আমাদের সান্ধ্য ইফতার ॥ স্নিগ্ধা বাউল


রোজার পড়ন্ত দুপুর। সেটা আমাদের মূল বাড়ির গল্প। যেখান থেকে আমরা বিতাড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যাই।

সেই বাড়িটার অন্দরে যা-ই থাক, বাইরের দিকে ছিলো লোহার বড়ো গেট। গেটে ঝুলতো তালা নয় ভিতরে ছিটকিনি।কেবল বিকেলের আগে আগে গেটটা খোলা হতো। মেজো জ্যাঠা তার গরু নিয়ে ঢুকতেন।সে-ই বাড়িতে এই গরুগুলোর দাম আমার মা আর আমাদের চাইতে বেশি ছিলো। অসম্ভব দরাজ আমার জেঠাতো বোনেরা দিনরাত তৈরি থাকতেন আমার মা’কে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। অসম্ভব সে সত্যগল্প আমার জীবনের গল্পে অবশ্যই আসবে একদিন।

বিয়ের পর বর নিয়ে বাড়িতে বসবাস করা মেয়েদের দজ্জালি দেখতে সিনেমা হলে না গিয়ে আমাদের সেই বাড়িটায় অনায়াসে যাওয়া যায়।

আমার মহিলা সমিতি করা জেঠাতো বোন, যিনি ভালোই মহিলা কল্যাণ করতেন কেবল তার মেহমানদের জন্য সেই গেটা খোলা হতো।

আমার মা বা আমাদের ঘরে কেও এলে সেই লোহার গেট হয়ে যেতো কয়েদীখানার ফটক, চাবি কোথাও পাওয়া যায় না, কেও না কেও টয়লেটে চলে যায় চাবি নিয়ে কিংবা কারো কোমড়ের কাছে চাবিটা নিয়ে কেও ঘুমিয়ে যেত।

ঠিক এমন গরমে আমার শৈশবের শৈশবে মা আমাদের নিয়ে মেঝেতে আঁচল পেতে শুয়ে পড়তেন। কখনো কোমড়ের বিছায় গিট্টু দেওয়া থাকতো আঁচলের মাথা। চুপচাপ মা ঘুমিয়ে পড়লে গেটের কাছে আসতাম; খোলা পেলেই হাতের বামদিকে দৌড়। দুটো বাড়ি ছেড়ে লম্বা টিনের কলোনির ঘরগুলোতে আঙুল দিয়ে টেনে দিতাম দৌড়। সামনে সোনা মিয়ার মাঠ আর চার রাস্তার মোড়টায় গৃহস্থ আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর।

কালসে ছাগলগুলোর গায়ের পাল্টে পাল্টে বহু বছরের জীব বিবর্তনের গল্প। আর একটু এগিয়ে গেলে লম্বা টানা মসজিদ ঘর। হুজুরকে দেখলেই আসসালামু আলাইকুম দিতাম। বিনিময়ে হুজুর আমাদের আদর করে দিতেন। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করতেন, খেলতে আসছো?

এই মসজিদ ঘরের বাইরে লম্বাটে করে একটানা ফুটতো গোলাপি রঙের টাইমফুল। আমরা টাইমফুল ছিড়ে আনার পথে দেখতাম ততক্ষণে বসে গেছে ইফতারির বাজার। সোনামিয়ার আমতলায় তখন পেটি বরফ বিক্রি করতো সবু, অন্যসময় ও আমাদের খেলার সাথী।

বাড়ি ফিরে মাকে ঘ্যানর ঘ্যানর করতাম ইফতারি খাব। শেষ পর্যন্ত আজানের আগে আগে মারের আঁচল ছেড়ে আসতো পাঁচটি টাকা; তিন টাকার পিঁয়াজু আর দুই টাকার ছোলা নিয়ে যখন ফিরতি দৌড় দিতাম তখন আজান পড়তে শুরু করে।

একবার দৌড়ে ছিটকে পড়ে পিঁয়াজু আর ছোলা রাস্তার দু্ই পাশে ; কাঁদতে কাঁদতে ফিরি আমি ঘরের মেঝেতে সাদা মুড়ি আর সরিষার তেল নিয়ে মা তখন বসে আছেন মেঝেতে।