সাদা কার্বন (পর্ব-৬) ॥ ইসমত শিল্পী


সাদা কার্বন (পর্ব-৬)

তার সাথে আমার দেখা হঠাৎ যোগাযোগে, চোখাচোখিতে না। তবে যোগাযোগটা হলো দৃঢ়। এই দৃঢ়তম যোগাযোগের সমস্ত টুকুই আমার জন্য। সে হোক আমার দোষ অথবা হোক ম্লান শর্তাবলি। যোগাযোগ চলতে থাকলে তখন আর একজনের থাকে না, ব্যাপারটা দুজনের হয়ে যায়। আমাদেরও তেমনি হলো।

এইসব বলছি কারণ, দুজন মিলে একপথে চলতে থাকলে পথও আপনার হয়। দোকলা হয়ে ওঠে অপরিচিত আকাশ, ঘরবাড়ি, ছায়া। রাস্তায় পরিচিত খাবারের দোকানে বসে লুচি আর চা খেতে খেতে মরচে পড়া আগুনে অপরের মুখ জ্বলজ্বল করে। ফুটে ওঠে লক্ষকোটি তারা, মাঘের আকাশ ঝলমলে লাগে, শরতের মতো। ইস্কাটনের রাস্তা আমাদের পরিচিত ঘরদোর হয়ে উঠলো। মগবাজার, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, বেইলি রোডের ‘দেশাল’ আর ‘কে ক্র্যাফট’ আমাদের টিফিন ফাঁকির মতো জায়গা হলো। পাগলের মতো ভালোবাসা উপচে পড়া কথা আসতো গলগল ধারায়। আমি উড়তাম; সেও কি ওড়েনি একচুলও! একা একা কোনো কিছু বেশি দিন চলতে পারে না, আমাদের চলছিল।

এভাবে উড়তে উড়তে কাজের ফাঁকে দিনের সন্ধ্যাটি নিজের করে নিতে ছুটেই চলি। কে জানতো, এই ছোটাছুটি নিরর্থক হবে! অর্থ বিচার করে কি সম্পর্ক হয়! কেই বা ভাবে প্রকৃতির নিয়ম এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! প্রকৃতি বড় অসহায় হয়ে পড়ে মানুষের কাছে। হাল ভেঙে দেবার থেকে ছেড়ে দেওয়া খানিকটা ভালো। তোমাদের নিষ্ঠুরতা ছাড়া সেই বা পেয়েছে কী এমন! তাই সে হাল ছেড়ে বেঁচেছে।

আমি যখন ঈশ্বরের চাইতে প্রকৃতির শক্তি অধিক বলতাম। তোমার কুদৃষ্টি আমার চোখ এড়াতো না, অপছন্দের মৃদু ভৎর্সনাও বড্ড বুকে বাজতো। কিন্তু মনে লাগতে দিইনি কখনো। সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলার দক্ষতা আমার অনেক দিনের। তোমার কপট চোখ ভীরু ধার্মিকদের মতো জ্বলতো। ভেতরে যিনি অবিচার পোষেন ধর্ম তার উপযুক্ত পোশাক। এই বাক্য আমার, তোমার সাথে হুবহু মিলে যায়। মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের গলা কেটে হত্যা করে যারা, তাদের কাছে আবার ধর্ম কীসের! ধর্ম তাদের লেবাস মাত্র। আর এই লেবাসধারী লোকটি যদি নিজের কেউ হয় তাহলে নিরবতা পালন করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

ওসব হিসেব বাদ দিয়েই স্বাভাবিক ভাবে আমার অবস্থানে অটল থেকেছি। আমার মতোই চলেছি আমি, তোমাকে বাদ দিয়ে জীবনের কিছুই ভাবিনি। এটাই কি দুর্বলতা ভেবে নিলে শেষে? শেষই বা বলছি কেনো? শুরুর থেকেই তো শেষ আসে? শেষ তো শুরুতে যেতে পারে না! তোমাকে শুধরে নেবো ভেবেই এভাবে লেগে থাকা, তোমাকে পাবার জন্য নয়। আমি তো আমাকে সবটুকু জানি, আর কেউ জানুক বা না জানুক।

এখন তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতোই। শুধরে নেবো, সে যোগ্যতাও তো একটা মানুষের থাকতে হয়! তোমার সেটুকুও নেই। নিজেকে জানে না যে, সে অন্যকে কীভাবে জানবে? আমি আমার জানার মধ্যে দিন যাপন করি, তুমি তোমার ভুল স্বর্গে থাকো। ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না..’।