বাবাকে আমি দেখিনি ॥ রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা


বড় বোন বলতো, সৌম্য দর্শনের বাবা আমাদের। দেখিস নি তো, দেখলে বুঝতি৷ ভর দুপুরের রৌদ্র মাথায় নিয়ে সাইকেল দু-একবার টুংটাং বাজিয়ে বাড়ির উঠোনে দাঁড়াতো। সাইকেল বাজলেই বোঝা যেতো এ আমাদের বাবা, তিনি আসছেন। বাড়ির সড়ক থেকে ঐ দূরের রাস্তা অবধি দেখা যেতো পরিষ্কার, সবেগে সাইকেল চালিয়ে এই গ্রামের রাস্তায় একজনই আসতে পারে, সে আমাদের তেজদীপ্ত বাবা। সঙ্গে থাকতো দু-তিন জন কাজের সহকারী। শুনেছি ওরা বাবা-দাদার আমল থেকে আমাদের কাজে আছে, কেউ ভাইয়ের মতো কেউ দেবরের মতো, এমনই স্নেহ আর দেখভালো করে তাদেরকে আমাদের পরিবার। সঙ্গে লোক-লস্কর নিয়ে তার রাতদিনের কার্যক্রম। একগাদা লোক থাকতো বাড়িতে, মাঠে। তারা সারাদিন বাবার রেখে যাওয়া আদেশ পালন করতো উৎফুল্লচিত্তে৷

বাবা দৈনিক দুপুরে আসতেন, বাবার রঙ ছিলো আদুরে বর্ণের, লালচে ফর্সা৷ অবশ্য আমি সেসব দেখিনি, শুনেছি, দিদির কাছে, দাদার কাছে, কখনো কখনো মার কাছেও শুনেছি। বাড়ি ফিরে একগাদা ফিরিস্তি নিয়ে বসতো সে, মায়ের নালিশ, বোনেদের নালিশ, ভাবিদের নালিশ সব শেষ করে দুপুর গড়িয়ে পড়লে তবেই তার আহারাদির ফুরসৎ মিলতো৷ দাদা আর দিদি বাবার দিকে তাকাতে পারতেন না, ভয়ে ভয়ে পড়তে বসতেন। আর মা? আমার মা কি তখন অনাহুত ছিলো? অবিবাহিত ননদ, ননাস আর শ্বাশুড়ির সংসারে কেমন ছিলো আমাদের মা তা আজ নিরূপণ করতে মন চায় না আমাদের।

দাদীমা আর নেই। ফুপিরা সব ব্যস্ত গৃহিণী বনে গেছে সেই কবে, মা তার সংসারের একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছে সেও অনেকদিন। এই যে আমাদের নতুন বাড়িটা, খুব বেশিদিনের নয়। বাবার পরিশ্রমের বাড়ি, বাড়ির প্রতিটি ইটপাটকেল বাবার ঘামের কথা বলে। বাবা এসে বললেন, বাড়িটি কী নামে হবে? মা বললেন, আম্মার নামে দাও৷ বাবা ঝলমল করে উঠলো। তখনই সাড়ম্বরে বাড়ির ফটকে লিখে ফেললো ‘জননী সাহসিকা’। সেই থেকে আনন্দ বাড়ি আমাদের। দাদী শুধু পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো, সামনের কিছু দাঁত তখনো ছিলো সাথে। তিনি পান চিবোতে লাগলেন নতুন করে।

দাদীমা আজ নেই। একান্নবর্তী সংসার থেকে মা পেয়েছে নিরিবিলি সংসার৷ ফুপুরা আজ দাদী সেজে বসে আছে কেমন সুখ সুখ ভাব করে। কিন্তু আম্মা হারিয়েছে সেইসব দিনপঞ্জি, ভোররাতে মোয়াজ্জিনের সাথে জেগে উঠা বাবাকে, সাইকেল হাঁকিয়ে অন্ধকার থাকতে পৌঁছে যাওয়া শ্বশুর বাড়ির এলাকাতে। পঁচিশ-ত্রিশটি এলাকাজুড়ে ছিলো তার ব্যবসায়ীক আধিপত্য, শ্বশুরবাড়ির এলাকা ছিলো যার প্রাণকেন্দ্র৷ বাবার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা আর কাজকর্মের দক্ষতা দেখে মা’র দাদা তার বড় নাতনীর সঙ্গে বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধেছিলো।

আম্মার দাদা তখন কয়েক এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। বাবা বিয়ে করলেন৷ তার কর্মযজ্ঞ আরো প্রসারিত হতে থাকলো। বাবা আর দুপুরে আসতে পারেন না, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত৷ আবার কাক ডাকা ভোরে সাইকেলে চেপে বসে পড়তো। কোন দূরে দূরে তার ঘাঁটি, আম্মার চোখেই পরতো না। তারপরে সাইকেল ছেড়ে সঙ্গী হলো ট্রেন। রাতের বদলে বাবা ফিরতে শুরু করলো দু-এক সপ্তাহ পরে পরে। বাবার আদুরে রঙ দিদি আর দাদার চোখে না মাসের পর মাস। বাবার কর্মক্ষেত্র বাড়ে, বাড়িতে লোক-লস্কর ভিড় করে, মাঠের পর মাঠ বাবার নামে লেখা হতে থাকে। ফুপিদের বিয়ে দেয়, চাচু ঢাকা ইউভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়৷ চাচুকে বাইরে পড়তে পাঠায়। তারপর বাবা আর বাড়িতে আসেন না, বাবাকে আমরা আর দেখি না। সবকিছু বাড়তে থাকে, দাদা-দিদিরা পড়তে থাকে। শুধু বাবাই আমাদের দূরে দূরে সরে যায়। তার রঙ বদলে যায়। বাবার সেই রঙ আমাদের কল্পনায় চলে যায়। আমরা বাবাকে ভুলে যাই…..।