এবারের বেড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল পদ্মবিল দেখা। হুটহাট প্ল্যান তারপরও প্রথম স্বচক্ষে দেখার তীব্র তাড়না কোনোকিছুতেই বাঁধ মানলো না।
আমরা ছয় বন্ধু একসাথে প্ল্যান করে নিলাম, দুদিন আগেই। পদ্মবিলটা গোপালগঞ্জ শহর থেকে কোটালিপাড়ার ভেতর। গোপালগঞ্জ পৌঁছানোর পরও কোটালিপাড়ার ভেতর দিয়ে সরু গ্রামের রাস্তা প্রায় ৩০ কিলোমিটার এরও বেশি যেতে হবে। তাতানো-পোড়ানো রোদ্দুর তখন যখন পৌছেঁছি বেলা নয়টা প্রায়।
একটা ছোট সাইনবোর্ড পেলাম, তাতে লেখা আছে, ‘পদ্মবিল, কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ’ আর স্থানীয় সবার কাছে অনেককিছু শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছালাম। সবচেয়ে সুবিধা যা পেলাম, গাড়ি থেকে নেমেই নৌকায় ওঠা যায় অর্থাৎ ঝিলের ধার দিয়েই রাস্তা। নৌকা বাঁধা আছে সারি সারি। নৌকা বলতে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা।
মাঝিদের সাথে কথা বলে ঠিকঠাক করে নিলাম। ঠিক কতটা ঝিলের ভেতর গেলে সব পদ্মের দেখা পাব তা-ও জেনে নিলাম। আমরা দুটো নৌকাতে উঠলাম।
নিজে তো সাঁতার জানি না, নৌকায় পা দিতে প্রাণ ভয়ে দুলে উঠলো। এত ছোট ডিঙি নড়তেই কাত হতে লাগলো। অল্প বয়সী একটা মাঝি ছেলে বললো,
-‘আফা, ডরায়েন না, কিচ্ছু হবে না।’
-বললাম, ‘আস্তে চালাবি!’
ও লগি দিয়ে আস্তে আস্তে যেতে লাগলো। এরপরও অন্তরাত্মা সাথে নেই। একটু যেতে সবিস্ময়ে হা করে রইলাম। চারদিকে নীলাভ শাপলা, পদ্মের চাক, কাকচক্ষু জল, তৃণ জলজ ঘাস।
অনেকটা দূরে গিয়ে চোখে পড়লো গোলাপি-সাদায় মেশানো কত শত পদ্ম। ভয় ভুলে গেলাম। একবারও মনে হলো না আমি সাঁতার জানি না। চারদিকে এত জল। ‘কাকচক্ষু জল’ একেই বলে। জলের তলদেশের এককণা জলজ উদ্ভিদও ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে। মাথার ওপর শরতের নীলাকাশ সাদা সাদা বুনো মেঘ উড়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতি আজন্ম ভালোবাসি। কতটা ভালোবাসি তখনই আরও বুঝতে পারলাম যেন। বেহুঁশের মতন দুচোখের সামনে তখন অবারিত প্রকৃতি মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। ফোন ক্লিক করছি চারদিক। কখনও দেখিনি পদ্ম এভাবে দলে দলে ফুটে থাকে। কী অপরূপ তাদের রং। কোনোটা দুধ-সাদা, কোনোটা নীলাভ বেগুনি, পিংক বা গোলাপি কেউ-বা!
কয়েকবার আমি পদ্ম এঁকেছি। আমার পোর্টফেলিও-তে তারা থরে থরে সাজানো, এবার সম্মুখেই! যা-ই হোক ফুল তুলবো না কি ছবি তুলবো এমন অবস্থা। পুড়ে যাচ্ছি রোদে, হুঁশ নেই। কয়েকটা পদ্ম তুলে নিলাম হাতে। তাকিয়ে দেখলাম অনেক ছেঁড়া পদ্ম ভেসে আছে চারদিকে।
প্রকৃতির ওপর অত্যাচার আমরা সবাই করি কম-বেশি। তাও প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্যের ডালি মেলে দিয়েছে পরম উদারতায়। পৃথিবীর মায়ায়, ডিঙি নৌকা আস্তে লগি দিয়ে চলছে।
চারদিকে সুনসান নীরব। মুগ্ধতার সৌন্দর্য মনকে আবেশী করে দেয়। ফেরার সময় অনেকবার ফিরে ফিরে তাকিয়েছি। খুব ভালো ছবি তোলা হয়নি, হয়ও না, এরকম কোথাও গেলে এত বিমোহিত থাকি। যারা প্রকৃতির সৌন্দর্য ভালোবাসেন, ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে, অবশ্যই ঘুরে আসবেন পদ্মভুবনে।