দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।দেশের প্রকাশনা জগতে এক অনন্য নাম। বই প্রকাশে ‘বিরল অবদান’ রাখায় এই প্রকাশনা সংস্থা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র পুরস্কার লাভ করে ১৬ বার৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ ২১ জুন ২০২১ (সোমবার দিবাগত রাত ১টায়) মৃত্যুবরণ করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
দুই.
মহিউদ্দিন আহমেদ এর মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। তিনি প্রকাশনাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রকাশনার মানের জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। ইউপিএল প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হাতে নিয়ে দেখলেই বুঝা যায়, একটা প্রকাশনা কতটা শৈল্পিক হতে পারে, কতটা উন্নত হতে পারে। বাংলাদেশে সে অর্থে ভালো প্রকাশনা কিংবা প্রফেশনাল প্রকাশনা সংস্থা (হাতে গোনা কয়েকটি আছে)গড়ে উঠেনি। কিন্তু তিনি চেয়েছেন ইউপিএল এই পথ দেখাক এবং তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন প্রকাশনা শুধু ব্যবসা নয়, এটি শিল্প এবং সমাজের জন্য আলোঘর।যে কারণে তিনি অনুকরণীয়।
তিন.
মহিউদ্দিন আহমেদ এর সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই। ইউপিএল এর আলোচনা সে সময় বন্ধুমহলে অনেক শুনেছি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক লেখা পড়েছি। এই প্রকাশনার অনেক বই কিনেছি। তখন থেকেই আগ্রহ ছিলো তার সঙ্গে একবার সরাসরি সাক্ষাৎ করবো। কিন্তু সময় মেলাতে পারছিলাম না। মনে পড়ে ২০১০-২০১১ সালের কথা। সে সময় ফখরুজ্জামান ভাই একবার ডেকে বললেন (ফখরুজ্জামান চৌধুরী, সাহিত্যিক, টিভিব্যক্তিত্ব), ‘একটা বই আলোচনা করে দিতে পারবি’। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এখানে বলে রাখি ওই বছর ফখরুজ্জামান ভাইয়ের লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ঐরাবত ও অঙ্কুশ শাহি দরবারের কিসসা’ ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়। আমি গ্রন্থটি সংগ্রহ করে একটা আলোচনা লিখে দিলাম।
মহিউদ্দিন আহমেদ সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছে। কয়েক বছর আগে বইমেলায় শুধু তাকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম। এক মিনিটের মতো কথা হয়েছে তার সঙ্গে। অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ।
চার.
মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়। লেখক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই সব দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আদর্শ প্রকাশক। মানসম্মত প্রকাশনা বলতে যা বোঝায়, তার একটা রূপ তিনি দেখিয়ে গেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর কেউ পারেননি। সেজন্য তার অর্জনের সঙ্গে অন্য প্রকাশকের অর্জনের তুলনা হতে পারে না।তিনি প্রকাশনা জগতে যে মান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা আন্তর্জাতিক মানের। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। একটা মানুষ দেখিয়ে গেছেন কীভাবে বই প্রকাশ করতে হয়, ছাপাতে হয়। এটি তার বড় অর্জন।
পাঁচ.
মহিউদ্দিন আহমেদ এর জন্ম ১৯৪৪ সালে ফেনীর পরশুরামে। নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেন। পরে পাকিস্তান কাউন্সিল স্কলারশিপ নিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়তে যান। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষে তিনি পাকিস্তান টাইমসে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন।
অ্যারিজোনার বেনসনে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র আন্তর্জাতিক কার্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে মহিউদ্দিন আহমেদকে ‘পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে ‘কালচারাল ডক্টরেট’ ডিগ্রি দেওয়া হয়। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের (ওইউপি) পাকিস্তান শাখার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে দুই বছর ওইউপি ঢাকা শাখার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে ওইউপির ঢাকা কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে মহিউদ্দিন আহমেদকে করাচি শাখায় ‘এডিটর-অ্যাট-লার্জ’ বা রোভিং এডিটর হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু করাচিতে একজন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে তিনি নিজের প্রকাশনা সংস্থা ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউপিএল প্রধানত পাঠ্যবই ও গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করে। বাংলাদেশি লেখক ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদদের রচিত বিভিন্ন বই ও গবেষণা তিনি প্রকাশ করেছেন।
মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার ‘জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র’ পুরস্কার লাভ করে ইউপিএল। ১৯৯১ সালে তিনি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। পরিবেশ উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৭ জন প্রকাশককে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান, মহিউদ্দিন ছিলেন তাদের একজন।
২০১২ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ভারত (পেঙ্গুইন) ও পাকিস্তানে (ওইউপি) ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় বইটি প্রকাশের ব্যবস্থাও করেন তিনি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ‘অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে তাকে ‘ইমেরিটাস পাবলিশার’ পদবি দেওয়া হয়।
প্রকাশনার পাশাপাশি মহিউদ্দিন আহমেদ নিজেও লেখালেখি করেছেন। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত সমকালীন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা করেছেন তিনি।
তথ্যঋণ
১। একজন আদর্শ প্রকাশক ও ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি, আফসান চৌধুরী, বণিক বার্তা, জুন ২৩, ২০২১।
২। ইউপিএলবুকস ডটকম
৩। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২২ জুন ২০২১।