লকডাউনের ডায়েরি ॥ বিতস্তা ঘোষাল


অলঙ্করণ: লংরিড

সকাল সাতটা। হুইসেল। জঞ্জাল ফেলার গাড়ি দুয়ারে।বালতি হাতে নেমে আসা, ম্যাক্সির ওপর হাউসকোট চাপাতে গিয়ে মাস্ক ভুলে যাই।মাস্ক পরে নামার অবসরে গাড়ি হাওয়া।চিৎকার করে ডাকা- ওগো এদিকে এসো, নিয়ে যাও যা আছে…।

হ্যাঁ, তখন আসলে নিজের মনে একটা কবিতা আওড়াই-
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
….
ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুসি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!
…..
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি’,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
…..
তরী কী আর ফেরে? বালতি নিয়ে ফিরে আসি পরের ভোরের জন্য।

সকাল আটটা। লিকার চা আদা দিয়ে,দুটো ব্রিটানিয়া বিস্কুট,সঙ্গে সংবাদপত্র। দুধ, পাউরুটি বা রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু আনা সামনের দোকান থেকে।হ্যাঁ, মাস্ক পরি ও বাড়ি ফিরেই হাত পা ধুয়ে স্যানিটাইজার।যা আনলাম সেগুলো ধুয়ে ফ্রিজে রাখা।দুধ জ্বাল দেওয়ার ফাঁকে মোবাইলে নেট অন করা।এক ঝলকে দেখে নেওয়া কোন তারা খসে গেল অকালে।

সকাল নয়টা। কুটনো কাটা ও রান্নার প্রস্তুতি।একটি দুটি রান্নায় আমার মন ভরে না।তাই যতক্ষণ না নিজের মনে হয় এবার খাওয়া যাবে, রেঁধে যাই। এর মধ্যে খানিক সময় নাচ করে নিজেকে ভারমুক্ত করার চেষ্টা।

সকাল দশটা। রান্না অলমোস্ট ডান।বেসিনে পড়ে থাকা বাসন ধোওয়া কমপ্লিট।এবার স্যান্ডউইচ খাবো আর আরেক কাপ লিকার আদা ও এলাচসহ। এগুলোর সঙ্গেই রামকৃষ্ণের স্তব ও গান চলে একনাগাড়ে।বিরতি হীন… ছেদ হীন।সঙ্গে চলে ঝুল ঝাড়া ও আগেরদিনের কাচা জামা কাপড় পাট ও আলমারিতে তুলে রাখি এর ফাঁকেই।

সকাল এগারটা। শাশুড়ি মা উঠলেন।জল, লিকার চা, বিস্কুট দিয়ে নিজেও আরেক কাপ পান। অফিসিয়াল ফোন অ্যাটেন্ড, পরিচিতর খোঁজ নেওয়া চলে।সবসময় একটা অজানা আশঙ্কা, ফোন তুলে খারাপ কিছু শুনব নাতো!

সকাল সাড়ে এগারটা। শাশুড়ি মায়ের ব্রেক ফাস্ট – কর্নফ্লেক্স অথবা মুসলে দুধে ফেলে তাহাতে আমসত্ত্ব কদলী মেখে… নাহ সবসময় আমসত্ত্ব থাকে না।

দুপুর বারটা। রায়চৌধুরী সাহেব ও তার কন্যা লিচ্ছবী মেমসাহেব উঠলেন। রায়চৌধুরীকে দুধ মুসলে,লিকার চা দেওয়া। ম্যাডাম নিজেই দুধ চা বানান। এক ঘণ্টা ধরে পান করার পর ধমক খেয়ে স্যান্ডউইচ অথবা একটুকরো পাউরুটি সেকা মুখে তোলেন।

দুপুর একটা। আরেক কাপ লিকার চা শেষ করে ডাস্টিং।

দুপুর দেড়টা। বাথরুম পরিস্কার (এটা ডেইলি রুটিন) স্নান, ও পুজো।এই পুজোটা ঠাকুরের সামনে নয়।আমি সে অর্থে ঈশ্বর ভক্ত নই।ঠাকুরের সামনে গুজিয়া দেওয়া আমার দ্বারা হয় না।তবে ধূপ দিই। আমার
এই পুজো হল ধ্যান ও মন্ত্র পাঠ, গুরু শ্রী রামকৃষ্ণ ও শ্রী বৈশম্পায়নের সামনে।

পুতুলের আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সন্ধ্যাবেলাগুলোও আমি আর মুক্ত নই।সকালেরই পুনরাবৃত্তি চলছে..।

