ধারাবাহিক গল্প (পর্ব-৪) ॥ দ্বিতীয় শ্রাবণ ফোটালো প্রথম কদম ফুল


ধারাবাহিক গল্প পর্ব-৪

ড্রেন উপচে গড়ানো পানি বাঁচিয়ে তন্ময় আর বুবলি লাফিয়ে লাফিয়ে দীর্ঘ সরু গলি পার হতে হতে তন্ময় বললো, তুমি কোন সাহসে এই গলিতে ঢুকলে বলো তো?
: বারে, এখানে সারাক্ষণ শত শত মানুষ পার হচ্ছে না! অন্তত মরার আগে তো জেনে মরার অধিকার আছে, নিজের জানাশোনার বাইরেও কতরকম জীবনযাপনের ধারা আছে।

বড় রাস্তার পাশে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছে।একটা খালি সিএনজি দেখে তন্ময় তা ডেকে আনতেই ড্রাইভারের অনুমতি নিয়ে বুবলি উঠে পড়লো। স্টার্ট দেয়ার আগে বুবলি মুখ বাড়িয়ে তন্ময়কে বললো, লিমা আন্টিকে যে চুড়ি দুটো দিয়েছি, ও আমার মা’র চুড়ি। মা’র স্পর্শ পেতেই আমি মাঝে মাঝে পরি। আবার খুলে রাখি। ও দুটোতে চার ভারি সোনা। সোনার ওপরে রূপালি মিনে করা।যেন ছিনতাইকারীর নজরে না পড়ে। সোনা বললে উনি নেবেন না মনে করে আমি আর বলিনি!তোমাকে বললাম, কারণ হেলাফেলা করে রাখলে শেষে হারিয়ে যায়।
বুবলির কথা শেষ হতেই ড্রাইভার জোরে সিএনজি টান দিলো।তন্ময় তার চোখে উদ্রিত সীমাহীন বিস্ময়ের কণামাত্রও বুবলিকে দেখানোর সুযোগ পেলো না!

কখন কিভাবে বাসায় ফিরেছে, উড়ে কিবা সেই ড্রেনের পানি থেকে পা বাঁচাতে শরীর বেঁকেচুরে লাফ দিয়ে দিয়ে তন্ময়ের মনে পড়ে না! জীর্ণ, রঙচটা গেটটিতে টোকা পড়তেই গেট খুলে আকলিমা খানম হাসি মুখে ছেলেকে ধরে নিয়ে বললেন, মেয়েটির কথা কোনোদিনও বলিসনি তো! আজ কতদিন পর কেউ আমাকে কিছু দিলো। তোর জন্য আমার মনটা আজ ভালো হয়ে গেলো। জিনিস যত সামান্য হোক, কারো থেকে কিছু পাওয়া ও দেয়ার ভেতরে একটা অন্য রকম আনন্দ উৎপন্ন হয়। পাওয়ার থেকে অবশ্য দিতেই আমার ভালোলাগে।
: জানি তো। দিয়ে দিয়েই তো নিজের সব শেষ করেছো!
: হু, এবার বল্, মেয়েটির কথা আগে বলিসনি কেন?

তন্ময় আশ্চর্য হয়ে বললো, আমার জন্য কেন তোমার মনটা ভালো হবে?
: তোর খোঁজেই তো এ বাড়িতে এসেছিলো। জানিস, যার যা নেই, তা নিয়ে তার কোনো বোধও থাকে না।আমার মনে হতো, আল্লাহ আমাকে একটা মেয়ে না দিয়ে ভাল করেছে এই টানাপোড়েনের সংসারে…! আজ মনে হচ্ছে আল্লাহ আমার দুঃখ বাড়াবে বলেই ওকে এভাবে আমার সামনে এনে হাজির করেছে!
: আমার খোঁজে এসেছিলো, হাতে কাজ নেই, যতই জিন্স-পাঞ্জাবি পরে থাকুক, মেয়ে মানুষের মন তো। ভাবছিলো মরেটরে গেছি কি না! আর ও তোমাকে যা দিয়েছে, তা তোমার জন্যই দিয়েছে।আজকাল কেউ অপরিচিত মানুষ বাড়ি ঢুকতে দেয়? সেখানে তুমি ওর জন্য টাটকা রান্না করে খাইয়েছো।দুইবার মগ ভরে চা খাওয়ালে। যেন কতকালের চেনা।

