ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-২) ॥ দেবো খোঁপায় তারার ফুল


দ্বিতীয় পর্ব
নার্গিস নীড়হারা পাখির মতো কেবল ছটফট করছে। তার মাথা চরকির মতো ঘুরছে। কিছুতেই সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। বালিশে মাথা ঠেকালে মনে হয় পুরো দুনিয়াই ঘুরছে। তার কাছে সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। নজরুল যেদিন নার্গিসদের বাড়িতে এলো সেদিনের আগের রাতে সে স্বপ্নে দেখে, এক রাজপুতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। কত আনন্দই না হয়েছে সেই বিয়েতে। বিয়ের আনন্দ করতে করতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘুম ভাঙার পরও সুন্দর স্বপ্নের রেশ থেকে যায়। সকালে তার আনন্দ আর কে দেখে! মনের আনন্দ তার শরীরেও যেন খেলা করে। সে এদিকে যায়, ওদিক যায়। ছুটে বেড়ায় সারা বাড়ি। একা একা সে হাসে। অবাক বিস্ময়ে মেয়েকে দেখেন আসমাতুন্নেসা।

নার্গিসের সেই হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই খান বাড়িতে এসে হাজির হলেন নজরুল। ঠিক যেন সেই রাজপুত! নার্গিসের স্বপ্নের সেই রাজপুত! রাজপুতের মতোই চেহারা তার। রাতে যাকে স্বপ্নে দেখল সে-ই যখন সকালে তার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন কি অবস্থা হয়! নিশ্চিতভাবে মানুষটি জ্ঞান হারাবে! তা না হলে আর কী হতে পারে! পাথরের মতো স্থির হয়ে যাবে! বাড়ির আঙিনায় নজরুলকে দেখে সে রকম অবস্থাই হয়েছিল নার্গিসের। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন, কাকে দেখছে সে? এই মানুষটিকেই কি সে স্বপ্নে দেখেছিল! এই মানুষটির সঙ্গেই কি তার বিয়ে হয়েছিল! হায় খোদা! এ রকম হুবহু মানুষের মিল হয় কী করে!

নজরুলও একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন নার্গিসের দিকে। প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনের মনে ধরে যায়। মনে মনে ভালোবেসে ফেলে। প্রথম দেখাই হয়ে যায় তাদের শুভদৃষ্টি। নার্গিসের মামা আলী আকবর খান নজরুলের সঙ্গে ভাগ্নিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন। তাদেরকে পরিচয় করানোর যেন কোনো প্রয়োজন নেই। তারা আগে থেকেই যেন পরস্পরকে চেনে-জানে; সে রকম অবস্থা!

নজরুলকে নিয়ে নার্গিস ঘরে যায়। তার মা আসমাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় করায়। আসমাতুন্নেসা তড়িঘড়ি করে সরবত বানিয়ে দেন। নার্গিস সরবত খাইয়ে আপ্যায়ন করায় নজরুলকে। তারপর তাকে চা-নাশতা দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। চা নাশতা দিতে দিতেই সে নজরুলের সঙ্গে কথা বলে। নানা কথার উত্তর দেয়। তার মধ্যে একটুও গ্রাম্য নারীর লজ্জা কিংবা জড়তা নেই। নজরুলের সামনে ভীষণ সাবলিল সে। আকবর আলী খান অবাক বিস্ময়ে তার ভাগ্নিকে দেখেন। তার চিত্ত যেন সন্তুষ্টিতে ভরে যায়। তিনি মনে মনে বলেন, লাজুক মেয়েটি হঠাৎ এমন পাল্টে গেলো কী করে! এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি। ভাগ্নিকে নজরুলের হাতে তুলে দেবেন বলেই তাকে নিয়ে এসেছেন এই বাড়িতে। তার গোপন উদ্দেশ্য বোধহয় সফল হতে চলেছে। নজরুলকে তিনি সারাজীবনের জন্য কব্জা করতে চান। এজন্য তাকে বিশেষ কোনো কৌশলও করতে হবে না। নজরুলকে দেখে মনে হচ্ছে সে পটে গেছে! ভাগ্নিকে সে খুব পছন্দ করেছে। একাকী ভাগ্নিকে আরো কথা বলার সুযোগ দিয়ে তিনি ঘরের ভেতরে চলে যান।

মামার ইঙ্গিতটা ভাগ্নি ভালোই বুঝতে পারে নার্গিস। নজরুলের মন ভজাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। প্রচন্ড আবেগী মানুষ নজরুল। নার্গিসের বাঁধভাঙা আবেগের সঙ্গে নজরুলের আবেগ একাকার হয়ে যায়। বানের স্রোতের মতো দুজনের আবেগ ছুটে চলে এক মোহনায়।
মধ্যাহ্নভোজেই নজরুলের পছন্দের সব মাছ রাখা হয়। খেতে বসে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন নজরুল। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি বললেন, কি ব্যাপার! একদিনের মধ্যে আমার সব পছন্দের মাছ! কোথায় পেলেন?

আলী আকবর খান হাসতে হাসতে বললেন, আমাদের পুকুরের মাছ। নানাজাতের মাছ পাওয়া যায় পুকুরে।
নজরুল খুব তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার খেলেন। ঠিক যেন মায়ের হাতের রান্না। নজরুল মুখে শুধু বললেন, বাহ! খুব ভালো রান্না হয়েছে।
নজরুলের এই কথাতেই খুশিতে আটখানা আসমাতুন্নেসা। তিনি নার্গিসকে বললেন, বেশি করে তুলে দে মা।
নজরুল রীতিমতো পেটপূজা করলেন। নার্গিসের আপ্যায়নে তিনি ভীষণ খুশি। অনেকদিন তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হয়নি তার। মায়েরাই বুঝি সন্তানদের এভাবেই খাওয়ায়। নিজের মায়ের হাতে কবে খেয়েছিলেন তা মনেও করতে পারেন না নজরুল। মায়ের কথা মনে করে হঠাৎ তার চোখের পানি আসে। টানাটানির সংসারে কত কষ্টই না করেছেন তার মা! নজরুলের চোখ ভেজা দেখে নার্গিস বিচলিত হয়ে জানতে চায়, আপনার কি হয়েছে?
না। তেমন কিছু না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল।
আপনার মা কোথায় আছেন?
দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে নজরুল বললেন, আমার মা কোথায় যে আছেন!

নার্গিসও দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। তারপর কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। নজরুল অতিথি ঘরের দিকে যায়। তার পেছনে পেছনে নার্গিসও যায়। নজরুলের বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল, নিন, এবার বিশ্রাম নিন। বিকেলে আড্ডা হবে।
নজরুল বিছানায় বসে নার্গিসের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তুমি গান জানো?
নার্গিস এবার লাজুক ভঙ্গিতে না সূচক ঘাড় নাড়ালো। তারপর বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন?
নজরুল হ্যাঁ সূচক ঘাড় নেড়ে বললেন, কিছু কিছু।
তা হলে বিকেলে আপনার গান শুনব।

নজরুল ইতিবাচক মাথা নাড়লেন। আর কোনো কথা বললেন না। নার্গিস ঘরের ভেতরে যায়। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে নজরুলের কাছে।
(চলবে)