এই তুমিই সেই তুমি ॥ তাহমিনা কোরাইশী


চিত্রকর্ম : সমর মজুমদার

পুরানো ঢাকার এককালের আদিবাসিন্দা রহমতউল্লাহর পূর্বসূরীরা। রহমতউল্লাহও জীবনের সুন্দর সময় পার করেছে। যুগের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে বেতাল হয়ে গেছে রহমতউল্লাহর মানসলোক। দোষ কাউকেই দিতে চায় না। না দিয়েও আবার চিত্তে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি বিক্রি করে চলে আসতে হয়েছে ধানমন্ডি এই অভিজাত এলাকায়। পেয়েছে কেবলমাত্র দুটো অ্যাপার্টমেন্ট। অবশ্য বেশ বড় অ্যাপার্টমেন্ট। প্রায় সাতাশশ স্কয়ার ফুটের দুটো অ্যাপার্টমেন্ট, আর কিছু টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে। একটি মাত্র পুত্র সন্তান। তার কাছেই হার মেনেছে। পুত্রবধূ আর দুইটি নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার। স্ত্রী-বিয়োগ বেশ আগেই। ছেলেটি ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালে কাজ করে। বিকেলে প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে। তার স্ত্রীও চাকরি করে। চার পাঁচ বছরের মৌমিতা আর মাহিমকে নিয়ে ভালোই আছেন। ছেলে মনোয়ার আর তার স্ত্রী ইলোরার প্রচণ্ড ইচ্ছেতেই রহমতউল্লাহর এই স্থান পরিবর্তন। সব কিছুর সাথেই সমঝোতা করতে পেয়েছে সে। শুধু পারেনি এই পোড়া মনকে বশে আনতে।

স্ত্রী বিয়োগের পরে অনেকেই বলেছে- কী এমন বয়স হয়েছে রহমতউল্লাহর, আবার বিয়ে কর। কিন্তু তখন কথাটা মনঃপূত হয়নি তার। কিন্তু আজকাল তার দিনগুলো কাটে না আর। অফুরান সময়। সকালে লেকের পাড়ে হেঁটে আসে ঘণ্টাখানেক। তারপর প্রাতঃস্নান সেরে নাস্তা তার সাথেই আবার অনেকক্ষণ ধরে পেপার পড়া। পেপারের নাড়ি-নক্ষত্র সবই শেষ করে। আর কাজ খুঁজে পায় না। স্মৃতির চর্বিতচর্বণ ছাড়া কিছুই করার নেই। অবশ্য বিকেলবেলা ঐ লালমাটিয়ার একটা ক্লিনিকে বসে। শুধু জানা ছিল সেই হোমিওপ্যাথি বিদ্যাটা। ঐ চর্চাটাই ঘষে-মেজে রাখা, আর একটু ব্যস্ত থাকার প্রচেষ্টা। অল্প বয়সে বিবাহিত জীবনের শুরু হয়েছিল তাই হয়তো মনের মাঝে এখনও দাপিয়ে বেড়ায় যৌবনের ঘোড়া। বয়স এখনও ষাট ছুঁতে পারেনি। মনে এখন পঁয়ত্রিশ বছরের আগুন দাউদাউ করে জ্বরে। যদিও চেহারায় কিছুটা ভারিক্কি আনার চেষ্টা করে থাকে। সঙ্গীহারা রহমতউল্লাহর নিঃসঙ্গ জীবন ভীষণই পীড়াদায়ক।

প্রতিদিনের হাঁটাপথে নানা কিসিমের লোক দেখে। বেশ খানিকটা সময় হেঁটে গল্প করে পার করে দেয়। হঠাৎই হাঁটা পথে একটি চেনা মুখ বারবার চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিল। এভাবেই দুটো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর। সাহস যোগাতে তৃতীয় দিনে পা দিল- যা আছে খারাপি আইজ কথা কইয়্যাই ছাড়ুম, রহমতউল্লাহ্ ভাবে।

