রবীন্দ্রসান্নিধ্যে হিয়াকুতাকে আকিকো ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


ছবি: নিচি-ইন কিয়োকাই, জাপান

“জাপানি নারীদের মননে রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক গবেষণা করতে গিয়ে খুঁজে পেলাম একজনকে যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জীবদ্দশায় দুবার ফুল দিয়ে বরণ করেছিলেন জাপানে অভ্যর্থনা সমাবেশে। তিনি হিয়াকুতাকে আকিকো (১৯১২-২০০৮)। পিতৃপ্রদত্ত নাম অবশ্য সোয়েজিমা আকিকো।

আকিকো মেইজি যুগের শেষ বছর ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সাগা প্রদেশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সোয়েজিমা ইয়াসোরোকু (১৮৭৫-১৯৫০), জাপানের দক্ষিণ সাগরীয় অনুসন্ধানকারী এবং জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশনের (প্রতিষ্ঠা ১৯০৩-) ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। ভারত সম্পর্কে তাঁর মূল্যবান গ্রন্থও রয়েছে। বলাই বাহুল্য, সোয়েজিমা রবীন্দ্রনাথের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম এশিয়ায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন তখন জাপানিদের মনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এই বিরলতম ঘটনা। জাপানের নাগরিকরা তাঁকে দেখার জন্য প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানাতে কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠানোর সংবাদ পাওয়া যায় কোনো কোনো উৎস থেকে। কিন্তু কতখানি সত্য তা গবেষণাসাপেক্ষ।

আবার এও জানা যায় যে, বেসরকারিভাবে জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশনের তৃতীয় সভাপতি শিল্পপতি শিবুসাওয়া এইইচি রবীন্দ্রনাথকে জাপানে আগমনের আমন্ত্রণপত্র পাঠান। সেই আমন্ত্রণ পেয়ে স্বব্যয়ে তিনি জাপন ভ্রমণে আসেন ১৯১৬ সালে মে মাসের ২৯ তারিখে। কোবে সমুদ্রবন্দরে অবতরণ করার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কিছুদিন কাটিয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দিকে আগমন করেন জুলাই মাসে।

টোকিও স্টেশনে কবিগুরুকে এক বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয় তাঁর ভক্তকুলের পক্ষ থেকে। তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে ছোট্ট একটি মেয়েও অভ্যর্থনা জানায়। সেই মেয়েটি হচ্ছেন হিয়াকুতাকে আকিকো, সোয়েজিমা ইয়াসোরোকুর দ্বিতীয় কন্যা, বয়স তখন মাত্র ৩ বছর। বড়বোনের কোলে চড়ে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন টোকিও রেল স্টেশনে।

সেই সময়কার স্মৃতি তাঁর সুস্পষ্ট মনে ছিল। এরপর ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পঞ্চম বা শেষবারের জন্য জাপানে আগমন করেন তখন আকিকো ১৭ বছর বয়সী কিশোরী। পুনরায় কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে টোকিও তথা জাপানের প্রথম আধুনিক হোটেল ইম্পেরিয়াল হোটেলের সদর প্রাঙ্গণে। এবারও ফুলের তোড়া দিয়ে কবিকে অভ্যর্থনা জানান তিনি।

শেষবারের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টোকিওতে প্রায় এক মাস অবস্থান করেছিলেন তাঁর বিশিষ্ট ভক্ত ড.ওওকুরা কুনিহিকোর বাসভবনে। এই সময় কবিগুরু বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ ও সভায় বক্তৃতা ও কবিতা পাঠ করেন। তাছাড়া প্রভাবশালী দৈনিক আসাহিশিম্বুন পত্রিকার আহবানে ধারাবাহিকভাবে কয়েকদিন পাঠ করেন তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ “ফিলোসফি অব লেইজার” বা “অবসরের দর্শন।” যা পরে তাঁর নারী ভক্ত মাদাম ড.কোওরা তোমি “ইউকান তেৎসুগাকু” নামে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং আসাহিশিম্বুন ওই সালেই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে।

কিশোরী আকিকো সেই সময় গুরুদেবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাঁর কণ্ঠে বক্তৃতা এবং কবিতা পাঠ শুনে বিমুগ্ধ হন। সেই অবিস্মরণীয় মনোরম স্মৃতিকথা পরবর্তীকালে তিনি তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণিকাতে লেখেন। পুনরায় লেখেন যখন তিনি বার্ধক্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছেন ২০০৩ সালে তখন, জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশনের শতবর্ষপূর্তি স্মরক বুলেটিনে ১৯২৯ সালের একটি দুর্লভ ছবিসহ। সেই ছবিতে গুরুদেবের ডানপাশে ফুলের তোড়া হাতে সুদর্শনা হিয়াকুতাকে আকিকোকে দেখা যাচ্ছে।

এই স্মৃতিকথায় আরেকটি ছোট্ট ইংরেজি কবিতাবিশেষ মুদ্রিত হয়েছে, সেটা এরকম:
The New Japan
has sent her garland of
welcome by the
hand of a child
to the Old
India. Who
blesses her in
the voice of an
old poet.

Rabindranath
Tagore

এই কবিতা বা শুভেচ্ছাবার্তাটি ১৯১৬ সালের প্রথম ভ্রমণের সময় লিখিত এবং আকিকোকেই উপহার দিয়েছিলেন।

টোকিও
২৯.৬.২০২১