২০২০ এর বইমেলা। সাক্ষাৎকার বই ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বেরিয়েছে চৈতন্য থেকে। চৈতন্যের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। কিছু করার নেই। বই দেখছি। একটা বই চোখে পড়ল। নান্দনিক প্রচ্ছদ। কবি নূরুল হকের ‘কবিতাসমগ্র’। নাম শুনিনি কখনো।
কবি পরিচিতিতে দেখলাম- জন্ম ১৯৪৪ সালে। পাতা উল্টাতেই বিস্ময়! এমন মেদহীন, ভারী ভারী শব্দের বাহুল্যহীন, ছিপছিপে আঙ্গিকের কবিতা এই কবি লিখে গেছেন! স্পেসের ব্যবহার তো অতুলনীয়! কবিতা পড়ছি আর মনে হচ্ছে এই সময়ের লেখা বা সময়ের আগেই কবি লিখে গেছেন। সহজিয়া স্বরে গভীর দর্শনের আভাস আমাকে টানে সব সময়।
৩০৪ পৃষ্ঠার, আক্ষরিক ও সাহিত্যমানে উভয়ার্থেই ওজনদার, বইটি কিনলাম তখনই। ভূমিকা পড়ে জানলাম ২০০৭ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে। ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’। নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেলেও তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ৬৩ বছর বয়সে। বিস্ময়কর ঘটনাই বটে! তাঁর প্রকাশিত কবিতা বইয়ের সংখ্যা ৬টি। সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়, একটি গাছের পদপ্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা, শাহবাগ থেকে মালোপাড়া, এ জীবন খসড়া জীবন এবং কবিতাসমগ্র।
নূরুল হকের কবিতা ক্লান্তিহরা। ছোটো কিংবা দীর্ঘ কবিতায় তিনি ভীষণ চেনা দৃশ্যগুলো নতুন করে এঁকে দেন। ফের চলে যান দৃশ্যান্তরে। স্বগতকথনের মতো নিচুস্বরে একের পর এক কবিতা বলে যান।
আমি চমকে উঠি যখন তিনি বলেন-ভোরবেলাটা আমার শাকভাত,/প্রতিদিন পাই/গরিবের ঘরে। এই ভোরবেলা, এই শাকভাত আমার চেনা কিন্তু কখনও কি ভেবেছি এমন ভোরবেলা গরিবের ঘরেও আসে। থালায় অন্ন হয়ে প্রতিদিন আলো ছড়িয়ে দেয়। এই কবিতা তখন বড় আপন হয়ে যায়।
আরেকটি কবিতার কথা বলি। জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,/ যা দেখে মানুষ/বাড়ি ফেরার কথা/ভুলে যায়। এই কবিতা পড়ামাত্র গ্লানিময় ব্যথাতুর জীবনও অপুর্ব দৃশ্য হয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে আমাদের আর লজ্জা-অপমানের কথা মনে থাকে না। এই দীর্ণদুখী জীবন কী ভীষণ অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে! সুন্দর হয়ে যায়! আবার জীবনকে ভালোবেসে ফেলি।
কবিকে চিনি না। এর প্রয়োজনও নেই। তাই তাঁর কথা কাউকে জিজ্ঞেসও করিনি। তাঁর কবিতাই যথেষ্ট। আজ তিনি পৃথিবীতে নেই। যখন ছিলেন তখনো চিনতাম না।
কিন্তু তাঁর কবিতা আমি চিনি। এর চেয়ে বেশি একজন কবিকে কী করে চেনা যেতে পারে? টেক্সট আসলে নিজ গুণে টিকে থাকে। বেঁচে থাকে। বাঁচিয়ে রাখার জন্য কবি/লেখকের দৌড়োদৌড়ি নিষ্প্রয়োজন।
কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের কাছ থেকে জানতে পারলাম-২০১৮ সালে কলকাতা থেকে শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ৫৫৯ পৃষ্ঠার ‘কাব্যসমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বিষয়ে নূরুল হকের লেখার উদ্ধৃতাংশ আছে! নূরুল হকের গদ্যভাষাও মুগ্ধকর।
কবি নূরুল হকের প্রায় সব কবিতাই ভালো লাগে। একগুচ্ছ কবিতা পাঠকদের জন্য এখানে তুলে দিলাম। আমি নিশ্চিত কবি এখন দেখতে পাচ্ছেন- তাঁর কবিতা অজানা, অচেনা কেউ পড়ে!
