যাওয়া-আসার পথের ধারে (পর্ব-৫) ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


কুমিল্লা স্টেডিয়াম এখন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। একে ঘিরে কত যে মিষ্টিমধুর স্মৃতি আমার তারুণ্যের উত্থানকালে মাঝে মাঝে আমাকে উদাসীন করে তোলে, শূন্য করে দেয় বুকের ভেতরটা।

সেই বালকমেলায় যখন জ্ঞান হয়েছে, ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর আর আনন্দ-কষ্টের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছি, তখন থেকেই এই স্টেডিয়ামের সঙ্গে গভীর ভালোলাগার বন্ধনে বাঁধা পড়েছি। সেই বন্ধন আজও অটুট, আজও কুমিল্লায় ফিরলে সেখানে যাই। এর পেছন দিকটাতেও যাই। এখন আর কোনো কেনাকাটার জন্য স্টেডিয়াম মার্কেটে যাই না, শুধু দেখার জন্য যাই, স্মৃতির ঘ্রাণ শুকতে যাই। যদিও স্মৃতির কোনো ঘ্রাণ হয় না কিন্তু বুকের ভেতরে কম্পন তোলে।

অতীতের প্রতি নিদারুণ কাতর করে তোলে। প্রকম্পিত হই, আন্দোলিত হই, অম্লমধুর বেদনায় লীন হয়ে পড়ি। একা একা হাঁটতে হাঁটতে কত দৃশ্য চোখের সামনে নড়েচড়ে উঠে দেখতে পাই।

সেই বালক বয়সে, যখন আমরা ছোটরা পাইক পুকুরের পাড়ে থাকি, ভানু মামার বড় বাড়িতে, যেখানে একটি উঠোনের চারদিকে কয়েকটি টিনের চালাঘরে আমরা ৫-৬টি পরিবার বসবাস করি। সবাই হিন্দু এবং বিভিন্ন পেশার। আমি বলি গুচ্ছবাড়ি। সবাই ছিলাম আমরা একটি বৃহৎ পরিবারের মতো। লক্ষ্মী মাসি যিনি আমাদের লাগোয়া ঘরে থাকতেন, তার অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়েটি আভা রানী নাম, আমার বয়সী, ভানু মামারও বড় মেয়ে অঞ্জনাও আমার বয়সী আর ছিল দীপক সহপাঠী। কৃষ্ণও ছিল সে দুই বছরের ছোট ছিল। কিন্তু আমরা ছিলাম অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আভা আর অঞ্জনা স্বাধীনতার আগেই চলে গেল ত্রিপুরা তথা আগরতলা ভানু মামা যখন চলে যান সপরিবারে বাড়ি বিক্রি করে তখন। লক্ষ্মী মাসি ভানু মামারই ছোট বোন। এর পর আর কোনোদিন দেখা হয়নি ওদের সঙ্গে। দীপু আর কৃষ্ণর সঙ্গে এখনো দেখা হয়।

স্টেডিয়ামের পেছনে তথা ধর্মসাগর দিঘির পূর্ব পাড়ে একটি কি দুটি হিন্দু পরিবারের বাস, তাদের একটি মন্দির আছে। কালী মন্দির। জানা যায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা একবার স্বপ্নে দেখলেন কালীদেবীর কষ্টি পাথরের একটি বিগ্রহ ধর্মসাগরের উত্তরপূর্ব কোণে জলের তলে পড়ে আছে।

সেটাকে তিনি খুঁজে তুলে নিয়ে এনে একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। সে বহু বছর আগের কথা। তারপর নিয়মিত পুজো-অর্চনা-উপাসনা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে শহরের হিন্দুরা এসে পুজো দিতেন। কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, মনসাপুজো, সরস্বতী পুজো, দুর্গাপুজোসহ বাৎসরিক রাস উৎসব এবং নামকীর্তন অনুষ্ঠিত হতো। জমজমাট ছিল এই কালীবাড়িটি এক সময়। এখনো মনে আছে, আমরা মা-মাসির সঙ্গে দল বেঁধে যেতাম পুজোতে আর উৎসবে। কলার পাতায় করে সুস্বাদু খিচুড়ি আর মিষ্টি দইয়ের প্রসাদ খেতাম। বৈষ্ণবদের নাচ দেখতাম।

সবুজ গাছগাছালিঘেরা বড় উঠোনের উত্তর দিকে মন্দির ঘিরে একাধিক ঘর। তারপর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ভেঙে পড়া ঘাট, ছেলে-মেয়েদের দাপাদাপিকরা স্নান। সারাদিন হৈচৈ, গানবাজনা, খাওয়াদাওয়ায় মুখর থাকতো এই বাড়িটি। এখন একেবারেই ভিন্ন পরিবেশ, লোকজনও নেই, জৌলুসও নেই। দালানকোঠা উঠে বিসদৃশ অবস্থা ধারণ করেছে। তবুও যাই বাল্যস্মৃতিবিজড়িত মন্দিরটি পরিদর্শনে।

শীতকাল এলেই দুটি কারণে আমাদের বালকমনপ্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠতো। একটি দুর্গাপুজো অন্যটি একজিবিশন। কী ঘটা করেই না পুজো হতো পাক আমলে! স্বাধীনতার পর সেই উন্মাদনাটিই হারিয়ে গেল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল পাকসেনা আর রাজকাররা মিলে কালীবাড়িটি। মন্দির ভেঙেছে, বিগ্রহ উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। লোকজন মেরেছিল কিনা জানি না। যাহোক, স্বাধীনতার পর পুনরায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পূর্বপরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন বাড়ির মালিক। আবার পুজো-অর্চনা-উপাসনা আর রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। আমরা যেতাম। আনন্দফূর্তি করতাম। তখন কালীবাড়ি সংলগ্ন স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশের বড় ফটক ছিল, ঢোকাও যেতো। কোনো বাধা ছিল না। কালীবাড়ির গোরু-ছাগল স্টেডিয়ামের কিনারে বেঁধে রাখা হতো, ঘাস খেতো সারাদিনই। আমরাও কালীবাড়ির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতাম, ডাংগুলি খেলতাম, ফুটবল খেলতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম স্টেডিয়ামের কিনারে।

তবে জাতীয় ফুটবল ও ক্রিকেট প্রতিযোগিতার সময় ফটক বন্ধ করে দেওয়া হতো যাতে কেউ বিনা টিকিটে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু আমরা ঢুকে যেতাম, গেট কিপার কিছু বলতো না। তখন পশ্চিম দিকে গ্যালারি ছিল না। লোকজনও সেদিকে আসতো না। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া ছিল আমরা বেড়ার বাইরে বসে খেলা দেখতাম। তবে পশ্চিম-উত্তর কোণে একটি দোতলা ছোট্ট দালানঘর ছিল, এখনো আছে, সেখানে বসে কিছু দর্শক খেলা দেখতেন।

স্টেডিয়ামের উত্তর পাশে ঈদগা সেখানেও শীতকালে ক্রিকেট খেলতো শহরের তরুণরা। আমরা দেখতাম। কালীবাড়ি সংলগ্ন পাবলিক হেলথ অফিস, পানির ট্যাঙ্ক। এখানেও কত স্মৃতি আমার!