প্রবীর বিকাশ সরকারের অপহাহ্ণে বৃষ্টি উপন্যাসটি পড়লাম। নায়ক শংকরলাল মজুমদার আর নায়িকা বীথিকা রায়। একটু বড়, তিন পর্বে ভাগ করা। তবে দুই দিনে শেষ করে নিলাম। বাসায় বসে খুব একটা পড়ার সময় পাই না। তাই ট্রেনের যাতায়াতের সময়টুকুরই সদ্ব্যবহার করতে হলো।
আমার কাছে আমাদের এই দ্বিমাত্রিক পৃথিবীতে ‘সময়’কে আমরা ত্রিমাত্রিক বলতে পারি হয়তো বা। কেননা ‘সময়’ আসলে কী আমরা হয়তো এখনও ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি। বলতে চাইছি, সময় একটু একটু করে যদি না গড়াতো তাহলে কিন্তু জীবনের অস্তিত্বই থাকতো না। আর সৃষ্টিকর্তার শক্তিকে আমরা চতুর্মাত্রিক বলতে পারি নিঃসন্দেহে। কেননা তা আমাদের বোধেরই বাইরে। জাগতিক দ্বিমাত্রিক অনুভূতি দিয়ে তো আর চতুর্মাত্রিক কিছু বোঝা যায় না, তাইনা।
যাই হোক ‘অপহাহ্ণে বৃষ্টি’ উপন্যাস পড়ার সময় আমার এর কাহিনির সারাটা অংশজুড়ে থাকা ‘অভিমান’কে কিন্তু এই ত্রিমাত্রিক কিছু বলেই মনে হয়েছে। এজন্যই বলছি যে, এর অমোঘ শক্তির কী জোর, বলুন তো দেখি! মনের এক জটিল সংবেদনশীল অনুভূতিই হয়তো বা অভিমান। আর এমনই এক জিনিস এই ‘অভিমান’ যা নায়ক-নায়িকাকে কত বছর ধরে দূরেই কেবল সরিয়ে রাখলো। একজন ভেবে গেল, না বললেও বুঝে নিতে হবে। ভালোবাসি কথাটা বলে কেন সস্তা করবো। আর একজন মনে করলো, কেন বললো না, মনের গহীনে প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে চলে গেল দূরে।
এর মাঝখানে আর একটি বিষয় কিন্তু পুরো উপন্যাসজুড়ে খেলা করে গেছে। তা হচ্ছে শুধু নিজের কথা না ভেবে দেশের জন্য দশের জন্য ভাবো, মহামূল্যবান মানবজনমকে কেবল নিজের কথা ভেবে নয় অন্য কারো উপকারে লাগতে পারার মতো করে ব্যয় করো। খুবই ভালো দর্শন, উত্তম ভাবনা। কিন্তু আমার মনে হলো, তা করতে গিয়ে যদি নিজের জীবনটাই ব্যয় হয়ে যায় সেই পরোপকারের পিছনে, তাহলে কি করে চলবে? নিজের জীবনেও তো একটু সুখের প্রয়োজন আছে, নাকি।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মতো সংসারে থেকেও তো ধর্ম পালন করা যায়। মনে পুরো শান্তি নিয়ে হয়তো তাহলে আরও বেশি করে দেশের ও দশের সেবা করা যেতো। তবে লেখকের সাথে আমি একমত যে, একটি জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিহার্য। তারাই পারেন সঠিক নৈতিকতার বিষয়টি ছাত্রদের মনের গভীরে প্রোথিত করে দিতে, সঠিক জীবনবোধ তৈরি করে দিতে, জ্ঞানগর্ভ পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে দিতে।
সবশেষে আর একটি বিষয় না বললেই নয়। নায়িকার মুক্ত মনের চিন্তা-ভাবনাও বেশ ভালো লেগেছে। এতোটা মুক্ত মনের মেয়ে ৮০-র দশকে ভাবা যায় না। যা’হোক, এরকম নায়িকার মত মনের জোর থাকা মুক্ত চিন্তার মেয়েদের আমাদের খুব দরকার। আর এইখানেই লেখকের চিন্তার সাথে আমি শরৎচন্দ্রের লেখার মিল খুঁজে পেয়েছি। শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রগুলো কিন্তু এমন বলিষ্ঠ ছিল। আজকের যুগে আমাদের এ ধরনের বলিষ্ঠ নারী চরিত্রও কিন্তু দরকার জাতি গঠনের জন্য।