রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তো বটেই, তাঁর তিরোধানের পরও একাধিক বিশিষ্ট জাপানি নারী শান্তিনিকেতনে পা রেখেছেন প্রভাবিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম, শিক্ষা, চিন্তা, দর্শন, চিত্রকলা, শিশুভাবনা, সঙ্গীত, বিশ্বজনীনতা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁকে জানার জন্য, তাঁর মাধ্যমে বাঙালিকে, ভারতবর্ষকে জানার জন্য জাপানিদের কৌতূহল আজও শীর্ষস্থান দখল করে আছে। আধুনিক ভারত, স্বাধীন বাংলাদেশকে জাপানিরা চিনেছেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই। তাই বহির্বিশ্বে আজও বাঙালি জাতির প্রধান পরিচিতি সমগ্র এশিয়া মহাদেশে প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাপানেও এর ব্যতিক্রম নেই।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় জাপানে ও ভারতে একাধিক জাপানি নারীর সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এঁদের মধ্যে মাদাম ড.কোওরা তোমি, নৃত্যশিল্পী ইরিয়ে শিজুয়ে, ইকেবানা-প্রশিক্ষক হাশিমোতো মাকি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন একা-একাই।
রবীন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন ১৯৪১ সালে, এর কয়েক মাস পরেই ডিসেম্বরে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ফলে রবীন্দ্র-জাপান দ্বিপাক্ষিক ভাববিনিময় সম্পর্কে সাময়িক ছেদ পড়ে। সেই সম্পর্ক পুনরায় উন্মুক্ত হয় ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যলিয়ের ভারতীয় দর্শন বিভাগের প্রধান ও ভারতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড.নাকামুরা হাজিমের যৌথ উদ্যোগে। আবার শান্তিনিকেতনে জাপানি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও বিভিন্ন স্তরের মানুষজন যাতায়াত শুরু করেন, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি রবীন্দ্রভক্ত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাও বিভিন্ন কাজ উপলক্ষে জাপানে আসতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে জাপানে ১৯৬৭ সাল থেকেই প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ গৃহীত হয়। সেই সময় ভারতের প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীসহ জাপান ভ্রমণরত অবস্থায় এই উদ্যোগ গ্রহণে নেতৃত্ব দেন মর্যাদাসম্পন্ন হেইবোনশা পাবলিশার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও। পরের বছর থেকেই বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে বহুবিধ পরিকল্পনা ও প্রকল্প নিয়ে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে ৬০ জনের বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বসহ শতাধিক কর্মী ও সদস্য নিয়ে গঠিত হয় “তাগো-রু কিনেনকাই” তথা “টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন”, যার সভাপতি হন স্বনামধন্য কাগজ ব্যবসায়ী, চিন্তাবিদ এবং বিখ্যাত তোওয়োও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড.ওওকুরা কুনিহিকো।
এই অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম সম্মানিত সদস্য ছিলেন ৫১ বছর বয়স্ক একজন খ্যাতিমান নারী চিত্রশিল্পী আকিনো ফুকু। ১৯০৮ সালের ২৫ জুলাই, শিজুওকা প্রদেশে সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আকিনো যৌবনেই স্বপ্রচেষ্টায় চিত্রকলায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। চিত্রশিল্পী হিসেবে জাপানের প্রাতস্মরণীয় মনীষী, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ, শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ১৯০২ সাল থেকে যে গভীর প্রাচ্য ভাববিনিময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কলিকাতায় সেই ইতিহাস তিনি জানতেন। এবং মনে মনে এই ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলাই বাহুল্য। তাই ১৯৬২ সালে যখন তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত “তাগো-রু কোকুসাই দাইগাকু” তথা “বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে” অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যাওয়ার জন্য, তিনি আগপিছ না ভেবেই সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেলেন। তখন তাঁর বয়স ৫৪ বছর। না জানেন ভাষা, না জানেন ভারত সম্পর্কে বিশদকিছু, না জানেন খাদ্য-খাবারের সংস্কৃতি কিন্তু সাহস করে একাই জাপানে থেকে সাত হাজার মাইল দূরবর্তী বাংলা অ ল তথা শান্তিনিকেতন আশ্রমে পা রাখেন। এটাই তাঁর প্রথম বিদেশযাত্রা। আর এখানেই তিনি যা প্রত্যাশা করেছিলেন তাই পেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। শান্তিনিকেতন তথা বাংলা অ ল ও ভারতের অন্যান্য বৌদ্ধ, হিন্দু তীর্থস্থান ভ্রমণ করে আপ্লুত হয়েছেন। বাঙালি এবং ভারতীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভালোবেসেই ফেলেছেন! যা তাঁর চিত্রকর্মের বিশাল বিশাল ক্যানভাসে উদ্ভাসিত হয়ে আছে! বাংলার নিসর্গ ও জনজীবন এত বিশাল ক্যানভাসে খুব কম জাপানি চিত্রশিল্পী এঁকেছেন বলে মনে হয়।
শান্তিনিকেতনে এক বছর অবস্থানকালে ভাষা ছাড়াই শুধুমাত্র চিত্র অঙ্কন করে ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি, পারস্পরিক যোগাযোগে, সহবস্থানে কোনো প্রকার বাধাবিপত্তি ঘটেনি বলে জাপানি ভাষার সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোতে তাঁর প্রদত্ত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। যেহেতু তিনি বাংলা বা ইংরেজি জানেন না একমাত্র মাতৃভাষা জাপানি ছাড়া, তাই ভিনদেশি সংস্কৃতিজাত ছাত্রছাত্রী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে প্রথম থেকেই শাড়ি পরা ও স্থানীয় খাবারদাবারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। আর এই সংস্কৃতি তাঁর মনে নিখুঁত প্রভাব বিস্তার করে যা “লাল পোশাক”,“সোনালি হরিণ”,“হলুদ মাটি”, “স্টেশন কুলি”,“সকালের প্রার্থনা”, “ঘরেফেরা মহীষের দল”, “আল্পনা”, “চম্পাফুল”; বিশাল ক্যানভাসে আঁকা “গঙ্গা”সহ আরও কিছু চিত্রকর্মে বিধৃত আছে। বিশাল মাপের “আকিনো ফুকু জাদুঘরে” শোভা পাচ্ছে প্রাচ্য তথা বাংলার নিসর্গ, মাটি, নদনদী, নারী, দেবদেবী, মন্দির, প্রাণী যা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের আরাধ্য ছিল। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। জীবনের শেষ ৪০ বছরকাল তিনি আরও একাধিকবার গিয়েছেন শান্তিনিকেতন তথা বাংলায়, গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকেছেন। সেইসব শিল্পকর্ম জাপানে প্রদর্শিত হয়ে চলেছে নিয়মিত।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন, ভারতে তিনি শান্তি ও সৌভাগ্যের দেখা পেয়েছিলেন। কারণ, ছবি আঁকার উৎকৃষ্ট সুযোগ হয়েছিল সেখানে তাঁর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজের ছবি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার ছবিও যেমন নীরব, আমিও তাই, ব্যক্ত করাই তো ওদের কাজ, ব্যাখ্যা করা নয়’–আমিও তাই মনে করি।”
রবীন্দ্রভক্ত শিল্পী আকিনো ফুকু ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে ইহলোক ত্যাগ করেন ৯৩ বছর বয়সে।