দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন হলো বুবু আমার সঙ্গে কথা বলে না। যেদিন বুবু আমার সঙ্গে কথা বলা ছেড়েছে সেদিন থেকে বছর-মাস-দিন গুনে রাখতে শুরু করিনি। আজই হিসাব করলাম। ডায়েরিতে লিখে রাখা ছিল তারিখটা। ডায়েরিতে আরও অনেক কিছুই লেখা আছে, অনেক দিন ক্ষণও টুকে রাখা। গানের স্যার যেদিন প্রথম আমার স্তনে হাত দিয়েছিলেন সেদিনের কথাও লেখা আছে। স্যারের নামটা লেখা নেই। স্যার আমার সঙ্গে কী করেছিল তা আমি কাউকে বলতে পারিনি। বাবা-মাকেও না। বুবুকেও না। বুবু তবু ঠিক জেনেছিল। যেদিন বুবু স্যারকে চড়থাপ্পড় মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল সেদিন আমি টের পেয়েছিলাম, বুবু গোপনে আমার ডায়েরি পড়েছে। ভীষণ রাগ হয়েছিল বুবুর ওপর। তেতো মুখে বুবুর সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম। কথা বলিনি পুরো একটা বেলা।
বুবু আমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারত না। তাই আমার গলা জড়িয়ে ধরে নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল। বলেছিল, স্যার আবার এ বাড়িতে এলে পাড়ার লোক জড়ো করে তাকে পিটাবে।
কী যেন নাম ছিল স্যারের! মনে করার চেষ্টা করলেই আমার মাথার দুপাশে ব্যথা শুরু হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ডায়েরিটা ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা দিতে দিতে আমার মনে পড়ে বুবুর কাছে চাবি আছে। বুবু যে আমার ডায়েরি পড়া ছাড়তে পারেনি তা আমি এই বাড়িতে এসেও টের পেয়েছিলাম। ততদিনে অবশ্য আমার ডায়েরি লেখার ঝোঁকও হারিয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝে গিয়েছিলাম নিজের কিছু কিছু গোপন কথা ডায়েরিকেও বলতে নেই।
বুবুর সঙ্গে যখন আমি শহরে আসি তখন ডায়েরিসহ নিজের সব জিনিস নিয়ে এসেছিলাম। আমার জিনিসপত্র রাখতে এই মিনি ওয়ারড্রবটা মনসুর ভাই আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল। ভার্সিটির হলে ওঠার পর এই বাড়ি থেকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে গেলেও ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ারের জিনিসগুলো নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে মনসুর ভাই আমাকে কখনো কিছু বলেনি, আর বুবু তো বলেই না। এরপর নিজের সংসার গোছানো হলে আমারও মনে হয়নি জিনিসগুলো নিই। কী-ই বা এমন আছে, ঐ ডায়েরিটা ছাড়া।
শেষবার ডায়েরিতে লিখেছিলাম এই বাড়িতে বসেই। দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন আগে। আচ্ছা, ডায়েরিতে কি গানের স্যারের নাম লেখা আছে? কী যেন নাম ছিল স্যারের? খালেদ? না মালেক? বুবুকে জিজ্ঞেস করবো? নাহ, মনে থাকলেও বুবু বলবে না।
দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন হলো বুবু আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমি গলা জড়িয়ে দাঁড়ালেও বুবু আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। আর এমন একটা সময় ছিল যখন আমার গায়ে এক হাত ফেলে না রাখলে বুবুর চোখে ঘুমই আসতো না।
টানটান হচ্ছে রগ, কপালের দুপাশে চাপ লাগছে। মাথা ব্যথা বাড়ছে। ওষুধ ছাড়া এ যন্ত্রণা কমবে না। আমি ওষুধ খুঁজতে শুরু করি। এ ঘরে ও ঘরে কোথাও ওষুধের বাকশোটা নেই। নিশ্চয়ই মনসুর ভাই সরিয়ে রেখেছে। বুবুর তো উল্টোপাল্টা ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস আছে। সেই ভয়েই সরিয়েছে।
গুনগুন করছে কেউ। গান গাইছে? কান খাড়া করতেই টের পাই বুবু কাঁদছে। থালাবাসনের ঠোকাঠুকির বিক্ষিপ্ত আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। মনসুর ভাইয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছি, ‘কানন, এদিকে আয়।’ জারীন ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে উঠছে, ওর ঘুম পাতলা, কোলাহলের ভেতরে ঘুমাতে পারে না আমার মেয়েটা। জারীনকে কোলে তুলতেই ও গালভরে হাসে। আবার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে মেয়ের। ওকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে আমি ও ঘরে যাই।
মনসুর ভাই টেবিলে থালা-বাটি সাজাতে সাজাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এর চেয়ে কুত্তার জীবনও অনেক ভালো।’ ডাস্টবিনে মুখ গোঁজা কুকুরের মতো নিজেকে আড়াল করে পিছনে ঘুরে যাই আমি। বুকের মধ্যে জারীন কুঁইকুঁই করে। ঘুম ভেঙেছে মেয়ের। এখন খাবার চাই।
‘তুইই বল, মানুষের জীবন এইটা?’
