পর্ব-১
ঝড়ের রাত।
তুমুল বাতাসের সঙ্গে বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বৃষ্টি কিছুতেই থামছে না। কখন থামবে তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মধ্যরাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন কাজী নজরুল। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বাসরঘর ছেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে পা বাড়িয়েছেন তিনি। চারদিকে গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল। ঘন অন্ধকার। সামনে পা ফেলতেই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে হিমশীতল বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। ঠাণ্ডায় একেবারে কুকড়ে যাওয়ার দশা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তার শরীরে কাঁপন শুরু হলো। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে লাগল। তারপরও তিনি হাঁটছেন। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় কখনো পা ফসকে পড়ে যান। আবার কখনো বর্জপাতের কান ফাটানো শব্দে চমকে ওঠেন। বড় কোনো গাছের আড়ালে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার তিনি হাঁটতে শুরু করেন।
নার্গিস ঘরে একা। সে কাঁদছে। কান্নার শব্দটা বড় করুন শোনাচ্ছে। রাতে কান্নার শব্দ পেয়ে আসমাতুন্নেসা ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠেন। কান্নার শব্দ কোন দিক থেকে আসছে তা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি উৎকণ্ঠার সঙ্গে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন, এতোরাতে কে কাঁদছে! কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসছে! নার্গিসের ঘর থেকে! কেন? বাসররাতে সে কেন কাঁদবে? এই কান্না নিশ্চয়ই আনন্দের কান্না নয়! এমন ঘটা করে বিয়ে হলো! তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কান্নার কি হলো?
আসমাতুন্নেসা নার্গিসের ঘরের দিকে ছুটে যান। ঘরের দরজার সামনে এসে আবার কান পাতেন। থেকে থেকে কান্নার শব্দ আসছে তার কানে। এবার তিনি নিশ্চিত হন। হ্যাঁ, নার্গিসই কাঁদছে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে নার্গিসের ঘরের দরজায় টোকা দেন। মৃদু স্বরে ডাকেন। নার্গিস! নার্গিস!
নার্গিস কান্না থামায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আবার কান্না শুরু করে। আসমাতুন্নেসা আবার ডাকেন, নার্গিস! মা আমার! কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
এবারও নার্গিস চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। আসমাতুন্নেসা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মেয়েকে ডাকেন। মা নার্গিস! দরজা খোল মা!
অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পর দরজা খোলে নার্গিস। আসমাতুন্নেসা ঘরে ঢুকতেই নার্গিস তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সে কী কান্না!
মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতেই তিনি ঘরের দিকে চোখ বুলান। ঘরে কাজী নজরুলকে না দেখে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, নজরুল! নজরুল কই! নজরুলকে যে দেখছি না!
নার্গিস কাঁদতে কাঁদতেই বলল, সে চলে গেছে মা!
কী বলিস তুই! বাইরে তো প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি! এরমধ্যে বের হলো কি করে?
এরমধ্যেই বের হয়েছে মা! আমি কিছুতেই আটকাতে পারিনি।
সর্বনাশ! হঠাৎ কেন কি হয়েছে? তোর সঙ্গে কোনো কিছু হয়েছে?
না মা। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি ঘটলো? কেন হঠাৎ যাওয়ার জন্য জেদ ধরলো?
বের হওয়ার সময় কি বলে বের হলো?
আমাকে বলল, তার বিশেষ জরুরি কাজ আছে। কলকাতায় তাকে ফিরে যেতে হবে। শ্রাবণ মাসের কোনো এক সময় সে আবার আসবে। ফিরে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।