মধ্যবয়সী বেশ সুন্দরী এক মহিলা। কতকালের চেনা মুখ। স্মৃতির ধুলোয় চাপা পড়ে ছিল। আজ স্পষ্টই চেনা যাচ্ছে তাকে। এই কয়েক দিন ধরেই এই মহিলাকে চোখে পড়ছে। এর আগে তো দেখেনি। আজ কথা বলতে হবে। সকালের মিঠে আলোয় ওর মুখটা চকচক করচে। এই যে ম্যাডাম ইকটু খাড়াইবেন। হ্ আপনারেই কইত্যাছি।
মহিলাও পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে যায়। বলে-
ক্যালা হামারে ডাকছিলেন?
– হ্যাঁ, আপনারেই ডাকছি। খুব চিন পরিচিত লাগতাছে।
– হায় আল্লাহ্! এইডা রহমতউল্লাহ্ ভাই না? নিবিড়ভাবে দেখে।
– হায় হায়, তুমি চুমকি বেগম না?
– কতকাল পরে দেহা। আমি তো ভাবছিলাম আপনি ভি মইরা ভূত হইয়া গেছেন। এই জীবনে আপনার লগে আর দেহা-সাক্ষাৎ হইব না। মাগার পিরথিবিটা গোল চক্কর খাইয়্যা দেখা হইয়াই গ্যেছেগা।
হো হো করে হাসতে থাকে রহমতউল্লাহ প্রাপ্তির আনন্দে। পুরনো প্রেমিককে কাছে পেয়ে।
– আগের লাহানই কটকটির অভ্যাসটা যায় নাইক্যা। পটরপটর খালি কথার খই আছিল তোমার মুখে, অহনতরি ছব ঠিকই আছে। আর এই তিনদিন তোমারে ফলো করতাছি। মাগার শরমে ডাকবার পারতাছি না। চড়-থাপ্পর খাই নাকি! আইজ ভাবছি আইজ জিগামু, যা আছে খারাবি কপালে।
– আইছ্যা এলায় রকন, থাকেন কই? লাল টুকটুক পান খাওয়া মুখে টুকটুক হাসিতে রসালো অভিব্যক্তিতে জানতে চায় চুমকি বেগম। ভীষণ উদগ্রীব হয়ে।
– আরে খাড়ো খাড়ো কইতাছি। চলো, ঐ শান বাঁধানায় বইস্যা লই। অনেক হাঁটছি, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে- রহমতউল্লাহ্।

লেকের পাশেই শান বাঁধানো স্থানটিতে বসে দুজন। আজ ফেলে আসা দিনগুলোর আনন্দ মনের কোণে আকুলিবিকুলি করছে।
– শুনো, আমার কি বাড়ি আছে? পুরান ঢাকার জমি, ঘরবাড়ি বিক্রি কইরা এই ধানমন্ডিতে দুইটা পাখির বাসা কিনছি। বাবুই পাখি আছে না? ছুইন্যে ঝুলতাছি। বাবুই পাখির লাহানই।

চুমকি বেগম হেসে কুটিকুটি সেই আগের মতন। খুব মনযোগ দিয়ে রহমতকে দেখে আর বলে, ভালোই কথা হিখচেন। খালি ঘাইরা মাছই গু খায় না। আমারে কটকটি বেগম কইতেন। মাগার এলা দেখাতাছি কথার জোয়ার লাগছে মুখে।
হো হো করে হেসে উঠে রহমতউল্লাহ্। ঠিকওই কইছ, খাটি কথা ভি কইছ। অনেকদিন কথা জমাইয়্যা রাখছি। আইজকা হালায় তোমারে পাইয়্যা আমার মুখে তুফান ছুটছে।

অনেকক্ষণ কথা হয় ওদের। কথা যেন কারো ফুরাতে চায় না। ঠিকানা আদান-প্রদান করে। ওরা পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দা।ব্রিজটার এপারে-ওপারে দুটো অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে ওরা। রহমতউল্লাহর অ্যাপার্টমেন্টের নাম “ড্রিম অ্যাপার্টমেন্ট” ফোর্থ ফ্লোরে থাকে তারই মুখোমুখি “শান্তির নীড়” অ্যাপার্টমেন্টের ফোর্থ ফ্লোরে থাকে চুমকিরা। বেশি দিন হয়নি ওরা এসেছে।

