ডাকযোগে হাতে এলো ‘তীরন্দাজ’ পত্রিকার উৎসব সংখ্যা ১৪২৮। কবি মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত পত্রিকার এই সংখ্যায় ‘লালন সাঁইজির দেশে’ শিরোনামে আমার একটি ভ্রমণগদ্য ছাপা হয়েছে। ফলে পত্রিকা হাতে পাওয়ামাত্র ভেতরে-ভেতরে লেখাপ্রকাশের যে অপার্থিব আনন্দ, সেটা অনুভূত হয়েছে বৈকি।
দীর্ঘ ২৪/২৫ বছরের লেখক জীবনে আমার এমন অভিজ্ঞতায় খুব একটা পার্থক্য হয়নি। বোধ করি, লেখকমাত্র কমবেশি অনুরূপ অনুভূতির কথা স্বীকার করবেন। বিদ্যালয়ফেরত ছোট্ট শিশুটি যেমন নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে এলে মায়ের মনে অভাবিত আনন্দ হয়। পোষা পায়রা খাঁচায় ফিরে এলে প্রভুর মনে যেমন স্বস্তি ফিরে আসে। নিজের কোনো লেখা সম্পাদকের টেবিল হয়ে ছাপার হরফে প্রকাশিত হলে এমন আনন্দপ্রাপ্তি নিশ্চয় দোষের কিছু নয়। লেখকের ভাবতাড়িত কিংবা হৃদয়মথিত শব্দরাজি সম্পাদকের টেবিল হয়ে মলাটবন্দি হয়েছে, এটাও লেখকের জন্যে স্বীকৃতি।
উৎসবের আবহে সংখ্যাটির নান্দনিক প্রচ্ছদ অলঙ্করণ করেছেন শিল্পী নাজিব তারেক ও রাকীব হাসান। ৩৩৬ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের পত্রিকায় বিচিত্ররকম লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে। সূচিপত্র দেখে আন্দাজ করা যাবে সম্পাদকের সুচিন্তার পরিশীলিত ছাপ।
প্রবীণ লেখকের পাশাপাশি এখানে যেমন নবীন লেখকের লেখা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। তেমনই বাংলাদেশের বাইরে ভিন্ন ভূখণ্ডে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী লেখকের লেখাও সংখ্যাটির বিশেষত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। কবিতাগুচ্ছ, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণগদ্য, সাক্ষাৎকার, চিত্রনাট্য, জার্নাল, অনূদিত কবিতা, অনূদিত ছোটগল্পসহ বিভিন্ন নিরীক্ষাধর্মী লেখা স্থান পেয়েছে। এ-যেন শিল্পের বর্ণিল আলোর ফোয়ারা।
করোনাকালীন দুঃসময়ে যখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। শারীরিক ও মানসিকভাবে আমারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখন এমন আঙ্গিকের পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারটি সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট সবার একনিষ্ঠতার প্রমাণ দেয় বৈকি।
সম্পাদকীয়তে সম্পাদক যেমনটি লিখেছেন-‘দুঃসহ সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা। এরকম সময়ে উৎসব সংখ্যা? কিছুটা বেমানান বৈকি। তবু বাঙালির জীবনে উৎসব একটা প্রধান অনুষঙ্গ । রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, উৎসব প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সম্মিলন ঘটিয়ে দেয়। মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে সেই প্রাণস্পর্শী সাহচর্যই তো চাই আমাদের। সমগ্র মানবজাতির। এই প্রথম, মনে হয়, অতিমারির মধ্য দিয়ে মানবমিলনের একটা ঐক্যসূত্র সৃষ্টি হলো। ভীতি যেন একাত্ম করে দিল পৃথিবীর মানুষকে। সবারই সাধারণ শত্রু কোভিড-১৯। আমরা লড়ছি, প্রাণরক্ষার উপায় খুঁজছি আর প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সম্মিলন ঘটিয়ে দেবার লক্ষ্যেই প্রকাশিত হলো এই উৎসব সংখ্যা। কৃষ্ণ-সময়ের ভেতরে প্রাণময় আলোর রূপালি রেখা।’
পত্রিকাটি শুরু হয়েছে প্রায় ২৫ পৃষ্ঠার বিস্ময়কর এক সাক্ষৎকার দিয়ে। বিস্ময়কর বলার কারণ, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রাবন্ধিক, সমাজচিন্তক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার এই সাক্ষাৎকারের মধ্যমণি। কবি ও অনুবাদক মাইনুল ইসলাম মানিক অত্যন্ত আন্তরিকতায় দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন। তাকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কারণ সাক্ষাৎকারটি সময়ের দলিল হয়ে রইলো। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া যতীন সরকারের দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতা ও দর্শনের অন্তরঙ্গ কথোপকথন এখানে গ্রথিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলের অন্তিমপর্ব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সাক্ষাৎকারের পরিধি। যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতিপথ ধরে সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি এবং শিল্পসাহিত্যের নানাপ্রসঙ্গ গভীর বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্যে এই সাক্ষাৎকার অবশ্যই পাঠ্য মনে করি। সাক্ষাৎকার সংগ্রাহকের ভাষ্যমতে, ত্রিশ হাজার শব্দের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের চৌম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
কবি ও ভ্রমণলেখক মাহমুদ হাফিজের লেখা ভ্রমণগদ্য ‘মাইকেল মধুসূদনের ভার্সাই’ পড়তে গিয়ে আমিও যেন লেখকের সঙ্গ নিয়েছি। ভার্সাইয়ে মহাকবি মাইকেলের স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চলগুলো লেখক সাবলীল গদ্যভাষায় উপস্থাপন করেছেন। মাইকেলের ব্যক্তিগত বেদনাহত সময়ের কথা পড়ে আমার মনও ভারাক্রান্ত হয়। মাহমুদ হাফিজের ভাষায়-‘কবির ভার্সাইজীবন চরম আর্থিক অনটনের। এখানে তিনি ইতালিয়ান কৰি পেত্রার্কাপ্রেমে পড়েন আর দেশে পত্র চালাচালি করতে থাকেন টাকা-পয়সা চেয়ে। সুন্দরবন লটের পৈত্রিক তালুক বন্ধক দিয়ে এলেও পত্তনিদাররা চুক্তিমতো তার স্ত্রীকে মাসোহরা দেয়নি বলে হেনরিয়েটা গিয়ে উঠেছে স্বামীর কাছে। এতে কবির সংসারের ভার আরও বেড়ে গেছে। পত্রের পর পত্র যাচ্ছে, আসছে না উত্তর। অনটনে উদ্বিগ্ন-চঞ্চল হয়ে পড়ছেন কবি।’
বুলগেরিয়ার দুজন কবি যথাক্রমে ইভান রিস্তভ এবং ডিমানা ইভানোভার কবিতা অনুবাদ করেছেন মাসুদুজ্জামান। এছাড়া অনূদিত গল্পও আছে। ‘মুদ্রা’ শিরোনামের চিত্রনাট্যটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। তানিয়া চক্রবর্তীর এই লেখায় নিষিদ্ধপল্লির তিনটি মেয়ের চরিত্রে উপাস্থাপিত লকডাউন চলাকালীন নির্মম বাস্তবতা। আমাদের চেনা জীবনের বাইরেও যে দগদগে ক্ষত নিয়ে নিদারুণ নারীজীবন বহমান, তা আড়ালেই থেকে যায়। চিত্রনাট্যের বনি, সুজি এবং রূপা চরিত্রত্রয় আমাদের তেমন জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এছাড়া কবি সিলভিয়া প্লাথের ‘জার্নাল’ অনুবাদ করেছেন রাজিয়া সুলতানা। এখানে বিষাদ-ভারাতুর কবির জীবনবোধের নিবিড়তা অনুভব করা যায়। জার্নালের পরতে পরতে প্রেম-কাম, বৈষম্য ও বিরোধের পথ ধরে বিপর্যস্ত সিলভিয়ার হৃদয়ক্ষরণ প্রকাশিত হয়েছে।
গল্প লিখেছেন সেলিনা হোসেন, ম্যারিনা নাসরীন, সুলতানা আজীম, স্বকৃত নোমান, সজল আশফাক, সাদিয়া সুলতানা, নাহার মনিকা, তিথি আফরোজ, শিল্পী নাজনীন এবং কিযী তাহনিন-সহ আরও অনেকে।
পবিত্র সরকার লিখেছেন ‘লিমেরিক’। প্রবন্ধ লিখেছেন রাশিদ আসকারী, রাজীব সরকার, হাকিম আরিফ এবং অভিজিৎ চক্রবর্তী। কবিতা লিখেছেন খালেদ হোসাইন, মাসুদ খান, টোকন ঠাকুর, মুজিব ইরম, মিনার মনসুর, আলফ্রেড খোকন, শোয়াইব জিবরান, শিবলী মোকতাদির, কুমার চক্রবর্তী, জফির সেতুসহ নবীন-প্রবীণ কবিদের গুচ্ছ-গুচ্ছ কবিতা তো আছেই।
তীরন্দাজ উৎসব সংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন অগ্রন্থিত কবিতা। বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি সৈয়দ শামসুল হকের অনূদিত দুটি উর্দু কবিতা, শহীদ কাদরীর প্রবন্ধ, আবুল হাসানের প্রথম কবিতা, সুরাইয়া খানম অনূদিত আবুল হাসানের প্রথম কবিতা এবং হুমায়ুন আজাদের প্রথম প্রকাশিত কবিতা কৌতূহলী পাঠকের মনে ভিন্ন শিল্পবোধ সঞ্চার করবে। সর্বোপরি, তীরন্দাজ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যাটি শিল্পমগ্ন পাঠকের সংগ্রহের তালিকায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। সম্পাদক মাসুদুজ্জামান এবং বিভাগীয় সম্পাদক সুবর্ণ আদিত্য , আশান উজ জামান, এবং মাইনুল ইসলাম মানিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই।
[লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের ]