এসেছে সে ॥ দিলরুবা আহমেদ


মৌমিতা ভেবেছিল, ঘরে ঢুকেই দেখবে, সবাই একে একে দৌঁড়ে আসছে। ছুটে ছুটে আসছে।তাকে জড়িয়ে ধরছে।চিৎকার করে উঠছে খুশিতে। চাঁদের হাট বসবে যেন তাকে ঘিরে,এই ভেবেছিল কিন্তু কই! সবাই কই গেল?

সেই রাজশাহী থেকে আসা।আমপাকা গরমে সিদ্ধ হয়ে আসা, ট্রেনে, বাসে, এবং রিকশায়।তারপরে এসে পৌঁছানো গেছে বাপের বাড়ির দরজায়।
কিন্তু হয়েছেটা কি?
কালকে ঈদ, এখনও কেও আসেনি নাকি? না, এতো হতেই পারে না। হঠাৎ হরিষ-কে দেখা গেল। সেই ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে আছে। রীতিমত চিৎকার করে সে ডেকে উঠলো,
: আরে হরিষ না! কেমন আছিস রে?
হরিষ ছুটে এসে পা ছুলো। হরিষের বয়স কত এখন, ২৪/২৫ তো হবেই।
: খালুজী আসেননি খালাম্মা।
: নাহ্।
: ভালই হয়েছে।বাসার অবস্থা কেরোসিন।
: মানে!
: বুঝবেন, আসছেন যখন।
: না আসলে কি ভালো করতাম।
: তা জানি না, তবে খালুজিকে যে আনেননি ভাল হইছে।শরমে পরতেন। আমরা একই জাতের মানুষ তো তাই ওনার সম্মান আমার সম্মান।
মৌমিতা শঙ্কিত হয়ে ভাবে, সারছে, বলে কি ছোকরা, এখানেও হিন্দু মুসলিম ভাগাভাগি।
: কি হয়েছে রে বাসায়?
হরিষ বিচক্ষণ ভঙ্গিতে একটা হাসি দিল। বললো,
: এখানে খাড়ান, আমি কেসেটটা বাজিয়ে ভিডিও করি আগে। মুভি।
: মানে?

হরিষ ততক্ষণে সামনের সাইড টেবিলের উপর রাখা কেসেট চালিয়ে দিয়েছে।গান ভেসে আসছে, ‘এসো, এসো, আমার ঘরে এসো,’ হরিষ তার পাশে রাখা ভিডিও ক্যামেরা তুলে তার ভিডিও শুরু করলো।
: খালাম্মা, বাসায় এবার কদম ফেলেন।আপনার প্রথম কদম খুবই ইমপরটেন্ট।চুনী খালাম্মা কই দিয়েছেন পা থেকে আস্তে আস্তে ফোকাস বাড়াতে হইবো।
: চুনীবু এসেছেন! কানাডা থেকে?
: সবাই, কেও বাদ নাই।
: কাওকে দেখছি না কেন?
: সবাই দরজা দিয়ে বইস্যা আছে মনে হয়।কাঁদতাছে, না হয় ঝগড়া করতাছে।আমি আগে ছবি তুইল্যা নেই, তারপর ডাকাডাকি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন চুনী খালা।| 24 hours বড় সাহেবের ভিড়িও করতে হবে। আকবর মামু কাজটা শুরু করেছিলেন। তবে উনি ওনার ক্যামেরা তো আর কাওকে ধরতে দেন না, তাই অনেক সিকোয়েন্স বাদ পইরা যাচ্ছিলো।চুনী খালাম্মা তাই নিজের ক্যামেরা বার করে আমাকে দিয়া রেখেছেন।সারাক্ষণ এখন মুভি।