রহমতউল্লাহ্ জেনে নিল বাড়িতে আর কে কে আছে। জানতে চাইল আমার ভিলেন আছে নাকি? কি করেন সাহেব? চুমকির চেহারায় এখন কিছুটা বিষণ্নতা চেয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- দুইটা কিডনিই ড্যামেজ হইছিল। চিকিৎসার কমতি করি নাইক্যা। ম্যাচ করা কিডনি পরে পাইছি। কিন্তু অপারেশন করবার পরে ঠিক কাজ হয় নাইক্যা। মানুষটা কেমন কইরা নির্জীব হইয়া গেল। ডাইল্যাসিস করছিল বহুতদিন। মাগার বাঁচাইবার পারলাম না। পয়সা তো পানির লাহানই গেছে। হাসপাতাল ডাক্তার কইরাই দশটা বছর গেছেগা।

প্রসঙ্গ বদলাতে রহমত বলল- রিয়ার পরে আর তো দেখি নাইক্যা। আছিলা কই? বাছা কই আছিল?
-বনানীতে আছিলাম। জমি বাড়ি-গাড়ি বেবাকই ছিল, সবকিছু বেইচ্যা দিছি। তারপর এই অ্যাপার্টেমন্ট কিনি। আর পোলা তো একখন। সেও জিদ ধরল বিদেছে চাকরি করব। বেছি টাকা কামাইব। বউও চাকরি করে। দুইটা নাতনি লইয়া আমি আছি। আমার আর একটা মাইয়্যা আছে ভার্সিটিতে পড়ে।

রহমতউল্লাহ্ আর চুমকির কথা শেষ হয় না। হাঁটতে হাঁটতে ওদের অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই চলে এসেছে। হাতের ইশারায় অ্যাপার্টমেন্ট দেখিয়ে দেয় দুজনারটাই দুজনে।

রহমতউল্লাহ্- এত কাছে থাকি! জানালা দিয়া উঁকি মারলেই তো তোমারে দেহন যাইব।
চুমকি- হায় আল্লহ একেবারে ছদরঘাট! তোমার ব্যালকনি থাইক্যা আমার ব্যালকনি তো মুখামুখি।বাশের কঞ্চির মধ্যে বাইনধ্যা খাওনভি পাঠান যাইব। রহমউল্লাহর সেই হো হো হো হাসি। আজ রহমত আর চুমকির জীবন যেন ছন্দায়িত হলো। কিছুটা হলেও নি:সঙ্গতা আর একাকিত্ত্বের আঁধার কাটল।

আজ থেকে প্রতিদিন লেকের পাড়ে হাঁটাহাঁটি তারপর প্রাতঃকালীন নাস্তা। কোনোদিন চুমকির বাড়িতে কোনোদিন রহমতউল্লাহর বাড়িতে। এভাবে বেশ আনন্দেই ওদের দিনগুলো কাটছিল। ঐ সময়টা রহমতের বাড়ি এবং চুমকির বাড়িতে কেউ থাকে না। চুমকির বাড়ির বউ যায় চাকরিতে, মেয়ে ভার্সিটিতে আর দুই নাতনি স্কুলে আর ছেলে তো বিদেশে। শুধু কাজের একটা বুয়া। চুমকির কাজের বুয়ার অবাক বিস্ময়। নারীস্থানে পুরুষের আগমন। এ বাড়ির নাম দিয়েছে ওরা নিজেরাই ‘নারীস্থান’। একটি পুরুষের অস্তিত্বও নেই। তেমন কেউ আসেও না। এমন নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট একটি বাড়ি। খুব কৌতুহল নিয়ে দেখে সখিনা এই ভদ্রলোকটিকে। তার আগমনে খালাম্মার মনের অবস্থা। তাকে কী খাওয়াবে। কী করবে এ নিয়ে একেবারে অস্থির। সখিনা ওদের পুরোনো বুয়া। অনেক বছর ধরেই আছে। খালাম্মার স্বামী মারা যাওয়ার আগে থেকে এ বাড়িতে। এর মধ্যে চুমকির এই পরিবর্তন ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। যথারীতি ছেলের বউ মাধবী স্কুলের কাজ শেষে বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় ফিরেছে। বাতাসের আগে মাধবীর কানে পৌঁছে যায় খবর।

