পর্ব-১
দ্বিতীয় শ্রাবণ ফোটালো প্রথম কদম ফুল
বুবলি নামের এক ঊনিশ-বিশ বছরের মেয়ে বিধবা আকলিমা খানমের জীবন ও সংসারে এক স্বর্ণালী আভার মতো উদিত হয়েছে।আকলিমা খাতুনের স্বামী নেই প্রায় একযুগ। স্বামী যখন মারা গেছেন, ছেলেদের তখনো কোনোটা লেখাপড়াই শেষ হয়নি। স্বামী হাবিবুর রহমানের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা যৎসামান্য টাকা-পয়সা আকললিমা খানম খুঁটে খুঁটে গুছিয়ে বড় দুটির লেখাপড়া শেষ করিয়েছেন। বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছেন। কিন্তু ছোট ছেলে তন্ময় পাবলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়ায় একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। সেখানেও রেজাল্ট ভালো না করায় সে নিজেই মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিলো।
লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার পর সেই সকাল হলে আকলিমা খানমের ছোট ছেলে তন্ময় বেরিয়ে যায়। আসে অনেক রাতে। তার হাত খরচ যা, তা সে মায়ের কাছ থেকেই নেয়। তবে জুলুম করে নেয় না। কারণ সে জানে, বাবার যা ছিলো, ভাঙাচোরা রাস্তা বেয়ে সরু কানাগলির শেষ মাথার এই চার রুমের সেমিপাকা বাড়িটি ছাড়া আর কিছু নেই! তাও বাবা বাড়িটি মার নামে কিনেছিলেন বলে মার রক্ষা। নাহলে বড় দুইভাইয়ের যা রূপ প্রকাশ হতে দেখছে সে, এ বাড়ি বিক্রি করে যার যার ভাগের টাকা নিয়ে তাকে আর তার মাকে পথে বসিয়ে যেতো।
আর তন্ময়ের বড় দুই ভাইয়ের ধারণা, মা কুড়িয়ে কাছিয়ে যা করুক টাকা তো বাবারই। বাবারই দায়িত্ব ছিলো তাদের লেখাপড়া করানো।এখন তাদের লেখাপড়া শেষ।চাকরি হয়েছে।যারযার সংসার হয়েছে।একটি দুটি করে সন্তানও হয়েছে।এখন তারা দুই ভাইয়ের কেউই আর সরু এঁদো গলির টিনসেড বাড়িতে থাকতে চাইছে না। তারা বুঝে গেছে, যে বাড়িতে গাড়ি ঢোকা দূরে থাক রিকশাও ছাড়তে হয় বড় রাস্তায় নেমে, সে দুইকাঠা জমি আর কত বিক্রিও হবে! তাই আকলিমা খানমের বড় দুই পুত্রের পরিকল্পনা দুইভাই-ই তারা এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলাদা আলাদা থাকবে।
বড় দুই ছেলে আর দুই বউয়ের পরিকল্পনার টুকটাক কথা যা কানে আসে আকলিমা খান বুঝে নেন বেশিটা। কিন্তু কাউকে বলেন না কিছুই। ছেলেরা বউয়েরা নিজেরা নিজেরা যা আকলিমা খানমকে না জানিয়ে পরিকল্পনা করে, তারা মনে করে, মা এটুকু জানে না। কিন্তু ভাবগতিকে মা আকলিমা খানমের মনে খবর হয়ে তিনি যে ভয়ে দমে আছেন, সেটুকু তিনি লুকিয়ে রাখেন না। তিনি ছেলেদের বলেন, তোরা যে যার মতো চলে গেলে আমি একা থাকতে ভয় পাবো!
ছেলেরা বলে, তোমার ছোট ছেলে তো রইলো। আর ভয়ই বা কি?
: আমি তো কখনো একা থাকিনি। তোদের বাবা আমাকে রেখে কোনোদিন কোথাও যায়নি! তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও তিনি তা তদবির করে ঠেকিয়েছেন। সংসার পাগল মানুষ ছিলেন তিনি।তোদেরকে ছেড়ে একটা রাত তিনি কোথাও থাকবেন,এ তিনি ভাবতেও পারতেন না!তারপর তোরা তিন ভাই বড় হতে হতে বাড়িটা চাঁদের হাট হয়ে উঠলো। তোদের বাবা মারা গেলেও পরপর বাড়িতে দুটো বউ এলো, তারপর এই যে আমার তিন তিনজন নাতি-নাতনি, আমি তো মরণ পর্যন্ত এদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না!’
আকলিমা খানম এতখানি আক্ষেপ-শঙ্কা নিজের পেটের ছেলেদের কাছে অকপটে ব্যক্ত করে ফেলে নিজের মনের ভার নামালেও টের পান, তার কথা ছেলেরা আমলে নিচ্ছে না।তারওপর বড় দুই ছেলের কেউই বলছে না, তন্ময়কে যেমন হোক একটা বিয়ে দিয়ে বাড়িতে রেখে তুমি আমাদের কারো সাথে থাকবে।বা বলতে পারে, তোমার যখন যেখানে থাকতে ভালো লাগে তুমি ঘুরেফিরে থাকবে।তন্ময় বাড়িটার একটা অংশে থাকবে। আরেক অংশ সে ভাড়া দিয়ে কিছু টাকা পাবে।আর চাকরি-বাকরি যা হোক কিছু হবে!না, এমন আশ্বাস তাকে রোজগেরে দুই ছেলের কেউই দেয় না!
