এমন কিছু ঘটবে সে বিষয়ে আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আজ নিশ্চত হলাম। আমাদের কারখানাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে দেশ এখন অনির্দিষ্টকালের জন্যে লকডাউন। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। অতএব কারখানাও বন্ধ। মানুষজন নেই, খদ্দের নেই, বিক্রি-বাটাও নেই। কারখানা চলবে কীভাবে? আজ জানতে পেলাম দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের চাকরিটাও আর নেই। তার মানে আমি এখন বেকার।
স্বাভাবিকভাবেই চাকরিবিহীন এই ঢাকা শহরে স্ত্রী-সন্তানসহ জীবনযাপন করা সহজ নয়। সংসার চলবে কীভাবে? হাতে জমানো টাকাও খুব একটা নেই। পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্ত্রী রেহানা অবশ্য আমার মতো এত ভেঙে পরছে না।
‘ভেঙে পরো না। ইনশাআল্লাহ দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালো কোনো ব্যবস্থা হবেই।’
এখন রেহানার মুখে সেই আগের মতো হাসিটা আর দেখতে পাই না। এক অজানা আতঙ্কে ওর মুখটা কিসমিসের মতো শুকিয়ে চুপসে গেছে। তার চেহারাটা দেখলে কেমন যেন লাগে। মনে হয় টসটসে কালো জাম অনেকদিন মাটিতে পড়ে সেখানে যেন ছাতা ধরে গেছে। চোখের নিচে কালির দাগ স্পষ্ট।
যদিও মুখে সে আমাকে কিছু বলে না। কিন্তু আমি তার মুখের ভাষা বুঝতে পারি। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে সে। বিপদে আমি যতটুকু ভেঙে পড়ি কিন্তু সে ততটা ভাঙে না। বরং সে আমাকে সাহস জোগায়। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখায়।
আমার দুটো মেয়ে। বড়টির নাম পদ্ম আর ছোটটি মাটি। পদ্মর বয়স সাত আর মাটির চার । মাটি এখনো স্কুলে যায় না। তবে আগামী বছরই সে যাবে। দুটো মেয়েই আমার জানের টুকরা। মেয়ে দুটো যখন ঘুমায় আমি ওদের নিষ্পাপ মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। ঘুমালে ওদের কত যে সুন্দর দেখায়। মনে হয় দুটো নিষ্পাপ দেবশিশু ঘুমিয়ে আছে। আমি তাদের ঘুমন্ত কপালে চুমো দেই। মনে হয় কত পরম নির্ভরতার সঙ্গেই না এই বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে। আমার ভেজা চোখ দিয়ে ওদের ঘুমন্ত মুখ দুটোকে তখন যতক্ষণ পারি দেখে নেই। তখন নিজেকে মনে হয় আমি কত অসহায় এক বাবা।
আর কিছুদিন পরই রোজা শুরু হচ্ছে।। তারপর দেখতে দেখতে ঈদও চলে আসবে। ঈদ যতই কাছে আসছে, ততই যেন আমার বুকের ভেতরে একটা কান্নার শব্দ ঠিক টের পাই। বড় মেয়েটা একটু বড় হয়েছে। সে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারে। তাই সম্ভবত কোনো বিষয়ে সে আর বায়না ধরে না। সেদিন দেখছিলাম পদ্মর জুতোটা খুব পুরনো হয়ে গেছে। আহা! মেয়েটাকে যদি এই ঈদে একজোড়া নতুন জুতো কিনে দেওয়া যেত! ছোট মেয়েটা এতসব বোঝে না। তাই রক্ষে!
সেদিন হঠাৎ করেই ঘরে একটা গুপ্তধন আবিস্কার করি। সেখানে প্রচুর টাকা। কোত্থেকে এত টাকা এলো। আনন্দে আমার পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ঘরে যে এত টাকা জমা ছিল সেটি আমি জানতামই না। যাক। বাঁচা গেল। একদিন পদ্ম আর মাটিকে নিয়ে বাসার কাছেই বেইলি রোডে ঈদের কেনাকাটা করতে বেরিয়ে গেলাম। বাপ-বেটিতে মিলে অনেকদিন পর আচ্ছামতো আনন্দ করে আইসক্রিম খেলাম আর সেই সঙ্গে পদ্মর জন্যে লাল টুকটুকে এক জোড়া জুতো আর মাটির জন্যে সুন্দর একটা পুতুল কিনলাম। রেহানার জন্যেও সুন্দর শাড়ি কিনতে ভুললাম না। মহা ধুমধামে কেনাকাটা করে যখন ঘরে ফিরলাম, তখন দেখি রেহানা আমার হাতে রং বেরংয়ের শপিং ব্যাগের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে। কোন কথা না বলেই সে হাত থেকে ছোঁ মেরে শপিং ব্যাগগুলো নিজের হাতে নিয়ে নিল। শাড়িটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। এদিকে মেয়ে দুটোও তাদের নতুন কাপড় আর জুতো পেয়ে অসাধারণ আনন্দে গোটা বাড়িতে চরকির মতো ঘুরছে। আমাদের এই ছোট ঘরে হঠাৎ করেই যেন ঈদের উৎসব শুরু হয়ে গেলো।
হঠাৎ মোবাইল ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। স্বপ্নটাও ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠে দেখি রেহানা তার মেয়ে দুটোকে নিয়ে তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।