ঝুমুরী আর বিজলীর গোসল, খাওয়া এবং নিজের কাজ শেষ করে বেশ চিন্তিত করে তোলে মাধবীকে। এমন একটি ব্যাপার মা কেন লুকোচ্ছেন। তাকে তো বলতেই পারত তার পূর্ব পরিচিত বা কোনো আত্মীয় হলে। কিন্তু সেটা লুকানোর মতো ব্যাপরে বলতে পারছে না। এই বয়সে প্রেম বা অন্য কিছু, এবসার্ড়! মাধবী ভয় পেয়ে যায়! মায়ের ব্যাংকে কিছু টাকা পয়সাতো আছে। কোনো ফেউ-এর পাল্লায় পড়ল কিনা প্রথম সন্দেহটা ঐ জায়গায় আটকে থাকে। চিন্তা করতে থাকে মাধবী। প্রথমে যার কথা মাথায় আসে সে তার স্বামী।

তারই মায়ের প্রসঙ্গে, যে কারণে মাহমুদকে ফোন করে বুদ্ধি নেবে ভাবছে ওটাই শ্রেয়। বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মাহমুদের মাথাও ঐ একই চিন্তা। বাড়ি বিক্রির কিছু টাকা তো আছেই মায়ের ব্যাংকে। মাধবীকে সাবধান করে দেয় মাহমুদ- খুব বেশি খেয়াল রেখো। কোনো চিটারের পাল্লায় পড়েছে কিনা। আর কথাটা তোমাকে বলেনি ভাবা যায় না। এমন ইররেসপনসিবল তো মা হবে না। তোমার কাছে লুকোনোর মতো ব্যাপার কী হতে পারে। মাহমুদও চিন্তায় পড়ে যায়।

যাক্ তুমি চিন্তা করো না, আজই মায়ের সালে আলাপ করব- মাহমুদকে জানিয়ে রাখল মাধবী। মা এবং মাধবী মুখোমুখি বসে আছে,
– মা, কোনা সমস্যা হচ্ছে না তো? আমি ঠিকমত আপনাকে দেখতে পারছি না। আমতা আমতা করতে তাকে মাধবী মায়ের সামনে। হাজার হলেও শ্বাশুড়ি, কীভাবে কথাগুলো পড়বে।
– বউমা, এইখানে আমার কাছে বসো। কিছু কওবার চাওনি?
– সখিনা কিছু কইছে নাহি?
মাথা নিচু করে বলে- হুঁ…।
– কাজের ছেমড়ির কথা বিশ্বাস করছনি?
– না, মা, তেমন কিছু না।
– তোমারে খবরটা জানান দিমু। সময় পাই নাইক্যা। কিছুক্ষণ চুপ করে আবার বলতে আরম্ভ করলেন।
– আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের ঐপারে, মানে মাঝে রাস্তার ঐপারে “ড্রিম অ্যাপার্টমেন্টে” থাকে। আমাগোর পুরান ঢাকার দীননাথ সেন রোডের রহমতউল্লাহ। একই পাড়ায় আমরা পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দা আছিলাম। সকালে হাঁটতে যাই, তখন দেখা তার লগে। এই আর কি? হ্যাঁ ও এই বাড়িতে আইছে, আমি ভি গেছি হ্যার বাড়িতে।

মাধবী অতি সাধারণ অভিব্যক্তিতে বল- আল্লাহ্, মা এই কথা। আমাকে আগে বলে রাখতে পারতেন। কেমন একটা ভুল বোঝাবুঝি হলো। স্যরি মা। আসলে দিনকাল যেমন পড়েছে। তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনো অসুবিধা নেই আঙ্কেলকে আসতে বলবেন। ভালোই হলো- পরিচিত মানুষ পাওয়া গেল কাছাকাছি।