মা, পারোও বটে তুমি! শুধু তোমার সন্তানেরাই তোমাকে চিনলো না! আজো তুমি আমাদের সবার হাতের থেকে কাজগুলো টেনে নিয়ে নিয়ে করো, যেন সব তোমারই দায়! অথচ আমরা তোমার কথা বলতে গেলেও ভাববাচ্যে বলি। গুণ তো গাই-ই না!
: আমি যা করি, সব মা-ই তাই করে! আর মা’রা নিজের প্রতি সন্তানের অবহেলা বুঝেও তো অবহেলা ফেরত দিতে পারে না!
: রাখো তোমার সব মা! মানুষের বাড়ি গিয়ে দেখেছি না, এককাপ চা যদি চাকর-বাকরের হাতে পাঠালো তা মুখে দেয়া যায় না। কত বন্ধুর বাড়ি কতদিন কতকাজে গেছি। কত কত অপেক্ষা করে সময় কাটিয়েছি, পর্দার ওপাশে বসে তারা খাওয়া-দাওয়া করেছে, অথচ কারো মা এসে একটিবার জিজ্ঞেস করেনি, খাব কি না!
: কি জানি বাপু, আমি ভাবতেই পারি না আমার বাড়ি এসে কেউ পেটে ক্ষুধা নিয়ে থাকবে!
: পরের ছেলে-মেয়েকেও যে নিজের ছেলে-মেয়ে মনে করো, তা তোমার ছেলেদের বউ দুটিও কি টের পেয়েছে! দুজনই তো তোমার অনুগ্রহ নিয়ে এ সংসারে ঢুকেছে। ঢোকার পর থেকেই তো তাদের সাধ আহ্লাদের দিকে তোমার নজর।

সোনাদানা যা ছিলো একটু একটু করে দুই বউকে দিয়েছো। কই আমার বউয়ের জন্য তো কিছু রাখোনি!
: কি এমন ছিলো, যা আমি দিয়েছি? তোর বউয়ের জন্য আল্লাহ দিবে!
: আল্লাহ আর দিয়েছে তোমাকে! এই যে তোমার ছেলে দুটি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, তাদের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করবে তাদের জন্য ভালো পরিবেশ দরকার। যেতেই হবে। চিরকার সব অনঢ় থাকার নয়। কিন্তু আমার কথা বাদ দাও, তোমাকে কি কেউ বলে, সাথে যেতে? কীভাবে একা থাকবে সে ভাবনা তোমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আমি বুঝতে পারি…।
: তুই আছিস না?
: আমি থেকে তোমার কী করতে পারছি। আমি বেকার। ভালো কোনো চাকরির বিদ্যা আমি অর্জন করতে পারিনি। এইটুকু বিদ্যা নিয়ে যে কাজ পাই, তা আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি বেকার জেনেও আমার দুটি ভাই কখনো কি আমাকে হাতে কিছু টাকা দিয়েছে? কিন্তু দিতে তারা বাধ্য। কারণ তাদেরকে লেখাপড়া করাতে তুমি তো বাবার টাকাই খরচ করেছো?
: একথা বল তাদের সামনে গিয়ে!
: মা আমি তো তোমার পেটে হয়েছি! আমি দেখছি, বাবা থাকতে তোমার একটা তেজ ছিলো। ঠিক ফণাতোলা সাপের মতো মনে হতো। কিন্তু সাপের মতো বিষ তোমার কোনোদিন ছিলো না! তাই তুমি কখন যে মাটি হয়ে গেছো, তুমি নিজেই টের পাওনি। নাহলে যে তুমি ডানার নিচে আমাদের আগলে রেখেছো, সেই তুমি তোমার থেকে জন্ম নেয়া সন্তানের কাছে স্বীকার করে ফেলো, একা বাড়িতে থাকতে তুমি এখন ভয় পাও!
: এটাও আল্লাহর ইচ্ছে। বুঝলি! এইটুকু ভয়-ভালবাসার আঠাকষা না থাকলে তো সংসারই থাকবে না! আর আমার বলার আমি বলি। অন্তত পরে নিজেকে বোঝাতে পারবো, আমি তো আমার অসহায়তা আমার সন্তানদের কাছে ব্যক্ত করেছিলাম!
: কিন্তু সবার অবহেলা পেয়েও তো তুমি থেমে থাকো না, কেউ নিজের কাপড়টা ধুতে গেলেও তাকে তুলে দিয়ে নিজে আছড়াতে থাকো!
: চুপ কর! বউয়েরা এসব শুনে মন খারাপ করবে।

