নিজেকে খুঁজি বদলে যাওয়া ভিড়ে ॥ রেজিনা মনি


একচিলতে বাগান

আমার বাড়ির পেছনে ছোট্ট একচিলতে বাগান
রং বেরংয়ের কত পাখি আসে রোজ,
তাদের রঙিন পালক, স্বাধীন উড়া
চেনা অচেনার ভীড়ে নিত্য স্বপ্ন আঁকা।

একটা নাম না জানা ছোট্ট পাখি
রোজ জোড়াবেঁধে আসে,
চড়ুই পাখির মতোন দেখতে
গলায় কমলার মাফলার,
কিযে গাঢ় সেই কমলার রংটা

তারচেয়েও গাঢ় তাদের প্রেম,
ছোট্ট ডানায় উড়ে এসে বসে
কাপড় নাড়ার সরু তারে।
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে এঁকে দেয় গভীর চুম্বন।

লজ্জায় লাল হয়ে একটা পাখি উড়ে গিয়ে বসে
মেরুন ফেন্সের বুকে বেড়ে উঠা, সবুজ লতানো গাছটায়;
সাথি পাখিটাও উড়ে যায়, বসে আবার পাশাপাশি,
হেসে দুজনেই লুটোপুটি…তৃপ্ত ভালোবাসায়।

কয়েকটা শালিক পাখিও আসে প্রায়ই
কিচির মিচির করে ভরিয়ে তুলে আমার আঙিনা।
কেউ বাগানের বার্ড ফোয়ারায় গা ভেঁজায়
কেউ বা তুলে গানের মধুর সুর;
সেই সুরে পাখা মেলে নাচে অন্য দুজন
এদের আমার সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া তরুণী মনে হয়
কারণে অকারণে হেসে উঠা সহজ জীবন যাদের,
স্কুলের কড়া শাসন পেরিয়ে পা দিয়েছে বড় আঙিনায়
তারুণ্যরর উচ্ছ্বলতায় উজ্জ্বল পৃথিবী।

দু-একটা কাঠবিড়ালীরও দেখা পাওয়া যায়
গেইটের কাছে বড় গাছটার শরীর বেয়ে নেমে আসে।
চোখের পলকেই দৌঁড়ে, লাফে পৌঁছে যায়
দোলনার পাশে রাখা পাউরুটির ট্রেটার কাছে।

এরা আবার বাতাবি লেবু খাওয়া
কাজী নজরুলের পেটুক বিড়ালী নয়।
আইরিশ মানবীদের হাতে বানানো
ব্রেড, তুলতুলে নরম কেক খেয়ে বেড়ে উঠা
স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের জীবন্ত উদাহরণ।

এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে আমার বাড়িতেও আসে
সাদা কালোর ডোরাকাটা ও বাদামি রঙের বিড়াল দুটো;
শুনেছি এদের একজনার নাম টেডি আরেকজনার জিঋারী।
দুজনার মধ্যে আবার ভীষণ ভাব।

এজনার গলায় ছোট্ট একটি ঘণ্টা বাধা
নরম তুলতুলে পশম ঘেরা শরীর দুলিয়ে
ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে, দুকাঠের মাঝের ফাঁক গলিয়ে
কেমন করে যেন কায়দা করে ঢুকে পরে।

এদিক সেদিক একটু ঘুরোঘুরি করে
সোজা যেয়ে বসে আমার ভেজি বেডের উপর
আয়েস করে গা টা এলিয়ে দেয়।
কোন ভয়-ডর ছাড়া, দেশ,বর্ণ, ধর্ম, জাত তুচ্ছজ্ঞান করে
ঠিক খুঁজে নেয় নিজের আরাম আর ভালোলাগার অধিকারটুকু।