ভালো কথা, আর এই এসো এসো…
: আকবর মামার ভিড়িওতে যখনই কেও ঘরে ঢুকবে বেক গ্রাউন্ড মিউজিক থাকবে, ঐ গানটা। শুধু music, কোন কথা থাকবে না, চুনী খালাম্মার বিষয়টা পছন্দ হইছে, কিন্তু অডিটিং-এর সময় কোথায়। তাই ডাইরেক্ট একশন খালাম্মা। সোজা গান বাজায়ে রেকর্ডিং।
মৌমিতা ভয়াবহ রোদ গরমে পুড়ে যাওয়া সব ভুলে হা হা করে হাসতে থাকলো। হরিষের শুদ্ধ গ্রামীণ মিশ্র ভাষা তাকে আরো হাসাতে থাকে।
: আকবর কোথায়?
: আপনার সাথে আসে নাই। আপনাকেই তো আনতে গেল। শুনে মৌমিতার মনটা ভালো হয়ে গেল। বাস স্টেশনে নেমে যখন দেখলো, কেও নেই, হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল। তাকে নিতে কেও এলো না। এত বছর পরে এলো।১০ বছর।এতদিন এদের কাউকে দেখেনি। কতো দিন এদের না দেখার কষ্টে কেঁদেছে।কত রাত ভোর করেছে এদের কথা ভেবে।
সজল-কে এত করে বললো, আসলো না।বলে কি ঈদ কি করবো।

আসলে অভিমান।আসবে না।১০ বছর যে বাপ-মা তার খবর নেয়নি, সেই বাপ মায়ের জন্য এত দরদ থাকার কি দরকার সজল তাও বুঝে না। শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে তার নাকি চেনার কোন দরকার নেই। তাকেও আসতে দিতে চায়নি।তারপরেও সে জোর করে এসেছে।জানে সে বাবা খুব অসুস্থ প্যারালাইস্ট।শুয়ে আছে গেল বছর দুয়েক থেকে।কেউ তাকে একটা খবরও দেয়নি। এতদিন পরে মা’র ফোন পেয়েই জানলো, পুরো দেশের আরেকধারে শুয়ে শুয়ে আজ অপেক্ষা করছেন বাবা তার তাদের জন্য, সে যেন আসে।

চট্টগ্রাম থেকে যখন ফোনটা বেজে উঠেছিল রাজশাহীর মেডিকেল কলেজ চত্বরে মৌমিতা বুঝি আনন্দে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।
এতগুলো বছর পরে মা তাকে ফোন করেছে। ঈদ করতে যেতে বলেছে। সব ভাইবোন আসবে। ওরা ৮ জন একসাথে আবার মিলবে। মা বললেন, ‘তোমার বাবা আর ক’দিন বাঁচবেন জানি না, এসে দেখে যাও।’ একবারও বলেননি সজলকে আনতে। জিজ্ঞেসও করেননি। মুসলমান মেয়ে বিয়ে করেছে, কেন-ই বা মানবে। সে মা হলেও হয়তো মানতো না।ভালই হয়েছে, ওদের কোন সন্তান নেই। সজল আর সে ডাক্তারি করেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে, এই ভালো।
কিন্তু কী কপাল, ডাক্তার হয়েও একবার বাবার চিকিৎসার সুযোগও পেল না।
: আপনে এখানে দাঁড়ান, সবাইকে খবর দিচ্ছি।হরিষ ছুটে ভিতরে চলে গেল।

মৌমিতা বহু বছর পরে নিজের বাপের বাড়িতে এসে মেহমানের মতন দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো।প্রথমের এটা কাচারির মতন একটা ঘর। চারদিকে অনেক চেয়ার পাতা। তারপর বিশাল হল ঘর। বৈঠক খানা। তারপর খাওয়ার ঘর। সেখান থেকে সারিবদ্ধভাবে দুইধারে চারটা করে রুম। রুমগুলোর বাহিরের দিকে লাগোয়া বারান্দা। বারান্দা দিয়ে আবার সব রুমে যাওয়া যায়। পুরানো বাংলো বাড়ি। যেখানে চার নম্বর রুমটা শেষ হয়েছে তার পাশ দিয়ে লোহার বেশ চওড়া একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, ওরা ওটাকে বলতো গোল সিঁড়ি। সিঁড়িটা গোল করে নেমেছে। যেখানে নেমে সিঁড়িটা থেমেছে সেখানে সেটাই উঠোন। উঠোনটার একধারে রান্নাঘর।

