১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জাপান ভ্রমণে আসেন। জাপানি জাহাজ “তোসামারু”তে চড়ে তিনজন সঙ্গী যথাক্রমে পিয়ারসন, অ্যান্ড্রুজ এবং তরুণ চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দেসহ কোবে সমুদ্রবন্দরে অবতরণ করেন মে মাসের ২৯ তারিখ।
জাহাজে জাপানি বন্ধু মনীষী ওকাকুরা তেনশিন রচিত “দি বুক অফ টি” গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে আসেন। তখন কবিগুরুর বয়স ৫৫ বছর।
কোবে অবতরণের পর তিনি কোথায় থাকবেন এই নিয়ে তাঁর অভ্যাগতদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয় বলে জানা যায় কোনো কোনো সূত্র থেকে। যেহেতু তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি নন, তাই তাঁর ভক্তরা চেয়েছিলেন তাঁদের পছন্দমতো কোনো হোটেলে বা বাড়িতে রাখবেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলে কথা, ভেবে দেখলেন, জাপানি ভক্তদের আবাসস্থলে তো থাকা যায়ই, কিন্তু যারা প্রবাসী ভারতীয় তাঁদের আবদারও তো রক্ষা করতে হয়। তাই তিনি মত দিলেন মাদ্রাজি এক পরিবারে থাকার জন্য। এবং তাই হয়েছিল।
জুন মাসের ১ তারিখ ওসাকা শহরে গেলেন। সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতার। তেননোওজি কোওয়েন কোওকাইদোও মিলনায়তন মঞ্চে বক্তৃতা দিলেন “ইন্ডিয়া অ্যান্ড জাপান” নামে। জানা যায়, তাঁর এই বক্তৃতা শুনতে আসা জাপানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরুণী ছাত্রী এবং মধ্যবয়সী নারীরা অবাক চোখে রবীন্দ্রনাথের রমণীবিদ্ধ চেহারাই দেখছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লেডি কিলার! বিষয়টি যে আতিশয্য নয়, উপস্থাপিত আলোকচিত্রটিই তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
কোবে শহরে বসবাস খ্যাতিমান এক চিত্রশিল্পী মুরাকামি কাগাকু YMCA ভবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর একটি প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন যা দেখে রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত হন। জাতীয় এবং স্থানীয় সংবাদ ও সাময়িকীগুলোর সাংবাদিকরা রবীন্দ্রনাথের সংবাদ ও সাক্ষাৎকার প্রচারের জন্য এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠেন যে, কবি রীতিমতো বিরক্ত হন।
জুন মাসের ৫ তারিখ ট্রেনে চড়ে ওসাকা থেকে রাজধানী টোকিওতে আগমন করেন। সংবাদপত্রে অবগত হওয়া তাঁর প্রচুর ভক্ত স্টেশনে এসে ভিড় করেন। গলায় মাল্যদান করে বরণ করে নেন।
কবিগুরু ভারতে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের উয়েনো শহরস্থ বাসভবনে প্রায় দিন দশেক আতিথ্যগ্রহণ করেন। এর মধ্যে টোকিওর বিখ্যাত কয়েকটি স্থান পরিভ্রমণ করেন। এসবের মধ্যে ওকাকুরা তেনশিনের প্রতিষ্ঠিত জাপান চারুকলা ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে যান ১০ জুন, সেখানে শিল্পকলা বিষয়ে বক্তৃতা দেন বলে জানা যায়, কিন্তু বক্তৃতাটির দলিল আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঠাকুরবাড়ির ‘বিচিত্রা’ চারুকলা বিদ্যালয়ের শিল্পকর্ম দিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজনও করা হয় উক্ত প্রতিষ্ঠানে।
জুন মাসের ১১ তারিখ টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন ‘এ মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান’ নামে। এই বক্তৃতা নিয়েই বাঁধে বিপত্তি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক আলোড়ন এবং বির্তকের ঝড় ওঠে জাপানে।
এই বক্তৃতায় কবিগুরু জাপানের অতিরিক্ত পাশ্চাত্যপ্রীতি এবং সমরবাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাতে করে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলে শীতল মনোভাব দেখা দেয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে কথা, দ্রুত অবস্থা বুঝতে পেরে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এক কূটনৈতিক চাল চালেন। আরেকটি বক্তৃতা দেন জুলাই মাসের ৩ তারিখ (মতান্তরে ২ জুলাই) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ কেইও গিজুকুি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘দি স্পিরিট অব জাপান’ নামে। এই সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে তিনি আবার আলোড়ন সৃষ্টি করেন। শীতল মনোভাব অনেকটাই উষ্ণ হতে থাকে। এটা তাঁর জীবনের অনেক বক্তৃতার মধ্যে অসামান্য একটি কাজ। বক্তৃতায় জাপানিদের জাতিগত শক্তি, দর্শন, ইতিহাসচেতনা, প্রকৃতিপ্রেম, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার বৈচিত্র্য ও স্বান্তত্র্য বিষয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
রবীন্দ্রনাথ যে জাপান সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এটাই প্রমাণিত হয়। যাই হোক, জুন মাসের ১৪ তারিখ কবিগুরু সদল তাইকানের বাসভবন তথা টোকিও থেকে বন্দর নগরী য়োকোহামাতে স্থানান্তরিত হন। প্রকৃতির অমরাবতী বলে খ্যাত ‘সানকেইএন’ বাগানবাড়িতে আতিথ্য লাভ করেন।
এই বিখ্যাত বাগানবাড়ির কর্ণধার ছিলেন প্রভাবশালী রেশম বণিক ও শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও। হারা মহাশয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্বের কথা জাপানে কিংবদন্তিস্বরূপ। বন্ধু হারার একটি গ্রীষ্মাবাস ছিল য়োকোহামার কাছেই হাকানো নামক শহরে।
সেখানকার পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও দেখার মতো। সানকেইএন এবং হাকোনোর গ্রীষ্মাবাস মিলিয়ে কবিগুরু ৮০ দিন অবস্থান করেন। কী রকম সম্পর্ক গড়ে উঠলে পরে চার জন বিদেশি প্রায় তিন মাস এই প্রথম পরিচিত একজন ব্যক্তির আতিথ্যগ্রহণ করতে পারেন তা সহজে অনুধাবন করা যায়।
এই দীর্ঘ সময় রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আপন বাড়ির মতো নির্ভার আনন্দময় সময় উপভোগ করেছেন। নানা ঘটনা ঘটেছে এই সময়। বহু খ্যাত-অখ্যাত জাপানি ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে সান্নিধ্য পেতে প্রতিদিনই আসতেন। আমার ‘রবীন্দ্রনাথ ও জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে সেসব বর্ণিত আছে। প্রকাশক, কলকাতার আত্মজা পাবলিশার্স।
যাই হোক, সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ কবিগুরু সদল য়োকোহামা বন্দর থেকে আমেরিকার দিকে যাত্রা করেন। ছবিটি সানকেইএন বাগানবাড়িতে ধৃত।
টোকিও ৩০.৭.২০২১