বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আপাদমস্তক একজন সাম্যবাদী কবি। জাতি,বর্ণ, ধর্ম,গোষ্ঠীর উর্ধে উঠে তিনি তাঁর সাহিত্যকে স্থান দিয়েছেন মানব প্রেম আর জাতীয়তাবাদী চেতনায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে ধমকেতুর মতোই নজরুল বাংলার কাব্য আকাশে উদয় হয়ে বাংলার কাব্যমোদিদের জন্য রেখে যান বিষে ভরা চির বিদ্রোহের বাণী।
সেই বিষের বাঁশির সুরে অর্ধচেতন, দিকহারা স্বাধীনচেতা স্বপ্নিল মানুষগুলো এক নতুন মন্ত্রের ছোয়ায় বিদ্রোহী সাজে জেগে উঠেছিল। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে বিদ্রোহী পোষাকে সেই উত্তাল দিনে নজরুলের এই আবর্তন ছিল নিঃসন্দেহে এক সময়ের দাবি।
একদিকে গোটা ভারত বর্ষে শুরু হয়েছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন,বেঙ্গল প্যাক্ট, সাইমন কমিশন,নেহরু রিপোর্ট আবার পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বিপর্যয়। সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে যেন চলছিল এক নিদারুন মানবিক অস্থিরতার লড়াই। সীমাহীন অস্থিরতার সেই ধূসর দিনগুলোতে এক উত্তাল বিস্ফরোন এর মতোই আগুন হাতে নিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো আবির্ভাব ঘটেছিল এই প্রতিবাদী কবির। সেটা ছিল ১৯২১ সাল।
দারিেদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত স্কুল শেষ না করেই ১৯১৭ সালে নজরুল নাম লেখান ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। শুরু হয় নজরুলের সৈনিক জীবনে আরেক লেনদেন। পরাধীনতা , ভারতবর্ষে উপর জেকে বসে থাকা বৃটিশ ভূত আর সাম্যবাদী চিন্তার শক্ত আঘাত আসে সৈনিক নজরুলের মনন আর চেতনায়। একদিন সৈনিক জীবনের পাতা মুড়িয়ে বিদ্রোহী নজরুল চলে এলেন কলকাতায়। মোসলেম ভারত এবং বিজলীতে একযোগে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অগ্নিঝরা কবিতা বিদ্রোহী।
‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভুমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেদিনের এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আগুনের গোলার মতো ছড়িয়ে পরেছিল বাংলার প্রতিটা এলাকায়। নারী-পুরুষ, জোয়ান-বৃদ্ধ,শিশু-কিশোর সবার মুখে তখন শুধু একই কবিতা, ‘ বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেই দিন হবো শান্ত’।
বিদ্রোহের একি মন্ত্র শোনালেন নজরুল? স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ রাজের লাল ইটের শক্ত দেওয়ালেও এই মন্ত্র বার বার ধাক্কা খেলো। সচকিত হয়ে উঠলো রাজশক্তি। রক্তচক্ষু সরকারি আমলাদের রোষ নেমে এলো নজরুলের ওপর। শুরু হয় নজরুলের ওপর সরকারি গোয়েন্দাগিরী। যার ফলে ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে নজরুলের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ সরকারি রোষানলের শিকার হয়েছিল।
এর প্রথম শিকার কাব্যগ্রন্থ ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে বাংলা ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারা অনুসারে সরকার নজুুরুলের ‘যুগবাণী’ কাব্যগ্রন্থটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। সরকারের ভাষায় গ্রন্থটি ছিল ‘ভয়ঙ্কর’ এবং তাদের দাবি লেখক বইটির মাধ্যমে ভারতে উগ্র জাতিয়তাবাদ প্রচারে নেমেছেন।
‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ হওয়ার বছর দুয়েকের ভেতরই ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘বিষের বাঁশি’। এই গ্রন্থটির ক্ষেত্রেও লেখকের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ। নজরুল দেশের তরুণদের সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছেন এবং আইন অমান্য করতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। সন্দেহ নেই অভিযোগ গুরুতর! তবে নিষিদ্ধ করেও বইটির প্রচার বন্ধ করে রাখতে পারেনি সরকার। গ্রন্থটির উপরের মলাট ছাড়াই কলকাতার বিভিন্ন প্রেস থেকে এটি ছাপা হতে থাকে। বিপাকে পরে যায় ব্রিটিশদের পোষ্য গোয়েন্দার দলগুলো। বলার অপেক্ষা রাখে না যে নজরুল ইসলামের গ্রন্থ সরকারি রোষানলে যতই পরতে শুরু করল ততই যেন বাঙালি যুবকদল এই নিষিদ্ধ কাব্যগ্রন্থগুলোর ওপর তাদের উৎসাহ খুঁজে পেলো। সবার পকেটেই তখন মলাটবিহীন ‘বিষের বাশি’।
‘বিষের বাশি’ নিষিদ্ধ হওয়ার কিছুদিন পরই নিষিদ্ধ হয় ‘ভাঙার গান’। বইটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর। এই বইটিতেও সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায় ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই নজরুলকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে তারা উঠেপরে লাগে।
১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ হয় নজরুল ইসলামের ‘প্রলয় শিখা’। এই কাব্যগ্রন্থটিও ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারায় সরকার বিরোধী বিভিন্ন রকম উসকানিমূলক অভিযোগ পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ের পুলিশ সুপার চার্লস টেগার্ট মুখ্য সচিবকে কাব্যগ্রন্থটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত করার জন্যে চিঠি দেন। তবে এই প্রথম, বইটি বাজেয়াপ্ত করেই থেমে থাকেনি সরকার। এই পুস্তকের মুদ্রণ এবং প্রকাশনার অপরাধে কবি নজরুল ইসলামকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং কবিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কবি এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং গান্ধী আরউইন চুক্তির পরপরই কবি এর থেকে মুক্তি পান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও বইটির উপর বাজেয়াপ্ত আদেশ ঠিকই থেকে যায়।