বউমার কথা শুনে বুকের ভেতরে ঢোলের মতো ডুগডুগিটা কমলো। সত্যি কি তাই? তাই যদি হবে তবে বড় গলা করে সবার সাথে পরিচয় করে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড করা যেত না! মনের মাঝে একটি চোর লুকিয়ে আছে। সুযোগ বুঝে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে। প্রতিদিনের পঞ্জিকায় আরো একটি করে দিন যোগ হতে থাকে। আজকাল রহমতউল্লাহ্ ফিরে গেছে যৌবনে চুমকি বেগমের সান্নিধ্যে। প্রতিদিনের প্রাতঃভ্রমণ, একসাথে নাস্তা, গল্প আরো বেড়ে গেল। একটা দিনও যেন তাদের দেখা না হলেই নয়।

রহমতউল্লাহর বাড়িতে একই প্রশ্নের সম্মুখীন ছেলের কাছে বাবা। পুত্রবধূ ইলোরাকে জানিয়েছে কাজের ছেলে নূর আলী। ইলোরা শ্বশুরকে কীভাবে বলবে। তার স্বামীকে কথাগুলো বলে। মনোয়ার ভীষণভাবেই রিয়াক্ট করল। বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন- এসব কি শুনছি বাবা? লজ্জায় তো আমাদের মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। কে সে? কোন এক মহিলা আসে এ বাড়িতে। আর তার সাথে আপনি প্রতিদিন হাঁটেন। কেন কোনো পুরুষ বন্ধু কি হয় নি আপনার? রাগে কাঁপছে মনোয়ারের গলা। বাবার উত্তর শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

রহমতউল্লাহ্ বেগতিক দেখে- জোরে জোরে হাসতে থাকে। আর হাসতে হাসতে বলে- আরে আমার সাহেব পোলা, চেতছো ক্যাল্যা? আমার আসলেই ভুল হইছে তার পরিচয় তোমাগো না দেওনে। হে হইলো আমাগো পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার মাইয়া চুমকি বেগম। পাশাপাশি বাড়িতে আছিলাম। কবে বিয়া হইয়া গেছে। জামাইটাও মইরা গেছে। এই সামনেশান্তির নীড়ে অ্যাপার্টমেন্ট কিন্যা লইছে। পোলাার বউ আর একটা মাইয়া আর নাতি দুইটা লইয়া থাকে। এই আর কি। বিহান বেলা হাঁটতে গিয়া দেখা হইছে। বাড়িতে আইছে। আমি ভি হেগো বাড়িত গেছি। – মনোয়ার আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। সে বলে- সত্যি বাবা, ভুল হয়ে গেছে, মাফ কইরা দিয়েন।
– যাউকগ্যা। মাফ কইরা দিছি। চিলে কান লইয়া গেছে হুইন্যা চিলের পিছন লোড় পারবা নাকি?
মনোয়ার বলল- না বাবা, তা তো নয়। কিন্তু তোমরও ভুল ছিল আন্টিকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাওনি।
– এইটা কইলাম ঠিকই কইছ। থাউকগ্যা এর পরে পরিচয় করাইয়া দিমুনে। এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলো রহমতউল্লাহ্। এরপর কি হবে। কিভাবে বাঁচবে। মন চায় আরো কাছে যেতে। সারাটা দিন ওর কাছে থাকতে।

