনো ভয় নেই।’

পরি অবাক হওয়ার শক্তিটাও মনে হয় হারিয়ে ফেলেছে। আকাশের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আকাশের বুকে পুরো শরীরটা এলিয়ে দিল। আকাশও এক বুক ভালোবাসা নিয়ে পরিকে জড়িয়ে ধরলো।