সাদা কার্বন (পর্ব-২)
যে মানুষটাকে আমরা পছন্দ করি, খুব ভালোবেসে ফেলি। বিশ্বাস করি। কিছুদিন পরে সেই মানুষটার ভিতরে আগের সেই মানুষটাকে আর খুঁজে পাই না। এটা প্রায় সবার বেলায়ই হয়। কিছু আগে অথবা পরে। সেই মানুষটার ব্যবহারে আমরা আহত হই, ক্ষত হই, অবাক বিস্ময়ে হতবাক হই। যোগবিয়োগ মেলাতে গিয়ে সবকিছু মিলিয়ে উঠতে পারি না। হাল ছেড়ে দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুক হালকা করে টিকে থাকতে চেষ্টা করি। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না ওই মানুষটা এমন করতে পারে। কীভাবে পারে! আশ্চর্য!
আসলে মানুষের ভেতরগত আচরণের কোনো শ্রেণিবিন্যাস হয় না। সভ্যতা ভব্যতা, যৌনতার ব্যাপারে মানুষকে শ্রেণিবিন্যাস করা যায় না। এসবের বেলায় মানুষ- শ্রেফ মানুষ। কোনো মানুষের কাছ থেকেই অমন কিছু ওন করা ঠিক নয়। শুধুমাত্র মানুষ, হ্যা, মানুষ পারে না- এমন কিছু নেই।
মানুষের আসল সভ্যতা কখন ধরা পড়ে জানেন? যখন মানুষ ভিড়ের মধ্যে থাকে না। সে হতে পারে সঙ্গীর সাথে একান্তে, গৃহে, ড্রাইভার ও গৃহকর্মীর সাথে মালিকের। বাজার করতে দোকানদারের সাথে। রিকশা চালকের সাথে আচরণ- এসব। এইখানেই এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের পার্থক্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, প্রাচুর্য, ধন সম্পদের বিকাশ বা চর্চায় মানুষের কিছু পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে না। আমাদের সাধারণ ও স্বাভাবিক বিশ্বাসে মানুষ সমর্পিত ধারণা খটকা খায়। প্রেম বা অন্যান্য সম্পর্কও এমনটাই। কারো সাথে কারো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবরকমই হতে পারে। শিক্ষক, মালিক, স্টুডেন্ট, সবাই সবার সাথে সম্বন্ধিত হতে পারে এবং হয়। এজন্যই অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সঠিক যে, মানুষের ভেতরের র মেটেরিয়াল আসলে প্রাণীকূল। জৈবিক চাহিদার কাছে মানুষ তার নিজের মতোই।
অবাক হবার কিছু নেই। মানুষ পারে না-এমন কিছু নেই। বরং ভালোবাসা কিছুটা হলেও বোঝে প্রাণীকূল। সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই। আমরা আসলে সত্য পছন্দ করি, তাই ‘সত্যি’ ভাবতেও পছন্দ করি। তাতে করে স্বস্তি বোধ করি, তৃপ্তি পাই। ব্যাপারটা আয়নার মতো; কী সুন্দর চকচকে। কিন্তু পেছনে পারদ থাকে। বিষাক্ত; চকচকে রূপটি ভেঙে পড়লে তবেই এই ভুল ভাঙে। চূড়ান্তভাবে যখন কিছু বুঝে যাই, তখন আগের আবছা বোঝাগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছুই করার থাকে না। ভাবনার ওজন বাড়তে থাকে শুধু। এই সমাজে লড়াই করে কোনো লাভ নেই। নেতিবাচক মন্তব্য সর্বপ্রথম কাছের মানুষ থেকেই আসে।
সৈনিক মন একা হতে হতে নিঃসঙ্গ হয়ে যায় শেষে। সাহস আর সততা- এই হলো অস্ত্র। সাহস ভেঙে দেয় কিছু মানুষ, মুখোশধারী ভালো মানুষ সেজে ক্ষমতায় আসীন যারা। তাদের কাছে সততা ও সত্য মূল্যহীন। লোভীরা চিরকাল কাপুরুষ হয়, চোরের থেকেও হীন। দেখবেন সাহসীরা চুরি করে না, কারোর ক্ষতিও করে না। যুদ্ধ করে সৎ ভাবে বাঁচতে চায়। নিরবে সরে যায় মুখোশের মিছিল থেকে। সত্যের অপেক্ষায়। সত্য বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে না। সত্য- সত্যই। সত্য নির্বিকার। নিরব। প্রথিত। আবার বিচ্ছুরিত। সত্য কতকিছু।
মিথ্যা কিন্তু শুধু মিথ্যাই। মিথ্যা দ্বারা অনেক রকম ঘটনা মানুষের জীবেন ঘটতে থাকে। অযাচিতভাবে আসে। কষ্ট তৈরি হয়। কিছু কষ্টের ঘটনা মানুষকে ক্রাইসিসে ফেলে দেয়। কষ্ট মানুষকে অস্থির করে-এটা তো সত্যিই। সেটা কাটানোর জন্য সময় দরকার হয়। কে-ই বা কাকে সময় দেয়। অথচ সময় কাটায়।
টাইম পাস্ বোঝেন ? তেমন….এরকম কষ্টের সময়ে কাউকে সঙ্গে পাওয়া যায় না খুব একটা। এগিয়ে আসা তো দূরের কথা বরং এড়িয়ে চলে পরিচিত লোকজন। যদিও কাছের মানুষ বলতে কিচ্ছু নেই এখন তেমন। তবুও…। যারা আছে, তারাই এড়িয়ে চলে। জেনেও মানতে হয়; এরাই আমাদের বন্ধু। এরাই ভ্রাতা, ভগ্নি। এরাই দারুণ শুভাকাঙ্খী। অনেকে বিরক্তও হতে পারে।
কিন্তু দরকার তার উল্টো। মানুষের ক্রাইসিসের সময়ে তার ওপর বিরক্ত হতে নেই বরং সঙ্গ দিতে হয়। এটা আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছি সারাজীবন। নিজের জন্যে পাইনি এমন কাউকে। সুখের বিষয় হচ্ছে, আমার ছেলে এই শিক্ষাটা পেয়েছে। জীবনের কর্মসঙ্গে।
সবসময়ই দেখেছি। দুঃসময়ে কেউ আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আর কেউ কেউ মেরে ফেলে। মরে যাবার জন্য কিছু কারণ তৈরি করতে থাকে।
বেঁচে থাকার জন্য যেমন কিছু অনুষঙ্গ থাকে, মরার জন্য থাকে কারণ।
বাঁচার অনুষঙ্গ আসে সহজাত ভাবে, হিসেবের বাইরে। আর মরার কারণ কেউ না কেউ তৈরি করে অযাচিত ভাবে। অকারণে। নিজের অতিরিক্ত লোভ ও মোহের কারণে।
আমি মরে গেলে অনেক রকম কারণ থেকে যাবে। যারা এসব করে তারাও তো একসময় মারা যাবে, তাই না? তবু ভালো থাকুক সবাই।
ভালো থাকুক পৃথিবী আমার।
যারা প্রতারণা করেছে প্রেম ও প্রকৃতির সাথে। তাদের যথপোযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত কাম্য। পৃথিবী সেই সব প্রতারকের জন্য অপেক্ষায় আছে। প্রকৃতির কাছে বড় অসহায় এই ক্ষমাশূন্য ধূসর জগত। তারা নত হোক পৃথিবীর কাছে।