রহমতউল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তো সেই সময়ই ওর সাথেই বিয়ে হতো এই চুমকি বেগমের। রহমত চুমকিকে পছন্দ করত ঠিকই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাবাকে বলতে পারত না। চুমকি তো একেবারে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বসেছিল বিয়ের জন্য। সত্যি সত্যি যখন অন্য ঘরে বিয়ে হয়ে চলে গেল রহমতউল্লাহর সাড়া না পেয়ে, তখন রহমত ওর প্রেম ঠিক উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল রহমত। রহমত ভেবেছিল কিছুদিন কী ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারল না। প্রেমের আগুন প্রতিদিন ওকে দাহন করেছে। আর তো পাবে না তাকে। তাই মায়ের পছন্দের মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করেছিল। মনের কোনে তবুও এই প্রেম উঁকি-ঝুঁকি দিয়েই যেত। আর দেখা হয়নি চুমকির সাথে। চুমকিও বাবার বাড়ি বেড়াতে এসছে, কখনও দেখা করতে যায় নি। দীননাথ সেন রোডে এই ছেলেটার সাথে যে তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করেছিল। চুমকির মনে বদ্ধমূল হয়েছিল রহমত নয়, চুমকিই ওকে বেশি চেয়েছিল মন প্রাণ দিয়ে। রহমত তেমন করে ওকে চায় নি, চুমকির ধারণায় রয়ে যায়।

এদিকে রহমত ভেবেছিল, যদি চুমকি সত্যি ভালোবাসত- তবে একটু সময় দিল না কেন ওকে বোঝায়। চুমকি মনে মনে ভেবেছিল রহমতউল্লাহর এই প্রেম ওর নসিবে নাই। চুমকি তাই জেনেছে মনেপ্রাণে। রহমত চুমকিকে হারিয়ে দুঃখ-ক্ষোভে নিরানন্দ একজন হয়ে রইল। চুমকি চলে যাওয়ার পর ওর মনে হয়েছে চুমকির জন্য এত কেন কষ্ট হচ্ছে এই বুকটার ভেতরটায়! মনে হয়েছিল- সত্যিই তো চুমকিকে সেও ভালোবেসে ফেলেছিল।

এতকাল পরে সেই চুমকিকে হাতের নাগালে পেয়ে মনে জেগে উঠেছে সুখের নতুন চর। বাঁধবে ছোট্ট ঘর ভালোবাসার। কিছু তো লুকিয়ে আছে বিধাতার মনে, তা না হলে এমন করে শেষ প্রান্তে এই মুখোমুখি। দোষ খুঁজে পায় না রহমতউল্লাহ নিজের না চুমকির না কি প্রকৃতির না পরিবেশের। নাকি ইঙ্গিত ঐ বিধাতার।

মনকে বেঁধে রাখতে পারে না রহমতউল্লাহ্। চুমকি যদিও পারে বার হাত শাড়ির বেড়িতে নিজেকে বেঁধে রাখতে। রহমত তার ইচ্ছের কথা চুমকি বেগমকে জানায়। চুমকি নীরব। শুধু দুই চোখে জলের ধারা। সেই জলে বয়ে যায় তার মনের ব্যাথা।
রহমতউল্লাহ্ বলে- কী কইবার চাও? সমাজের বেড়িবান্ধে আটকাইয়া গেছি? ছরম পামু এই বয়সে বিয়া করলে?
চুমকি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলে- ঠিকই কইছ আমাগো বয়সের ধর্ম কি পারমিছন দেয় এই বয়ছে বিয়া?
একঘৈরা কইরা দিব না হ্যারা আমাগো?
– ছমাজ ধুইয়্যা পানি খামু। নিজেগো স্বাদ-আল্লাদ নাইক্যা? ছবকিছু বিছর্জন দিমু ক্যালা?
– তোমার লাইগ্যা আরেক জনমে আমি অপেক্ষায় থাকুম। এই জনমে যদি না পাই না পামু। মাগার ছমাজের কাঠগড়ায় খাড়াইবার পারমু না।

চুমকি আবার বলে- ছমাজ লাগবে না। মাগার আমার বাইত্তে আমি কিছু কইবার পারুম না।
রহমতউল্লাহ্ বলে- আইজ আলাপ করমু পোলার লগে। চুমকি আগেই স্যারেন্ডার কর বসে আছে তার ছেলে তার বউ তার মেয়ে নাতনি দুটো কারা সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। তাই ওরা দুই বাড়িতে দুই বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। চোখের দেখায় মনের কথা তো বলা যাবেই।

রহমত কিছুতেই মানতে রাজি না এই প্রস্তাব। বলে- ক্যালা, ওগো লগে থাকুন লাগব না। আমার আরো একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে না! ঐডায় ভি থামকু বুইড়া-বুড়ি। চুমকি মিটমিট করে হাসে। ওর সাহসের প্রশংসা করে মনে মনে। সবকিছু ছেড়ে দেয় রহমতউল্লাহর ওপর। সত্যি সত্যি রহমতউল্লাহ্ ছেলের সাথে আলাপ করে। ছেলে, বউ সবরাই ঘোর আপত্তি। ঐ বাড়িতেও একই অবস্থা। সম্পর্কের মজবুত সুতোয় টানাপোড়েন। শান্তির নীড়ে আর ড্রিম অ্যাপার্টমেন্টের সুখের স্বপ্নগুলোর অপঘাতে মৃত্যু। এমনি ঝড়ে দুই গৃহে বন্দি দুজনা। চলছে শুদ্ধি অভিযানের ঝাড়াপোছা। এ তো মাকাল ফলের চারাগাছ নয়।

প্রেমের আলো-বাতাস বীজের অঙ্কুরোদগম। মূল উৎপাদনের চেষ্টা। এর মধ্যে চুমকি-রহমতউল্লাহ্ পথ করে নিতে পারবে কি? কেউ কি বুঝেছে ওদের মনের দাবানলে সবুজ বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। নির্মল আনন্দের একটি ধারার পথে বাঁধ দেওয়া হলো। নিয়মের গণ্ডি বলে- বনবাসী সীতার গণ্ডি বেঁধে দিল দু’বাড়ির লোকজনেরা।
এই সমাজ কিছুক্ষণের সুখ এনে দিতে পারত কি ওদের জীবনে? কেউ নেই ওদের কাছে ওদের ইচ্ছে পূরণে এগিয়ে আসার। ইচ্ছে পূরণ দেবীর কাছে কায়মনোবাক্যে বর চাইতে পারে। “ফিরে পেতে চাই সেই যৌবনের দিনগুলো। ভেসে যাব মনের নৌকায় আশায় বৈঠায় ভর করে এই আমরা দুটিতে।”

ইচ্ছে পূরণ দেবী হয়তো শুনেছিল ওদের ইচ্ছার কথা এমনও তো হতে পারে। দু’বাড়িতে ঝড়ের মাতম কমেছে অবশেষে। হেমন্তের মিঠেল বাতাসে ফুরফুর তালে বইছে। শেষমেশ বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠলো দুই বাড়ির মানুষ। তেমন ঢাক ঢোল বাদ্যি বাজনা না হোক অতৃপ্ত মনের গাঁট বন্ধন হলো একই সুতোয়। দুই পরিবার থেকেই জন্ম নিলো একটি বড় একান্তবর্তী পরিবার। যেখানে অনেকগুলো সত্তা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ জীবন আর কত দিনের? শোকে তাপে দগ্ধ হয়ে জীবনের অনেকটা পথ শেষ হয়েই যায়। কিছুটা সময় যদি আনন্দে রসে ভিজে থাকা যায় মন্দ কি? বর্ষার কদমে বর্ষণ ঝড়ে অজস্র ধারায় স্মৃতির পাতায় মন ভিজে যায় আনন্দ গাথায়। ক্ষতি কি নতুন জলে মুগ্ধ নয়ন জলকেলিতে? আরো কিছুক্ষণ ধরার বুকে হলুদ গাদার মালায়। নিজেতে রাখতে ধরে যে সুখ তা কি ঝরা পাতার কাব্যে আছে!
ওদের ভালোবাসার উষ্ণতায় দুইপক্ষের শীতল বরফ গলে জল হয়েছে। সবার উপর প্রেম সত্য তাহার উপর নাই। এই উপলব্ধিতে রহমতউল্লাহ্ আর চুমকির জীবনের খাতায় নতুন অধ্যায় রচনা হয়তো হয়েছিল সেদিন।