ওদের কোনো কাজ করতে দেখলে মনে হয় সব শক্তিই তো কবরে নিয়ে যাবো। যেটুকু পারি ওদের জন্য খরচ করি।আমার বয়সে এসে ওরাও তাই করবে!
: তাতে তোমার লাভ হবে কি?
:লাভ এই যে মর্মজ্বালা না থাকলে বুঝতাম না হয়তো জীবনটা কত সুন্দর!
: এখনো মনে হয় তোমার কাছে যে জীবনটা সুন্দর?
:যাদের ছেলে-মেয়ে নেই তাদেরকে ভালোবাসবার মতোও কেউ নেই, অবহেলারও কেউ নেই। তাই বলে তারাও কি ভালো আছে?
: তাহলে ছেলে-মেয়েদেরও বোঝা উচিৎ মায়ের মতো কেউ নেই!
: সাথে বাবার কথাও বলো!
: মা, অনেক বাবাকে দেখেছি, স্ত্রী মারা যাওয়ার পনের দিন না পেরোতে আরেকজনকে ঘরে আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

খন তো আমি বড় হয়েছি, আমারও দেখার দৃষ্টি হয়েছে! আরে বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে দেখছি না, যাদের মা মারা গেছেন!
: হয়েছে! দুনিয়াতে সুখ-শান্তির ঘটনাও কম নেই!
: শোনো মা, তোমার কাছে টাকা আছে?
: না রে! কোত্থেকে আসবে?
: একটু সোনা-রূপা?
: সোনা-রূপার ওপর লোভ আমার কখনো ছিলো না। তবে যা ছিলো বউমা দুজন, তারপর নাতি-নাতনিদের দিয়েছি।
: তোমার নিজেকে অসহায় লাগে না এই যে তোমার হাত একেবারে খালি…।
:অসহায় লাগে তো! তবে বাড়িটা তো তোর বাবা আমার নিষেধ সত্তে্বও আমার নামে করায় কিছুটা রক্ষে। কিন্তু জমি বিক্রি করে তো খুচরো খরচ মেটানো যায় না!
: দেখো, ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম আমি!
: মানে কি? আজ এতকথা বলছিস কেন? অন্যদিন তুই-ই বা কয়টা কথা বলিস আমার সাথে?
: আজ তো ওই মেয়েটাই আমাকে পাগল করে গেলো!
: আগে বুঝি পাগল হোসনি? ও এমনি এ্যদ্দূর এসেছে?
: আরে মা পুরোটাই খামখেয়ালিপনা! মন থেকে এসব ধুয়ে মুছে ফেলো। নাহলে তুমি পাগল হবে আর ওই মেয়ে ভালই থাকবে! বড়লোকরা ভালই থাকে।
: আমি পাগল হলে হবো। যা তো!
: কিন্তু আরো একটা কথা শুনলে তো তুমি ভিরমি খাবে!
: তাহলে না শোনাই ভালো!
: আচ্ছা শুনো না!
: বল তো! আজ বহুদিন পরে আমারও নিজেকে নতুন মানুষ মনে হচ্ছে!
: তো যাও, ওই বুবলির চায়ের মতো আমার জন্যও ঘন দুধ দিয়ে কড়া চা নিয়ে এসো!