মৌমিতার সবই মুখস্ত। চোখ বন্ধ করেও এ বাড়ির সব দিকে সে যেতে পারে। এখন দাড়িয়ে আছে, দরজায়। কেন এই শাস্ত্রী। ১০ বছরেও কি তার শাস্ত্রীর মেয়াদ ফুরায়নি। উপরের ছাদটাতে পুরা টালি বসানো। এতগুলো ভাইবোন বলে কয়েকবার ভাবা হয়েছিল উপরের দিকে কয়েকটা রুম করবে। কিন্তু ঐ টালি। টালির সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে তাই আর করা হলো না।আর ওরা তো সব কজন একসাথে বড়ই হয়নি। সবার ছোট হিরার জন্মই হয়েছে বড়’বু আর চুনী’বুর বিয়ের পরে। উপরের ছাদটার দিকে তাকিয়ে দেখলো, অনেক উচু। এত উচু ছাদ, এটা দারুণ একটা ব্যাপার বলে তার মনে হয়েছে সব সময়।অনেকটা মসজিদের ভেতর ছাদ যেরকম হয় সেরকম।অনেক উপরে।আহা কত উপরে এই ছাদ। মৌমিতা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে ছাদ দেখতে থাকে। যেন সে এক বালিকা। বহুকাল পর দেখছে বহু দিনের চেনা সবকিছু।

ছোট বেলায় আকবর প্রায়ই বলতো।
: মাথা তুলে ছাদ দেখতে গেলে টুপি পড়ে যায়।
একবার সে তার বন্ধুদের নিয়ে এলো টুপি পরিয়ে, পরীক্ষা করিয়ে দেখানোর জন্য।
আকবর তখন কত ছোট। ১০/১২ বছর বয়স হবে। এখন সেও বিয়ে করেছে, বৌ আছে। লালন আছে। লালনকে দেখার জন্য সে ছটফট করছে। আর থাকতে পারলো না। ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো। কারও স্বাগতম জানানোর জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। ‘আম্মা, আম্মা’, করে মৌমিতা চেঁচিয়ে উঠলো। আবারও। এবং আবারও।
বহুদিন পরে সে আম্মা করে ঢাকার সুযোগ পেয়েছে। বহুকাল পরে যেন তার মনে হচ্ছে তার ভিতরও একটা শিশু আছে, কাঁদছে সে মায়ের জন্য।
‘আম্মা, আম্মা।’ কিন্তু আম্মা কোথায়?
ভারী সুন্দর একটা মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।
কে মেয়েটি?
হিরা তো নয়ই, সে তা বুঝতে পারছে। তাহলে?
এই মেয়েটির বয়স ১৬ বা ১৭। কে? কী সুন্দর। দেখলে নয়নতারা নয়নতারা জাতীয় একটা ভাব খেলে চারদিকে। মেয়েটি নিজেই বললো।
: আমি শিরী।
পা ছুয়ে সালাম করলো।

পান্না বুর মেয়ে। মৌমিতা দুহাতে ওকে বুকের মাঝে টেনে নিল। কেন এত কান্না পাচ্ছে, বুঝতে পারছে না। পেছনে এবার আরেকটি রূপবতী মেয়ে এসে দাঁড়ালো। খান পরিবারের মেয়েরা এত রূপসী হয় কেন? জ্যাকী কি? তাই, দেখতে তো পুরো মায়ের কার্বন কপি হয়েছে সে। মেঝ ভাই বাবর যেদিন হিন্দু ধর্মের এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছিল সে কি যুদ্ধ! বাপরে, সেই বিয়ের মেয়ে কত বড় হয়ে এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
: আপনিই তো মৌমিতা ফুপী, না?
এই মেয়েটিও তাকে সালাম করছে।
একজনের খালা সে আরেকজনের ফুপী।
হঠাৎ সে ঢুকরে কেঁদে উঠলো।