১৯৩১ সালে ১৪ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় কবি নজরুল ইসলামের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে আর শ্ল্যাষেপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রবিন্দু’।
‘মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুন চন্দ্রবিন্দু”।
অথবা
আমার সুখের গৃহ শ্মশান করে
বেড়াস মা তায় আগুন জ্বালি’
‘চন্দ্রবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল দেশাত্ববোধক তীব্র ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে ভরা একটি কাব্যগ্রন্থ। বিশেষ করে ব্রিটিশদের সহচর দেশি সাহেবদের নিয়ে কৌতূক বিদ্রুপে মেশানো এই কাব্যগ্রন্থটি সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ‘চন্দ্রবিন্দুর’ প্রতিটি কবিতায় ব্যাঙ্গ আর বিদ্রুপের ভাষায় স্থান পায় লীগ অব নেশন, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সাইমন কমিশন রিপোর্ট, প্রাথমিক শিক্ষার বিল ইত্যাদি বিষয়। তবে চন্দ্রবিন্দুর উপর সরকারের রক্ত চোখ খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। ইংরেজ শাষণ আমলেই বইটির ওপর থেকে বাজেয়াপ্তের নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
দেখা যায় নজরুলের মোট পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হলেও পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের ওপর সরকারি আক্রোশ ছিল। সেই গ্রন্থগুলো হলো অগ্নিবিণা, সঞ্চিতা, ফণিমনসা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল। বলাইবাহুল্য সরকারের হাজারো চেষ্টা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কারণেই এই গ্রন্থগুলো অল্পের জন্য বাজেয়াপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যে বৃটিশ বিরোধী উসকানিমূলক কবিতার জন্য ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল কবিকে। দ্বিতীয়বার কবি দণ্ডিত হয়েছিলেন তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতুতে (১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য। কবিতাটি ছাপার জন্য কবিকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারা অনুসারে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ডের সময় নজরুলকে প্রথম প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তারপর কারাদণ্ডের পর তাকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়। এই জেলে থাকা সময়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত ’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। আলিপুর জেল থেকে কবিকে যখন হুগলির জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি জেলের বিভিন্নরকম বৈষম্যমূলক অবিচার আর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই অনশনে কবির শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে।
সারা দেশের মানুষ কবির এই শারিরীক বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বাংলার সর্বত্রই নজরুলকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষেভে ফেটে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্ট্রাল জেলে কবিকে অনশন ভাঙার অনুরোধ জানিয়ে জরুরি তার পাঠান, ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।” শেষ পর্যন্ত কবির মাতৃস্থানীয়া বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে ৩৯ দিন অনশন থাকার পর ২২ শে মে ১৯২৩ সালে নজরুল তাঁর অনশন ভঙ্গ করেন। এর কিছুদিন পরই কবিেেক হুগলির জেল থেকে স্থানান্তরিত করা হয়, বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।
সেখানে শিকল পরেই কবি শিকল ভাঙ্গার গান বাঁধলেন,
‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল’
তবে জেল জীবনে বন্দি হয়ে বদ্ধ ঘরে শিকল পরিয়ে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে কখনো কাবু করা যায়নি। জেলের অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে হেসে-খেলে, আনন্দে-মাতিয়ে কবির সময় কাটতে থাকে। জানা যায় কলকাতার জেল থেকে কবিকে হুগলির জেলে আনা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে। জেলে ঢুকেই কবি হাঁক দিলেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে।’ বলাই বাহুল্য জেলের অন্যান্য বন্দিরা কবি কে কাছে পেয়ে গানে, আবৃত্তিতে, মেতে থাকতেন সবসময়ই। কারণ নজরুল জেল-কারাগার কে কখনই ভয় পাননি, ব্রিটিশ রাজ শক্তিকে কখনোই আমল দেননি। নজরুল ছিলেন প্রেমের কবি, অত্যাচারিতদের পক্ষ হয়ে তিনি সবসময়ই প্রেমের বাঁশিটি যেমন বাঁজিয়েছেন আবার অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহীও ছিলেন তিনি। ধুমকেতুতে প্রকাশিত ‘অনন্দময়ী আগমনের’ যে কবিতাটির জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি পাঠকদের কৌতূহলের কথা ভেবে তুলে ধরছি।
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ’ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..
‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!