আকলিমা খানম বুঝতে পারেন ছেলেদের সাথে তার এই সম্পর্কের টানাপোড়েন তাকে অসুস্থ করে তুলছে। তার হাত-পা জ্বালাপোড়া করে। সারা শরীর ঝিমঝিম করে।এমনিতে এখন শরীর এমনি করার বয়স।তার ওপর এসব উদ্বেগে তা আরো বাড়ে। জগৎ-সংসারের সাত-পাঁচ অনুপূঙ্ক্ষভাবে না বুঝেও আকলিমা খানমের নিজের প্রতি একটা ভালোবাসা আছে।বেঁচে থাকতে তার বড় লোভ।সারাজীবন স্বপ্ন দেখে আসছেন, ছেলেরা বড় হলে তিনি অভিজাত এলাকায় না হোক, নিম্ন মধ্যবিত্তের এলাকাতেই একটা ঝকঝকে বড় না হোক মাঝারি পরিসরের বাসায় বসবাস করবেন। কিন্তু জীর্ণ ভেলার মতো তিনি একাই সবাইকে বুকে করে ভয়াল সাগর পাড়ি দিয়ে কূলে এসে দেখেন, তাকে রেখে সবাই সমতলে চলে যাচ্ছে। তিনি একাই পড়ে আছেন অ-কূল, অঘাটে।
এর ভেতর এক দুপুরে কৈশরে উত্তীর্ণ এক তরুণী তন্ময়ের খোঁজে বাসায় এসে আকলিমা খানমের উদ্বেগ হুহু করে আরো খানিক বাড়িয়ে দিয়েছে! অচেনা তরুণীর আগমন টের পেয়ে বাড়ির দুই বউ ছুটে এসে কৌতুহলে তাদের ফেটে পড়ার দশা। আকলিমা খানম মেয়েটির সাজ-পোশাক আর কথা বলার ধরণ দেখে তাকে না পারছেন বসতে বলতে। না তার পারছেন তার নাম জিজ্ঞেস করতে। কারণ সে যেভাবে ইংলিশ বলছে, তিন নারীর কারোই বিদ্যায় কুলোচ্ছে না তা বুঝে ঝটপট উত্তর দেয়। অবশেষে সে একসাথে তিন নারীর অপারগতা বুঝে বাংলাতেই স্বাভাবিকভাবে তার কথা বলতে লাগলো। তন্ময় বাসায় নেই শুনে তরুণী তার জন্য অপেক্ষা করতে চাইলো। এতে শাশুড়িসহ দুই বউ আরো ভড়কে গেলো। কিন্তু কারো বসতে বলার তোয়াক্কা না করে তরুণী নিজেই পুরনো তেলচিটে সোফায় গিয়ে স্বাচ্ছন্দে বসে পড়লো। আকলিমা খানম হতবিহ্বল হয়ে বললেন, তুমি কেন এসেছো তন্ময়ের কাছে?
তরুণী বুঝতে পারছে, আকলিমা খানম থতমত খাচ্ছেন। তার ইংরেজি শুনে মেলাতে পারছেন না, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এই মেয়ে এখানে কেন এসেছে! তাই পরিস্থিতি সহজ করতে মেয়েটি বাংলাতেই বলতে লাগলো। আমার নাম বুবলি। তন্ময় আমার বন্ধু। ওর সাথে অনেকদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। কিন্তু একসপ্তাহ যাবত ওর কোনো খোঁজ নেই। ফোন করলে কল ঢুকছে না। এই দেখেন, বলে ওদের সামনে আরো কয়েকবার চেষ্টা করলো। তারপর বললো, তাই আজ এক বন্ধুর থেকে কাছ থেকে ওর বাসার ঠিকানা নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম। খুব কষ্ট হয়েছে আপনাদের এই মৌলবিরটেক বাসা খুঁজে পেতে। জানেন, আগে আমি এই জায়গার নামও শুনিনি। অনেক দূর হেঁটে এসেছি। আমাকে একটু পানি দেবেন?
তরুণী ঠিক নয়। কৈশর পেরনো এক মেয়ের এমন অকপট কথায় আকলিমার খানমের কিছুটা সন্দেহ কমে এলো। যদিও তার সব কথা বড় মানুষের কথার মতো শোনায়। তিনি কাউকে না বলে নিজেই উঠলেন পানি আনতে। কারণ তিনি জানেন তার থেকে দ্রুত আর কেউ পানি নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি স্বাভাবিক পানির সাথে মিলিয়ে, দুখানা বিস্কুট বৈয়ম থেকে ছোঁ মেরে একটা রেকাবিতে তুলে আনতে যেটুকু সময়, এর ভেতর এসে শোনেন বড় বউমার প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি বলছে তারা ধানমন্ডি থাকে। তিন ভাই-বোন তারা। ভাই দুটি বড়। তারা একজন নরওয়ে, আরেকজন রাশিয়ায় লেখাপড়া করে। আর সে দেশে একটি নামকরা ইংলিশ স্কুলে পড়তো। কিন্তু মা মারা গেলে তার আর লেখাপড়া করতে ভাললাগেনি। দুইবার পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেনি বলে বাবা আর প্রেসার ক্রিয়েট করেননি! কিন্তু একাডেমিক লেখাপড়া না করলেও বিভিন্ন বিষয়ে সে একাই লেখাপড়া করছে নিজের মতো একটা কিছু করতে!
চলবে…