মনসুর ভাইয়ের কফ জড়ানো কণ্ঠস্বর কানে ধাক্কা দেয়। বাটিতে রাখা সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়ানো হয়েছে, এখনো ভর্তা করা হয়নি। কাচের গ্লাসের উল্টোদিক দিয়ে আলুগুলোকে পিষছিল ভাই। এখন হাত থেমে গেছে। ভাই কাঁদছে। বুবুও কাঁদছে, গুনগুন, খুনখুন।
আমি বুবুর চারদেয়ালের অভ্যন্তর খুঁটে খুঁটে দেখছি। ধুলায় ঢাকা আসবাব, জীর্ণ বিছানা-বালিশ, ময়লা উপচানো সিংক, স্টোররুমের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ছোট বড় তেলাপোকা।
বুবু ময়লা-আবর্জনা দেখতে পারতো না দুচোখে। সবসময় তার পরিপাটি থাকা চাই। ঘরে ফিরলেই তার গোসল করা চাই। মনসুর ভাইকেও বাধ্য করতো। ভাই বলতো, ‘তোর বুবু শুচিবাইগ্রস্ত।’ এখন বলে, ‘পুরাই গেছে মাথাটা। একেবারে পাগল হয়ে গেছে। মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করতে হবে এবার।’
‘সবাই বলে পোস্ট কোভিড সিম্পটম বেশি খারাপ। মানসিক অস্থিরতা বাড়ে।’
আমি এমনভাবে কথাটা বলি যেন জানি না, বুবু দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন ধরেই অস্থির।
‘এখন তো আরেক সমস্যা শুরু হয়েছে, বাড়ির সামনে দিয়ে ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্স যায়, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে আরও আউলাঝাউলা হয়ে যায়।
মনসুর ভাই আউলাঝাউলা শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে ডালের বাটিটা একটু সরিয়ে দিতে চায়। বেকায়দা ঠেলা লেগে অনেকটা ডাল বাটি উপচে টেবিলে ছড়িয়ে পড়ে। মনসুর ভাইয়ের মধ্যে টেবিলে ছড়ানো মোছার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। আমার দিকে প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে ভাই বলে, ‘তুই খেয়ে নে। একটু পরেই তো বলবি যাই।’
‘ক্ষিধে নেই’ কথাটা বলতে পারি না আমি, শূন্য দৃষ্টিতে বুবুর সংসারের আউলাঝাউলা টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঘরময় চরকির মতো ঘুরতো বুবু আর জিনিসপত্র গোছাতো। আমি কিছু বললেই বলতো, ‘তোর সংসারও তুই এমন গুছিয়ে রাখবি।’ আমি কিছুই গুছিয়ে রাখতে পারি না। বুবুর কথা ভাবতে ভাবতে আমার গোছানো জিনিসও এলোমেলো করে ফেলি।
‘জানিস কানন সেদিন কনক কী করেছে?’
‘কী করেছে?’ সেই প্রশ্নটা করার আর সাহস পাই না। একবার জবাবে শুনেছিলাম, মনসুর ভাইয়ের ছোটবোন কেয়ার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মেরেছিল। পিঠে ছুরি গেঁথে গিয়েছিল কেয়ার।
‘সেদিন কী করেছে জানিস? শেফালি সঙ্গে করে ওর ছোট বাচ্চাটাকে এনেছিল। তিন বছরের একটা ছেলে, ওর মা ঘর মুছছে আর ছেলেটা টুকটুক করে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ তোর বুবু ছেলেটাকে মারতে শুরু করলো। থাপ্পড় দিতে দিতে বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলছিল প্রায়, শেফালি হাতে কামড় দিয়ে ছাড়িয়েছে। সেদিন থেকে কাজে আসে না মেয়েটা। তুই বল কেন আসবে?’
আমি কিছু বলি না। এই লকডাউনে আমি কেন জারীনকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছি আমি নিজেই জানি না। মাথার ভেতরে কেমন করছে আমার। কণ্ঠনালীতে আতংক চেপে বসছে। মনসুর ভাই আমার দুর্গতি খেয়াল করে না। অবসন্ন স্বরে বলে, ‘দাঁড়া, একটু সালাদ কেটে দিই।’
মনসুর ভাইয়ের হাতের সালাদকাটা ছুরির ধারালো অংশে আলো পিছল কাটছে। আমি অবিশ্বস্ত চোখে দেখি ভাইয়ের টলমল হাত ছুরি আঁকড়ে ধরতেই কেমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে উদ্ধত ছুরিটা শুধু আমাকে কাটবে, কচ কচ কচ। রক্ত, মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে ঘরে, আমি চিৎকার করার সুযোগ পাবো না।
ছুরির দিকে তাকিয়ে থাকি। মনসুর ভাইয়ের কোনো কথা শুনতে পাই না। আমার ঘুঁটেকুড়ানি বুবু কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখতে পাই না। শসা, টমেটো, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজকুচি চপার থেকে বাটিতে তোলার দৃশ্যটা সচল হতেই চোখের সামনে থেকে ছুরির ফলাটা সরে যায়। হাঁপ ছেড়ে উঠতেই দেখি বুবু একদম আমার মুখোমুখি।
সত্যি সত্যিই ঘুঁটেকুড়ানির মতো দেখাচ্ছে বুবুকে। অনাহারি মানুষের মতো তার গাল-চিবুক বসে গেছে, গলার হাড় বুকের দিকে ইউ টার্ন নিয়েছে, পেট-পিঠ লেগে আছে পরস্পরের সঙ্গে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়, বুবু বেঁচে নেই। আমি আবার চিৎকার করে উঠতে চাই। আচমকা দেখি বেঁচে থাকার নিশানা হিসেবে বুবু তার গর্তে বসা চোখের ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টি আমার দিকে তাক করে আছে।
বুবু ক্ষেপে ওঠার আগেই কি জারীনকে বুকে চেপে পালাবো?
পালানোর আগেই বুবু আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর চুলের সিঁথি চুইয়ে তেল গড়াচ্ছে। তেল চুপচুপে মুখে অদ্ভুতভাবে হাসছে বুবু, মনে হচ্ছে এক্ষুনি আমার সঙ্গে কথা বলবে।
দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন আগে বুবুর দুই মাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওড়নাতে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। টুনি বহু দূরে ছিটকে পড়েছিল, ওর মাথার খুলিটা ফটাস শব্দে মেঝে ছুঁয়েছিল।এত রক্ত ছিল ঐটুকু শরীরে!
অত বছর আগের সেই দৃশ্যটা আজ হঠাৎ আমার পিঠ দেয়ালে চেপে ধরে, মাথাটা সশব্দে বাড়ি খায় দেয়ালে। যেভাবে টুনির ছোট্ট খুলিটা মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল সেভাবে কেউ যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমার খুলিটা।
হাসির শব্দ পাই। বুবু হাসছে। জারীন হাসছে। আচমকা দশ বছর নয় মাস চৌদ্দ দিনের নীরবতা ভেঙে বুবু উচ্ছ্বাসভরা স্বরে বলে, ‘তোর বাচ্চা? দে আমার কোলে দে..’
মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টা ঘটে যায়। আতঙ্কে নীল হতে হতে আমি দেখি বুবু জারীনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।