দুপুর দুইটা পনের। সবাইকে খাওয়ার জন্য আহ্বান।না এলে কুচ পরোয়া নেই। একা খেয়ে নেওয়া।অবশ্য শাশুড়ি মা ডাক অমান্য করেন না।তিনি এ বিষয়ে বৌমাকে যথেষ্ট ভয় পান।কারণ বৌমা রেগে গেলে টানতে টানতে টেবিলে নিয়ে এসে বসিয়ে দেবে।এতক্ষণ পুজো করে যেটুকু শান্তি অর্জন করেছিলেন, সব নষ্ট হয়ে যাবে।তাই তিনি ভারি শান্ত মেয়ে হয়ে খেতে বসে যান। এই দেরীর কাজ তার ছেলে ও নাতনী সর্বদা করে থাকেন।

বিকেল সাড়ে তিনটা। টেবিল গুছিয়ে এবার বিছানায়।একটু নেট সার্ফ ও তারপর চোখ বন্ধ করে ধ্যান।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা। পুতুল এলো।সে আমার গৃহ সহায়িকা।বাসন ধোওয়া,ঘর মোছা,রাতের রুটি এবার সে সামলাবে।আমি নিশ্চিন্ত। তার দেওয়া এক কাপ লিকার পান করে স্নান সেরে পুজো। এরপর সাতটা থেকে ল্যাপটপের সামনে।সে লাইভ ও হতে পারে, লেখাও হতে পারে।এর মধ্যে পুতুল তিন কাপ লিকার চা দিয়ে যাবে,একবার সঙ্গে মুড়ি ও পেঁয়াজকুচি,আদা কুচি, চানাচুরসহ।

রাত নয়টা। সাহেব ফিরলেন।চা পান করবেন।এই চা অবশ্য লিচ্ছবী মেমসাহেব করেন।সেই ফাঁকে এতক্ষণ বন্ধ থাকা হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক চেক করে নেওয়া ।আরও একটু লিখে ফেলি।যদি ইচ্ছে করে।

রাত দশটা। খাবার টেবিল।রাজনীতি থেকে কোভিড-পুরো বিতর্ক সভা।আমি বলি কার্টুন। মাঝে মাঝে বাপ-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যও দেখা দেয়, বিশেষ করে রাজনীতি প্রসঙ্গে।

রাত এগারটা। রান্না ঘর গোছানো,বাসন ধোওয়া,দই পাতা,এলমন্ড ভেজানো শেষ।

রাত এগারটা কুড়ি। অবশেষে এবার বিছানায়।প্রেসারের ওষুধ, ভিটামিন,ও ইনহেলার সঙ্গী।
ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে খানিকক্ষণ দাপাদাপি।
ইচ্ছে হলে বা এলে কবিতা লেখার চেষ্টা।

রাত বারটা।
ঘুমের ওষুধ।নাহ, এখন শুধু ঘুমের ওষুধ বলে কিছু নেই। নার্ভ ঠান্ডা রাখার ওষুধ।
অশান্ত পৃথিবীর মৃত্যু মিছিলে মন বিভ্রান্ত। তাই এই দাওয়াই।অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে।
সাড়ে বারটা থেকে একটার মধ্যে তিনি চোখের পাতা স্পর্শ করলেন ।সেই মুহূর্ত থেকে খানিকক্ষণ ধ্যান পৃথিবীর কল্যাণ কামনায়। অবশেষে পরদিন সকাল সাতটায় দেখা হবে … এই বিশ্বাস নিয়ে রূপকথার দেশে পাড়ি।

পুনশ্চ: এর বাইরে বেশ খানিকক্ষণ আকাশ দেখি। বেল গাছেদের ফাঁক দিয়ে ধূসর আকাশ,কাকেদের সাংসারিক কলতান শুনি,ওদের সকলেই আমি জানলায় বসলেই চলে এসে খেতে চায়।রুটি,পাউরুটি দিই।ওরা হাত থেকেই নেয়।রেখে দিলে ভুলেও মুখে দেয় না।ওরা সব আমার পূর্ব জন্মের সঙ্গী। আমি এ জন্মে মানুষ হয়ে গেছি, ওরা সামনের জন্মে হবে।
আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় কোনও গাছ নেই। তাই গাছে জল দেওয়াও নেই। এই পাখিদের সঙ্গেই আমার ভাব ভালোবাসা।একবার শাশুড়ি মাকে দেখে আসি,গায়ে চাদরটা দিয়ে দিই।অধিকাংশ সময় তিনি প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় শুয়ে থাকেন।ঠিক করে দিই।

ঘুমন্ত মেয়েকে আদর করি।তিনি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে আবার ঘুমিয়ে যান।ঘুমন্ত বাচ্চার শান্ত মুখে, ঠোঁটের কোণে,কপালে ভ্রু যুগলের মাঝখানে,চোখের পাতায় যেন কোটি কোটি বছর ধরে প্রবাহিত ভালোবাসা, স্নেহ আর স্বপ্নের বুনিয়াদ লেখা থাকে।মনে করিয়ে দেয়,সেও এই জগতের বিশাল কর্মকাণ্ডের এক কনা।

পুতুলের আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সন্ধ্যাবেলাগুলোও আমি আর মুক্ত নই।সকালেরই পুনরাবৃত্তি চলছে..।