ধারাবাহিক গল্প (পর্ব-২) ॥ দ্বিতীয় শ্রাবণ ফোটালো প্রথম কদম ফুল


পর্ব-২
একপর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুবলিকে রেখেই বউ দুটিকে তাদের যার যার সন্তান নিয়ে মধ্যাহ্নের ব্যস্ততায় ভিড়তে হলো। শুধু সঙ্কটাপন্ন মনোভাব নিয়ে আকলিমা খানমকে বুবলির সামনে বসে থাকতে হলো। বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছেন আকলিমা খানম। তিনি বললেন, আমি তোমাকে একটা গল্পের বই দিই পড়তে থাকো। তারপর তোমার জন্য একটু খাবারের জোগাড় করি।আমার বউমা দুজন বুঝতে পারেনি যে দুপুরে আসা অতিথিকে দুপুরের মতোই খাবার দিতে হয়।

বুবলি বললো, খাবার দেবেন? দেন! কিন্তু আমি যে একেবারে শূন্য হাতে চলে এসেছি।বাড়িতে বাচ্চা আছে।আসলে আমার মাথায় আসেনি এসব। আর বাসা পর্যন্তই আসতে হবে ওকে খুঁজতে তাও ভাবিনি।
আকলিমা খানম বললেন, ওমা, সে কি কথা! তুমি যে কারণেই আস না কেন, আমি প্রথমে ভড়কে গেলেও এখন কিন্তু আমার ভালো লাগছে।বলে তিনি একবোঝা বই এনে বুবলির সামনে রাখলেন। দেখলেনও না স্তূপাবস্থায় কী কী বই দিলেন। তারপর দ্রুতই আবার এসে এককাপ চা তার সামনে রেখে গেলেন।

এটুকু সময়ের ভেতর চা! বুবলি যে আশ্চর্য হয়ে আকলিমা খানমের দিকে তাকালো, আকলিমা খানমের আর সময় ছিলো না তা চোখ পেতে দেখার। তিনি দৌড়েই রান্নাঘরে ঢুকলেন এবং বুবলি সম্পর্কে মনে মনে ভাবলেন, এর ভেতর কোনো মেয়েলি আচরণ টের পাচ্ছি না। আবার কোনো পুরুষালী আচরণও করছে না। অথচ চেনাজানা কোনো মেয়ের সাথে একে তুলনা করা যাচ্ছে না। তিনি ভাবতে লাগলেন, তন্ময়ের সাথে এমন একটি মেয়ের অপেক্ষা করার সম্পর্ক কেন হতে যাবে! কী চায় সে তন্ময়ের কাছে! দেখে তো মনে হচ্ছে বড়লোলোকের মেয়ে। দু-দুবার ফেল করেছে, তাও কেমন অকপটে স্বীকার করলো।

আকলিমা খানম গরম ভাত আর ডিমের গরম গরম দোপিঁয়াজি এবং মাখা মাখা ডাল ট্রেতে সাজিয়ে ড্রয়িংরুমের টিপাইয়ের ওপর রাখতেই বুবলি তা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে এলো। বললো, লিমা আন্টি আপনি কষ্ট করে এটুকু সময়ের ভেতর আমার জন্য বাড়তি আয়োজন করেছেন, এই তো বেশি। আমি টেবিলে বসে আপনার সাথেই খাই।
আকলিমা খানম বললেন, আমার নাম লিমা তা তোমাকে কে বললো?
: ওই যে গেটে আকলিমা খানম লেখা?
: কিন্তু লিমা?
: আমি একটু মডার্ণ করে নিলাম!
বুবলির কথায় অনেক দুঃখের ভেতরও হেসে ফেললেন আকলিমা খানম। তারপর তিনি খেয়াল করলেন, তিনি মেপে যা খাবার দিয়েছেন, তার প্রায় সবটাই বুবলি খেয়েছে এবং তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে।তাকেও তার পাশে বসে খেতে বাধ্য করেছে। এতে তার এই অসময়ে ঝক্কি করার ক্লান্তি বহুগুণ আনন্দে ভরিয়ে দিলো। কারণ তিনি খেয়াল করছেন, তিনি রান্না করছেন জানলেই ছেলেরা একটা না একটা খুঁত বের করে। এমন লেখাপড়ায় এগোতে না পারা, কোনো কাজকর্ম জোগাড় করতে না পারা ছোটটাও। আর বউ দুটোও কখনো বলে না, কোনটা কেমন হলো। এইসব ছোটখাটো ঘটনার মাধ্যমে তারা তার বেঁচে থাকার আনন্দের উৎসে ছাই ছিটিয়ে দেয়। আজ এই অযাচিত অতিথি মেয়েটির মুখের একটু তৃপ্তিভাব তাকে যে সুখভাবটুকু এনে দিলো, তিনি সেই জোয়ারে ভেসে বললেন, আবার চা খাবে মা?
:এখুনি দেবেন? আপনার কষ্ট হবে না?
: তুমি খেয়ে আনন্দ পেলে আমার খারাপ লাগবে না!
: দেন তাহলে? আমি কিন্তু ঘন দুধের চা খাই!