দূরত্ব
এমনভাবে কথা বলছিলে
যেন তোমার ঠোঁট থেকে পৃথক
হয়ে-যাওয়া শব্দগুলো
আঙুরগুচ্ছের মতো
থোকায়
থোকায়
বাতাসে দুলছিল
এবং দুলছিল।
সবদিকে পাতা নড়ছিল জীবনের।
তক্ষুনি
কোথা থেকে একটা চতুষ্পদ কী যেন এসে
আস্তে করে ওই শব্দগুলোর ওপর দিয়ে
হর্ন বাজিয়ে চলে গেল।
কাক
ঘনসংবদ্ধ ঝরনার পানি
তরতর করছে কবুতরের মতো।
আমার হৃদয়ে
এক নিঝুম ডালে
কাকপক্ষীর মতো নামল তোমার নাম।
এত লতাপাতা আর অরণ্যের গহনা
এত কূলহীন নির্জনতায়
আমি আর সেই পথহারা
কাক।
বুদ্ধপূর্ণিমা: আগুনমুখোয়
এই মহানদীর পারে
একদিকে বুদ্ধের চাঁদ
অন্যদিকে আমি,
মাঝখানে থ্রি-পিস জগৎ
আকাশ, জমিন এবং মৃত্যুলোক।
তবে কি মানুষের জীবনটাই
একটা পরমার্থিক ভ্রমণ।
কত কথাই না জমে উঠেছে
আমার না-বালক বোধির
মনোবেদনার কাছে।
আত্মজীবনী
যে বিষয় আমি জানি না
সে বিষয়ে আমি
কাটিয়ে দিয়েছি
জীবন।
কত কাঁটা-ভরা দিন আমাকে
জাবড়ে ধরেছে
আর পিছলে গিয়েছি
মানুষ থেকে
মানুষে।
এই তো আমার
জীবন।
সমস্যা
মৃত্যুতে আমার কোনো সমস্যা নেই
কারণ
জীবনে তো মৃত্যুই ভরা আছে
তাতেই তো বসবাস করি
তাই
মৃত্যুতে আমার কোনো গড়িমসি নেই
যখনই ল্গন হবে তখনই পাড়ি
কিন্তু
মৃত্যু হলে
পৃথিবীটা ঠিকঠাক চলছে কিনা
তা জানব কী করে?
এই যা সমস্যা।
কলেমায়ে জুম্মাবার
দুপুরবেলার রোদ
কোথাও ঢালভুমি খুঁজছে
জুম্মার নামাজের পর।
গাছগাছালির নীচে
এক এক খণ্ড ছায়া
যেন এক একটি দোয়া।
যেন শান্তি, স্নিগ্ধতা
আর আয়াত দিয়ে
তৈরি
পালক
ভাসিয়ে উড়ছে একটা পাখি
নীল রৌদ্রে।
শাকভাত
ভোরবেলাটা আমার শাকভাত,
প্রতিদিন পাই
গরিবের ঘরে।
পাদটীকা
জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,
যা দেখে মানুষ
বাড়ি ফেরার কথা
ভুলে যায়।
স্টেশন নেই
যেমন করে হুইসেল বাজাতে বাজাতে রেলগাড়ি চলে যায়
তেমনি করে সংকেত দিয়ে দিয়ে পরিভ্রমণ করে বিষাদের বিষকণাগুলি
আমার ভিতরে।
কখনো থামতে জানে না
কোনো স্টেশন নেই বলে।
চলতে থাকে চক্রাকারে
ঘুরে
ঘুরে।
একটা কথা না বলে পারছি না, ‘স্টেশন নেই’ কবিতার প্রথম দুটো পঙক্তি আমাকে ভাবিয়েছে। দীর্ঘ বাক্য। তারপর বেশ ভেঙে গেছে বাক্যগুলো। শেষ পঙক্তি এক শব্দে। মৃদু হাসলাম। রেলগাড়ি যে! দীর্ঘবাক্যের ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম কেমন করে?
ধ্যানমগ্ন হয়ে কবি নূরুল হক কবিতা লিখেছেন। কবিতায় জীবন, মৃত্যু, সময় ও সমাজবাস্তবতাকে একান্তভাবে অনুভব করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতা নিবিড়পাঠ, বিশ্লেষণ ও দীর্ঘপরিসরের আলোচনা দাবি করে। কবির কবিতা পাঠ করেই তাঁর প্রতি আমার অনন্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি।