পদাবলীর পর ॥ নাসরিন মুন্নী


পদাবলীর পর

অনিকেত,
আজ আবার তোমায় লিখতে বসেছি
এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে না জানি,
তোমার পড়বার অবকাশ নেই- তাও জানি
তবুও লিখি..
কি করবো বলো…
এ যে বহু আগের পুরনো অভ্যেস;
একটা সময় ছিল,তোমার সাথে দেখা হলেই
হাত বাড়িয়ে বলতে, আমার চিঠি…।

তোমার মনে পড়ে প্রতিদিন
সকাল নয়টা দশ এর লোকাল বাসে
তোমার আমার একসাথে যাওয়া..
জানালার ধারে আমি পাশে তুমি
আমার একটা হাত ধরে থাকতে তুমি…।

ধুর,এসব কি আবোলতাবোল লিখছি..
মতিভ্রম হয়েছে আমার
কোথায় সেই বাইশ বছর আগের
লোকাল বাস..
আর কোথায় বা তোমার এখনকার
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দামি গাড়ি
চাল-চলন,বেশভূষাতেও
তুমি আর নেই সে তুমি;
কে যেন বলছিল..?
ও হ্যাঁ মনে পড়েছে- রঞ্জন
আমাদের সেই ক্ষ্যাপা বন্ধু
একদিন থার্ড ইয়ারের এক বড়ভাই
আমাকে কি জানি বলাতে
ছুটে গিয়ে কলার চেপে রঞ্জনের দুই ঘুষি
পুরো ক্যাম্পাস হুলস্থুল..

আবার আবোলতাবোল কথায় চলে গেলাম,
এসব ভাববার অবসর তোমার কোথায়
শুনেছি সুন্দরী বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে
বিশাল ফ্ল্যাটে খুউব ভালো আছো..।

অনিকেত,কখনো কি আমার কথা
জানতে ইচ্ছে করে তোমার
মা এখন একা একা আর হাঁটতে পারেন না,
সেই ছোট ‘তিতলী’ যাকে তুমি ‘বুড়ি ‘ বলতে-
এখন ভার্সিটি তে,খোকন ও ভালো আছে ।

আমি
ভালো আছি, খুব ভালো আছি
মাথার সামনের চুলে একটু পাক ধরেছে
মুটিয়েও গিয়েছি বেশ
শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, তাঁতের শাড়িতেই
এখনো দিব্যি আছি-
মাঝে মাঝে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা
একটু দমবন্ধ ভাব- এ আর এমন কি..।

এখনো সেই লোকাল বাসেই যাতায়াত
পাশের সিট টা কখনো খালি থাকে
কখনো অচেনা অজানা কেউ;
ওসব আর ভাবিনা…

আজ এ পর্যন্তই
আগেও চেয়েছি এখনো তাইই চাই
ভালো থেকো।

আবার পদাবলী
অনিকেত,
ভরা পূর্ণিমা আর জোছনা রাত নিয়ে
পাগলামি আমার বরাবরই
জানতে তুমি
গতকাল ছিলো পূর্ণিমা রাত,
রূপোর মতো চকচকে বিশাল চাঁদের দিকে তাকিয়ে
ভাবছিলাম তুমিও কি আগের মতোই
জোছনা দেখে ব্যাকুল হয়ে গান করো
খোলা ছাদে,মাঠে কিংবা নদীর ধারে..।

যোজন যোজন দূরত্বে এখন
তোমার আমার বসবাস
দেশ,নদী,পাহাড়, সাগর ছাপিয়ে
কত্ত দূরে তুমি।

আকাশ তো একটাই
লক্ষ কোটি তারার মাঝে
চাঁদও একটাই-
সে আকাশে অমাবস্যা, পূর্ণিমা,
মেঘের খেলা- সবই তো আছে
আছে মেঘের কান্না হয়ে বৃষ্টি ঝরা
তুমি কি তা দেখো
অনুভব করো
নাকি তুমি যেখানে থাকো
সেখানে আকাশ থেকে ওভাবে বৃষ্টি ঝরেনা
ঘন আঁধার কালো মেঘ থেকে-
সেখানে কেবলই রোদ্দুর
চারিদিকে শুধুই সোনালি আলোর ঝলকানি

হবে হয় তো
আমি তো সেদেশ দেখিনি
গল্প ও শোনা হয়নি কখনো
তোমার কাছ থেকে
এমনকি কোনদিন
দুলাইন লিখেও জানাওনি

তবে লোকমুখে শুনেছি
সেদেশ, জীবন চলে সময় যন্ত্রের নিয়মে,
বড্ড ছকে বাঁধা সে জীবন
আচ্ছা, কি করে পারলে
তোমার সেই বাউণ্ডুলে উড়নচণ্ডী জীবন টাকে
এমন সময়ের শেকলে বেঁধে ফেলতে…
পেরেছো বলেই বুঝি ভালো আছো খুব।

আমি আমার অনিয়মগুলোকেই
নিয়ম বানিয়ে নিয়েছি,
সময় আমায় নয় আমিই করি
সময়কে শাসন
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে বেরিয়ে পড়ি
রিকশার হুড ফেলে রাস্তায়
মাঘ মাসের তীব্র শীতেও
পূর্ণিমারাতে জোছনা ভরা
আকাশ দেখবো বলে
চলে যাই ছাদে,খোলা মাঠে-
তবে জেরও বইতে হয় বেশ
ঠান্ডায় গলা বসা, জ্বর…
মাঝবয়সী শরীর তো কিছুটা
বিগড়োবেই এত অনিয়মে

আচ্ছা তুমিই বলো
ডিসেম্বরের কনকনে শীতের রাতে
কেউ যদি শান বাঁধানো পুকুরঘাটে
পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে
নিয়ম না মেনে
তাকে তো কড়া শাসনই করতে হয়,নাকি।
তাইতো এখন মাঝে মধ্যেই
সেই শাসনেই ঘরবন্দী বিছানায়…

এই তো বেশ জীবন
ভাগ্যিস আমার এই জীবনে তুমি নেই
কুড়িতে যাকে আদরে শাসনে বাঁধতে পারোনি
এখনো কি তা পারতে
একটা কথা বলি,
ঐ ম্যাড়মেড়ে থোড় বড়ি খাড়া
খাড়া বড়ি থোড়-এর মতো
ছন্দহীন যন্ত্রের জীবন নিয়ে
তুমি কি খুব ভালো আছো