আকলিমা খানম অনেকদিন পর একটু হাসলেন। বললেন, আমিও। আর মনে মনে বললেন, কিন্ত সেদিন তো এখন বাসি। সেই ঘন দুধের চায়ের দিন! আসলে চা তিনি নিজের জন্য কখনোই করেন না।
আকলিমা খানম বড় কাপ ভরে ছলকানো চা নিয়ে বুবলির কাছে পৌঁছুতেই গেটে কলিংবেলের শব্দ। বউয়েরা তাদের বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই তাই তাকেই যেতে হলো গেট খুলতে!
এই ঘোর অসময়ে তন্ময়কে দেখে আকলিমা খানম আঁতকে উঠলেন। সাধারণত তার ছোট ছেলে কখনো বাসা থেকে বের হতে ভর দুপুর লাগায়। কিন্তু ভর দুপুরে বাসায় ফেরে না। তিনি নিচু কণ্ঠে বললেন, তোর জন্য একটি মেয়ে এসে অপেক্ষা করছে। তন্ময়, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, আমার জন্য কেউ বাসায় এসে আপেক্ষা করবে? তাও আবার একটা মেয়ে? দেখি সরো তো, কে?
তন্ময় মাকে ঠেলে সরিয়ে নিজেই বসবার ঘরে ঢুকে বুবলিকে দেখে মাথায় হাত দিয়ে বললো, তুমি?
: তোমাকে ক’দিন দেখি না। ফোন করি, কল ঢোকে না, তাই ভাবলাম, খুঁজে দেখি তোমার কি হলো?
: তন্ময় একটু লজ্জা পেয়ে বললো, যাহ, আমাকে এতো খোঁজাখুঁজি করার মতো কি তোমার সাথে আমার সম্পর্ক? বুঝেছি, পল্লব, রায়হান, সাকিরা কেন তোমাকে মহিলা হিমু বলে! তা এরা তোমাকে কিছু খেতেটেতে দিয়েছে তো? বড় ভাবি…! মেজো ভাবি…!
তন্ময়ের ডাকে আশ্চর্য হয়ে দুদিকের দুই রুম থেকে দুই বউ ছুটে এলো। আকলিমা খানম বললেন, কেন সবাইকে ডেকে বাড়ি মাথায় করছিস? আমি ওকে খাইয়েছি!

ভাবিরা এসে তন্ময়ের দিকে চোখ টিপে হাসতে লাগলো। বোঝাতে চাইলো, তলে তলে এদ্দূর! দুই বউয়ের ভাববাচ্যের প্রশ্নের উত্তর তন্ময় বুবলির সামনেই দিলো। বললো, ওর এই আগমন তোমরা বাঁকা চোখে দেখো না!
বড় বউ চোখ কাৎ করে বললো, না তো! একদম সোজা চোখে দেখছি!
তন্ময় মেজো বউয়ের দিকে চেয়ে বড় বউয়ের কথার উত্তর দিলো। বললো, ভাবি, ও হলো মহিলা হিমু! নাহলে আমাদের এই এঁদো গলিতে ঢুকে ড্রেনের উপচেপড়া পানি পায়ে মাখামাখি করে আসতে পারে?’
মেজো বউও কী ইশারা করলো চোখে।তার ইশারার জের ধরে তন্ময় কথা অব্যাহত রাখলো, বললো, যেখানে আমরা একবার ঢুকলে আর কেউ বেরোতে চাই না, পায়ে ড্রেনের গড়ানো পানি লাগবে বলে! সেই গলি পেরিয়ে আমার মতো এক হতচ্ছাড়ার জন্য যে এসে বসে থাকে, সে আসলে এক ঘরবিরোধী মানুষ! আর তা তোমরা ধীরে ধীরে টেরও পাবে। আর মা জানো, ও একজন তুখোড় ছাত্রী। তবু ইচ্ছে করে ফেল করে আমার মতো কয়েকজন বাউণ্ডুলের সাথে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়! আর আমাদের খাবারের বেশির ভাগ দাম ও-ই মিটায়।
মেজো বউ ফিসফিসিয়ে বললো, ও কোথায় চাকরি করে?

তন্ময় জোরে উত্তর দিলো, ও চাকরি করবে কি? ওদের আইটি ফার্ম আছে। সেখানে ওর আন্ডারেই অনেকে চাকরি করে!
দুই বউ প্রায় একসাথে বললো, তয় যে বললেন …দুবারই ফেল করেছে?
ফেল করে কারো অধীনে চাকরি করা যায় না। কিন্তু যারা চাকরি করতে পারে তাদের বস হওয়া যায়।
তন্ময় নিজেই আজ রান্নাঘরে ঢুকে খালি হাঁড়িপাতিল কাছিয়ে যেখানে যতটুকু পেলো একসাথে নিয়ে বসতে বসতে বুবলিকে বললো, খাবে নাকি আর চারটে?
: না ভাত আর খাবো না পেট ভরা আছে। তবে লিমা আন্টি তোমাকে যখন চা দেবে আমাকেও দিতে বলো?
তন্ময় চোখ কপালে তুলে বললো, লিমা আন্টি কে?
: তোমার আম্মা! আকলিমা থেকে লিমা রেখেছি!
: বাহ্, এটা তো আমাদের মাথায় কখনো আসেনি! বরং সেকেলে নাম বলে কেউ মায়ের নাম জিজ্ঞেস করলে কুণ্ঠিত হই!
: কেন? আকলিমা নাম খারাপ কি? আকলিমা অর্থ দেশ, সাম্রাজ্য। আদম আ.এর এক কন্যার নাম আকলিমা ছিলো। যাকে কেন্দ্র করে হাবিল এবং কাবিলের সাথে কলহ বাঁধে এবং একজনের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কলহ শেষ হয়।
তন্ময় বললো, কোনখান থেকে মেরে দিলে তা স্বীকার করলে না?
বুবলি বললো, এটা সত্য কথা। কোথায় পড়েছি আমি মনে করে বসে আছি নাকি?

চলবে…