ইংরেজি ভাষার অনেক বই বাংলায় অনুদিত হয়েছে। বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত সাহিত্যের সংখ্যা নেই এমন নয়, তবে সংখ্যাটা খুবই কম। বেশিরভাগই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। তবে এবার খুশির খবর হলো- বাংলার সাহিত্য যাচ্ছে বিশ্ব দরবারে।
হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক বলছিলাম দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের কথা। বাঙালি এই সাহিত্যিকের বই বের হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত হারপার কলিন্স থেকে। দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘নারাচ’ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।
২০ মে (২০২১) কলকাতা টুয়েন্টিফোর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সম্প্রতি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা হারপার কলিন্স বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে সাহিত্যিক দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘নারাচ’ উপন্যাসকে অধিগ্রহণ করেছেন ইংরেজিতে প্রকাশের জন্য। দেবারতি জানান, বাংলা সাহিত্যে অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ কোনো সাহিত্যিকের উপন্যাস আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে এভাবে অধিগৃহীত হয়নি। হারপার কলিন্সের তরফে জানানো হয়েছে, গত দুই দশকে এত বিপুল অঙ্কের বাণিজ্যিক চুক্তিও বাংলা সাহিত্য জগতে হয়নি।
উনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের বহুস্তরীয় উপন্যাস নারাচ পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। কোভিড মহামারিতেও প্রকাশের মাত্র আট মাসের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়েছে এর দশটি মুদ্রণ। পাঠকমহলে বহুলপ্রশংসিত এই উপন্যাস সমালোচক ও বাণিজ্যিক দুই মহলেই অত্যন্ত আলোচিত।
হারপার কলিন্স বিবৃতিতে দিয়ে জানিয়েছে, সাহিত্যিক দেবারতি মুখোপাধ্যায় নিজে পেশায় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বয়সে তরুণ হলেও বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কয়েক বছরেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার প্রতিটি উপন্যাসই মৌলিক ও পরিশ্রমলব্ধ প্লটের ওপর লেখা। তার বই বিক্রির হারও ঈর্ষণীয়। নারাচ তার একটি মাইলস্টোন উপন্যাস। সেই উপন্যাস বিশ্বদরবারে পৌঁছনোর সুযোগ পেয়ে আমরাও আনন্দিত ও গর্বিত।
বাংলা প্রকাশক পত্রভারতীর কর্ণধার ও পাবলিশার অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের বলেন, এই খবর আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত এবং অত্যন্ত আনন্দের। হারপার কলিন্স বিশ্বের প্রথম চার বড় প্রকাশকদের মধ্যে একটি। দেবারতি বয়সে অত্যন্ত নবীন এবং এর মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়। ওর প্রথম ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস ‘নারাচ’ যে এইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হবে, এত বড় মাপের প্রকাশক সেটিকে অধিগ্রহণ করবেন, তা আমাদের আশাতীত। আমরা গর্বিত। শুধু তাই নয়, এই সংবাদ বাংলার সমস্ত তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আঞ্চলিক ভাষাতে লিখেও যে বিশ্বদরবারে এত অল্পসময়ে পৌঁছনো যায়, তা আশার আলো দেখাবে বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের।
দেবারতি মুখোপাধ্যায় বলেন, নারাচ উপন্যাসে কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে আমি বেদ, বেদোত্তর স্মার্ত সাহিত্য ও উনবিংশ শতকের প্রান্তিক এবং বিস্মৃত মানুষ ও মেয়েদের প্রকৃত অবস্থা অন্বেষণের চেষ্টা করেছি। নবজাগরণ, সমাজ সংস্কার এসব বহু-আলোচিত দিক ছাড়াও উনিশ শতকে অবধারিতভাবেই ছিল কিছু প্রান্তিক মানুষ, যাদের কথা ইতিহাস ভুলে গিয়েছে। সেই প্রান্তজনদের অব্যক্ত সংগ্রাম বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে। গোটা বিশ্বজুড়ে দাস ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও শ্রমিক যোগান দেওয়ার তাগিদে সেই সময়ে হাজার হাজার মানুষকে চালান করা হয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে, আখচাষের মজুর হিসাবে। পাঁচ বছরের ইন্ডেঞ্চারের চুক্তি থাকলেও সেই পাঁচ বছর তাদের পরাধীন করে রাখে আমৃত্যু। ‘নারাচ’ এ তুলে ধরা হয়েছে তাদের অমানুষিক জীবন আলেখ্য।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে লখনউয়ে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতায় এসে মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুলেছেন একটুকরো লক্ষনউ। কিন্তু তার সেই আনন্দনগরী যেন কলকাতা শহরে বড় ব্রাত্য। সমান্তরালে রমরমিয়ে চলছে অষ্টমবর্ষে গৌরীদানের সেই নিয়ম। হিন্দু ধর্ম হাঁসফাঁস করছে কুসংস্কার ও জরাজীর্ণ অপভ্রংশজাত শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। মেয়েরা অসম্ভব বঞ্চিত, ব্রাত্য, অবহেলিত। প্রতিবছর নীরবে অকালকুসুমের মতো ঝরে যাচ্ছে অপরিণত নাবালিকারা, স্বামীর ধর্ষণে। রক্ষণশীল সমাজ তা নিয়ে নিরুত্তর। পরকালের দোহাই দেখিয়ে সহবাস সম্মতি আইন তারা কিছুতেই পাশ হতে দেবেন না। হিন্দু শাস্ত্রে বিবাহ বা সহবাসে মেয়েদের কোন সম্মতির অধিকারই নাকি নেই।কিন্তু প্রকৃত শাস্ত্র কী? চতুর্বেদ নাকি বেদোত্তর যুগের সংহিতাগুলি? প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর যে সহজাত অধিকার ছিল, তা পরবর্তীকালে খর্ব হল কেন? এই কাহিনির মাধ্যমে আমি সেই উত্তর অন্বেষণের চেষ্টা করেছি।
বইটি অনুবাদ করছেন অরুণাভ সিনহা। প্রকাশিত হবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়।
তথ্যসূত্র: কলকাতা টুয়েন্টিফোর