কড়ায় গণ্ডায় নিজেকে ভালোবাসার, ভালোরাখার কি অদ্ভুদ স্বাধীনতা
হাজারও মানুষের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হাহাকার; কিছু না পেয়ে ও হারানোর তীব্র ভয়, স্বপ্ন বাঁচানোর যুদ্ধ,
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার দিনভর লড়াই।

বর্ণে ধর্মে যুদ্ধ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, জাতে আর লিঙ্গে বৈষর্ম্য, ধনী গরিবের রেষারেষি আর হাজারও না, না’র ভিড়ে,

অসুখী মানুষের সব প্রশ্নের উত্তর
আমি অনায়াসে খুঁজে পাই আমার একচিলতে বাগানে।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবি
কে বলেছিল মানুষ স্বাধীন?
কে বলে, মানুষ স্বাধীন?

নিজেকে খুঁজি বদলে যাওয়া ভিড়ে

ঠিক এই খানটায়-
একটা কাঁঠের দুতলা বাড়ি ছিল।
বাড়ির দৈর্ঘ্যে একটা টানা বারান্দা,
সেই বারান্দার প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে

আমার শৈশবের গল্প…
ঠিক ওই কোনে, দাদুর ইজি চেয়ারটা পাতা ছিলো;
সাথে লম্বা নলওয়ালা হুক্কাটা।
মুখে নল গুঁজে দিয়ে দাদু আয়েস করে
পিঠ হেলিয়ে দিত।

তার চোখে চেইনে বাঁধা সরু চশমা,
হাতে পুঁথির বই;
নলিনদা হুক্কার কলকির টিক্কা জ্বালাতে
ব্যস্ত তালপাখার বাতাস দিত,
দিনগুলো কত সহজ ছিলো।

দিদিভাইয়ের রুপার একটা পানের বাঁটা ছিলো
সেই বাঁটায় সুন্দর চারটা কৌটা;
দামি জর্দা, সুপারি, খয়ের আর চুন,
পান সাজানোতেই তাঁর বড় সুখ।

মাদলখানা জানালার পাশে পাতা ছিলো-
আর তাঁর পা দুটো মেলা সেই মাদুলে;
একতারের নুপূর সেই আলতা রাঙা পায়ে।
দিনগুলো সব রঙিন ছিলো।

বাম পাশের লেবু তলার পাশে
মস্ত বড় একটা শিউলী গাছ;
বারান্দায় বিছিয়ে থাকত ফুলগুলো,
ভোর বেলায় সেই ফুল কুঁড়ানো সখ

আমার আর রাঙা বুবুর….
রাঙা বুবু আমার সবকিছুর সাথী;
তার লাল পাড়ের শাড়ি,
লম্বা চুলে গজমতি হাঁটের ফিতে
পুতুল বিয়েতে শিউলীমালা সজ্জা,
দিনগুলো সব স্বপ্নের ছিলো।

আস্তে আস্তে সব কেমন বদলে গেল
কাঁঠের বাড়ি ভেঙে হলো মস্ত দালান ।
অকাজের শিউলী গাছ পড়লো কাঁটা।
দাদুর হুক্কার পাইপ বসার ঘরের সজ্জায়,
পুরোনো স্টোরে ইজি চেয়ার,
দিদার সখের রুপার পানদানী
অযতনে এককোনে পরে রইল,
সেই সাথে একটু একটু করে আমার শৈশবের ইতি হলো

সেই হাসিমাখা রৌদোজ্জ্বল শৈশব
কোথায় হারিয়ে গেল?
আমি আজও তাঁকে খুঁজে ফিরি
খুঁজে ফিরি সেই টানা বারান্দা,
দাদুর হুক্কার গড়গড় শব্দ,
দিদিমার আলতা রাঙা পায়ের চিকন নুপূর,
রাঙা বুবুর গজমতি হাঁটের ফিতে,

সব স্মৃতির ভিড়ে আমি হাঁতড়ে খুঁজি
আমার সেই শৈশবকে।
আমি আসলে আমাকেই খুঁজি
বদলে যাওয়া ভিড়ে।