হরিষ ততক্ষণে মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সারা। ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু বলছে না কেন সে এসেছে। আম্মা বুঝবে কি করে।
হরিষকে বলতেই বললো,
: খালাম্মা, নানুকে সারপ্রাইজ দেব।
: মানে?
: নানু দরজা খুলেই এত বছর পরে মেয়েকে দেখবে, অতীব আশ্চর্য্য হওয়ার ঐ মুহূর্তেরই ছবি তুলতে হবে।
শিরি বললো,
: বাপরে হরিষদা, তোমার তো বেশ Artistic mind।
: জ্বি আপা, সবই চুনী খালাম্মার দোয়া, প্রতিদিন উনি আমার একঘণ্টা করে ছবি তোলার উপর ক্লাস নেবেন বলেছেন।
জ্যাকী সাথে সাথে বলে বসলো,
: সর্বনাশ।
শিরী ঠাস করে নিজের কপালে হাত দিয়ে বাড়ি দিল।
মৌমিতা হরিষের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো।
: আম্মা, দরজা দিয়ে রেখেছেন কেন?
হরিষ বকের মতন গলা উচিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে বললো,
: ঝগড়া।
: ঝগড়া কেন।অন্য রুমগুলো বন্ধ কেন?
: একটাতে চুনীখালা, আরেকটাতে তুগী মামা, আরেকটাতে পান্না খালা- বলেই হরিষ হাতের ইশারায় বুঝালো দরজা বন্ধ।
: কেন।
হরিষ আবারও বকের মতন ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
: ঝগড়া। আমেরিকা থেকে আসা বড় ভাইজানের বৌয়ের সাথে কারও নো বনিমানা।
: দূর ছোড়া, এটা কোন উত্তর হলো।
হঠাৎ হিরা উদিত হলো। গোল সিড়ি বেয়ে উঠে আসছে সে।
: আরে হিরা না! ওমা তুই কতবড় হয়ে গেছিসরে।

হিরা ছুটে এসে মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। এবং কেঁদেই চললো। মৌমিতা তাকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু হিরা ধরেই রাখলো। এ কান্নায় শুধু তাকে এতকাল পরে দেখার কষ্ট না আরো কিছু কষ্ট আছে কে জানে। এ কেমন তার ঘরে ফেরা। বোনকে বুকে রেখেই সে নিজেই এবার চেচিয়ে ডাকলো,
: আম্মা দরজা খোলেন, আম্মা। আমি মৌমিতা।

মৌমিতা দরজায় ধাক্কা দিতেই বাবার রুমের দরজা খুলে গেল। তার কণ্ঠ শোনা মাত্রই আয়েশা বেগম দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন।
বহু বছর পরে বহুদিনের পুরাতন মৌমিতাকে দেখা মাত্রই আয়েশা বেগমও মৌ -রে আমার, ও আমার মৌমিতা বলে বিলাপ করে দুহাত বাড়িয়ে মৌমিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

একে একে সব ভাইবোন দরজা খুলে বের হয়ে আসছে। চারদিকে ঠাসঠুস দরজার শব্দ। পায়ের শব্দ। সব ভাই-বোন এক সাথে হওয়ার এ যে কি আনন্দ! সবাই ছুটে আসছে। তাকে চারদিক থেকে কারা কারা যেন জড়িয়েও ধরছে। চোখের পানিতে তার চোখ এত ঝাপসা যে সে দেখতেও পাচ্ছে না সবাইকে। শুধু অনুভব করছে আলীঙ্গন। তার বুকটা ভরে যাচ্ছে। এতটা শূন্য হয়ে ছিল? পাঁচ বোন এক সাথে অনেক বছর পর। আম্মা বললেন,
: আমি যে বলতাম, নদীতে নদীতে দেখা হয়, বোনে বোনে হয় না, দেখলি তো কতবড় সত্যি কথাটা।
জবাবে বোনগুলো আরো জোরে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

বড় ভাইজান আছেন একা দাঁড়িয়ে।আকবর হয়তো বাস স্টেশনে খুঁজছে তাকে।আকবরের বউ মোবাইলে জানাতে গেল বুবু বাসায় পৌঁছে গেছে। মৌমিতাকে হাত ধরে বুকে টেনে নিয়ে বাবার রুমে ঠুকালেন আয়েশা বেগম আর কেঁদে কেঁদে খান সাহেবকে বললেন।
: দেখ, তোমার পাঁচ মেয়ে আজ একসাথে আছে।ওরা সবাই তোমাকে দেখতে এসেছে। ওদের তুমি দোয়া কর।
খান সাহেবর খাটের পাশে ওরা দাঁড়ালো।পাঁচজন সারিবেধে। খান সাহেব বা হাতটা একটু নাড়ালেন, চোখ দিয়ে ফোট ফোট পানি পড়ছে। একটা কিছু বলছেন।বুঝা যাচ্ছে না।
আকবরের বউকে ডাকা হলো।সেই শুধু কিছু কথা বুঝতে পারে।
অনেকক্ষণ শোনার পর বুঝা গেল শব্দটা হচ্ছে ‘নূর জাহান’। খান সাহেব তার মৃত কন্যাটিকেও খুঁজছেন।