সাদা কার্বন (পর্ব-৩) ॥ ইসমত শিল্পী


সাদা কার্বন (পর্ব-৩)

বোঝা গেলো, আমার পেরে না ওঠার চাইতে আপনাদের মানসম্মান অনেক দামি। সংসার নেই, সমুদ্র আছে।আমরা সেই সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে ডুবে যেতে থাকি। হাবুডুবু খাই। একসময় ডুবে থাকতে শিখে নিই। নিজের তাগিদ থেকেই আমরা লবণ পছন্দ করি। ভালোলাগা নেই, তবুও লবণাক্ত স্রোত গজিয়ে ওঠা চোখে ওই সমুদ্র দেখতে থাকি। আহ্ কী সুন্দর কষ্ট। কী ডুবন্ত কোলাহল। কী সুন্দর বঞ্চনা। কী কঠিন শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধটা। কী অনাবিল দুঃখের ঘরবাড়ি অনাবৃত জলের গহ্বরে।

তুমি ভালো নেই ভাবতে পছন্দ করি। কারণ ভালোবাসার প্রতি সহজাত আকর্ষণ একসময় বিবর্ণ হয়। ঘোলাটে অস্বচ্ছ। আঁশটে গন্ধ মানুষের মাঝে মধ্যে বেশিই পছন্দের।

আমার কি মনে হয় জানেন? মানুষের সাথে মানুষের এত যোগাযোগ থাকতে হবে কেন? মানুষ কি পাখি? এমনটা আপনার মনে হয় কখনো! মানুষ মানুষের সাথে কথা বলে, সব সময় কি সব কথা সংলাপের মাধ্যমে হয়? হয় না।

এ দুটোর কোনটাই একভাবে হয় না। না বলাতেও অনেক কিছু হয়ে যায়। না থাকাতেও কতকিছু থাকে। প্রকাশ্য অতিক্রম ক’রে অপ্রকাশ্যের এসব বেঁচে থাকা আছে বলেই মরে গিয়েও বেঁচে থাকে মানুষ। রূপে না হোক প্রতিরূপে থাকে।

চিহ্নিত করে সবকিছুকে সীমিত করতে ইচ্ছে করে না আমার। কিন্তু সবকিছু তো চিহ্নিত রূপ এবং সংলাপেই অধিক গণ্য হয়। তাই হারিয়ে যাওয়া পথেই এগিয়ে যেতে হয় বারবার। অপ্রস্তুত ভাবে। অকারণে। অজান্তেই।। মানুষ মানুষের সাথে কথা বলে, মানুষের মতো থেকে যায়। আমি আমার মতোই। না থেকেও আমার মতো করে থাকি।

প্রতিদিন একটা আলাদা দিন হয়, প্রতি রাতে আলাদা রকম রাত। আমি এর রকমফের বুঝি না তেমনভাবে। শুধু এটুকু বুঝি, প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখি। কিছুটা ভাঙচুর থেকে বিনয় শিখি। সেটুকুই অর্জন। আমি মনে করি, শক্তি দিয়ে অর্জন করতে হয় আর সামর্থ্য দিয়ে তা ধরে রাখতে হয় এবং রক্ষা করতে হয়। এখন শক্তিবাদীর যুগ। সবখানে শক্তির-ই জয় জয়কার। তাই টিকে থাকার লড়াইটাও খুব বেশি।

লড়াই মানেই হারজিতের মাপজোক, আমার তেমন মনে হয় না। আমার কাছে লড়াই হলো, নিজের কাছে নিজের অবস্থান আরেকটু পোক্ত করতে পারা। মানসিকভাবে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এগোতে না পারলেও যেনো ভেঙে না পড়ি। জোঁকের মতো আকড়ে ধরি নিজের অবস্থানটা। যা একান্তই আমার। আমার নিজস্ব সৌন্দর্য। আমার সম্পদ।

এই করোনাকালে সবাই যখন মৃত্যু আশঙ্কা নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। ভুগছি ভীষণ। তখনো নিজেদের মধ্যে কিছু হীন মানসিকতার মানুষ বিবাদ সৃষ্টি করতে পারে, ভাবতেও পারি না! মনের ভিতর বিদ্বেষ ও বিবাদমুখোর মানুষগুলোকে আরও একটু উপেক্ষা করতে পারার শক্তি প্রথিত হোক মনে এই কামনা করি প্রতিনিয়ত।

মনে হয়, এতটা অবুঝ কেন আমি! কেনই বা বিপন্ন এতো, বিঘত এই বোধ! ইহলোকে কতবার আত্মহত্যা করে যাচ্ছি রোজ, আমিও জানি না। আপনি কি জানেন? আপনার কি চোখ মুখ আঙুল ঘাসের উপর দিয়ে হাসতে হাসতে ছোটে, অবেলায়? আপনার কষ্ট হয়- বিকেল অথবা সন্ধ্যায়? দেশলাই জ্বেলে আরশোলা খোঁজেন গভীর রাতে? দেয়ালে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বাথরুমের সুইচ খোঁজেন? অথবা ঘুম ভেঙে গেলে মারাত্মক জ্বোরোকণ্ঠে জল চেয়ে চুপ হয়ে যান! কেমন লাগে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভুলে স্বরিত সে-ই জীবন?

কেউ একজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে আপনার জন্যে, মনে হয় কখনো? সারাক্ষণ অলোক বেলার পাখি হয়ে উড়ে যায় ঘুরে আসে কেউ, এমনটা মনে হয়? পায়ের তলায় ফুস্কুড়ির যন্ত্রণায় কাতর হলে হাসি আসে? তাচ্ছিল্য উপহাস করেন নিজস্ব অনুভূতি।

না। এসবে কিচ্ছু হয় না! ঘরভর্তি শূন্যতায় ডুবে যায় রোদ। বেলায় বেলায় উন্মুক্ত হয় ভোর। দিনের মাথায় রাত আর রাতের পরে দিন হবেই, এমন তো কথা নেই। তবু তা-ই তো হয়; সময়ের সাথে সময়ের বন্ধুত্ব হয় না বলেই মৃত্যু দেখি এত! সময়কে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ, আমরা কি কখোনোই তা জানবো না।