১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে ৯০এর দশকের শুরুর দিকে এসে বিশ্ব ইন্টারনেট নামক বৈশ্বিক ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়। সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। সঙ্গত কারণেই এর প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাপন এবং মনস্তত্ত্বেও।
ইন্টারনেট আবিষ্কার এর সাথে সাথেই আবিস্কৃত হয় ইমেইল, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, ইয়াহু মেসেঞ্জার ইত্যাদি প্রযুক্তি। নব্বইয়ের দশক থেকেই কমতে থাকে বিশ্বে কাগুজে যোগাযোগ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ চলমান প্রক্রিয়া। সেই জার্নির হাত ধরেই ৭০ এর দশকের শুরুর দিকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল উৎপাদিত হয়।
১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল মটোরোলা সবার আগে বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। সেটি ছিল দুনিয়ার ওয়ান জি মোবাইল ফোন বা জিরো জেনারেশন মোবাইল ফোন।
এরপর ১৯৮২ সালে ইউরোপের ১১টি দেশের প্রকৌশলী এবং প্রশাসকরা সুইজারল্যান্ডের স্টকহোমে একত্রিত হন। তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার ব্যাপারে সম্মত হন।এভাবেই মোবাইল ফোনের উত্থান ঘটতে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ধীরে ধীরে মোবাইল ফোনে বিস্তার ঘটে এশিয়াতেও। ১৯৯৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে পৃথিবীর অনেক দেশেই মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়। সে বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রথম চালু হয়। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরে এএমপিএস মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে।বর্তমানে সারা বিশ্বে ফোর জি ও থ্রি জির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। চালু হয়েছে ফাইভ জি।
হ্যালো শব্দটি আবিস্কারের সাথে সাথে ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে থাকে অপেক্ষা, চোখের জল, হারিয়ে যেতে থাকে পত্র আদান-প্রদান সংস্কৃতি, সংকুচিত হতে থাকে আবেগের প্রকাশ।এরপর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আসে স্মার্টফোন প্রযুক্তি। ১৯৯৪ সালে আইবিএম(IBM) কোম্পানি এবং মিতসুবিসি ইলেকট্রিক কর্পোরেশন একসাথে মিলে যৌথ উদ্যোগে তৈরি করেছিল বিশ্বের প্রথম স্মার্ট ফোন এবং যার নাম ছিল আইবিএম সিমন এবং এই স্মার্টফোন বাজারে আসার প্রায় ১৫ বছর পরে অ্যাপল আইফোন বাজারে আসে।একুশ শতকের শুরুর দিকে স্মার্ট ফোনের ব্যাপক ব্যবহার বিস্তৃত হয় বাংলাদেশে।
স্মার্ট ফোনের বৈশিষ্ট্য এবং বহুবিধ ফিচার এর কারণে স্মার্ট ফোন মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে। মুভি দেখা, গান শোনা, ই-মেইল করা, পড়া সবকিছু এক ফোনের মাধ্যমে করা সহজতর হয়ে ওঠে। মানুষের বিনোদনের জন্য আড্ডা সংকুচিত হতে থাকে।
সশরীরে যোগাযোগ এর স্থলে ভার্চুয়াল যোগাযোগ প্রাধান্য পেতে থাকে। ছবি তোলা, ভিডিও গেম খেলা,, চ্যাটিং বা মেসেঞ্জিং সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসে মানুষের। মানুষের ভেতর আত্মকেন্দ্রিকতা জেঁকে বসতে থাকে।
২০০৪ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক নামের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভাবন করেন। শুরুতে এই মাধ্যমটি শুধু হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০০৫ সালে আবিস্কৃত হয় ইউটিউব। আজকের বিশ্ব স্মার্টফোন, ইউটিউব, আর ফেসবুকের রাহু গ্রাসে বিপর্যস্ত।
এর আগে বিনোদনের জন্য মানুষের প্রয়োজন ছিল ভালো বই পড়া, ভ্রমণ করা, বন্ধুদের সাথে প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে ওঠা, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। এসবকিছুই মানুষ করতে পারে ; স্মার্টফোন, ইউটিউব
এবং ফেসবুকের মাধ্যমে।
বিশ শতকের শুরুতে এসে যে পণ্য সংস্কৃতি বা পুঁজিবাদ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, ভোগবাদ এবং বিশ্বায়নের উদ্ভব ঘটে; একুশ শতকে এসে তা সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে। পুঁজিবাদ মানুষকে সবকিছুর মূল্যায়ন করতে শেখায় অর্থনৈতিক মূল্যে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ পরিণত হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিকতায় যা কেবল নিজেকেই আরও বেশি করে চেনায়, ভোগবাদ বা অতি বস্তুবাদীতা মানুষকে কেবলই ভোগে উৎসাহিত করে, আর বিশ্বায়নের নামে শুরু হয় নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা আর ঐতিহ্যের বর্জন। মানুষ ক্রমে সরে যেতে থাকে নিজস্ব শেকড় থেকে। সামাজিক কাঠামো ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে। লোপ পেতে থাকে আত্মীয়তার চর্চা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ। সুখ যেমন একা ভোগ করো, দুঃখ ও একা ভোগ কর। ঘরে স্মার্ট টিভি, ডাবল ডোর ফ্রিজ, এয়ার কুলার মেশিন, স্মার্ট ফোন সব আছে কিন্তু মনে সর্বগ্রাসী একাকীত্বের হাহাকার। অনিবার্য প্রয়োজন হয়ে ওঠে মনের ভাব প্রকাশের। প্রত্যেকটি মানুষ হয়ে ওঠে একেকটি বিচ্ছিন্ন, মনোহর দ্বীপ।
এই জনপদে নানা কারণে শিক্ষা, সংস্কৃতি,সাহিত্য এবং গবেষণার বিকাশ বিস্তৃত হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মের গভীরভাবে পাঠের অভাব পরিলক্ষিত হয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে কোনো সরকারই তেমনভাবে গবেষণায় এগিয়ে আসেনি। ফলে অগভীর চিন্তা-ভাবনার একটা প্রজন্ম শেকড় ছাড়া হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে যারা লালন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, মানিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক কাউকে চেনে না। তাদের মনন পড়ে থাকে পতিত জমির মতোই। ফলশ্রুতিতে তারা না বোঝে মেধা ও মননের চাষাবাদ, না বোঝে সময়ের ব্যবহার।
এরই মধ্যে বাংলা সাহিত্যে উদ্ভব হয় বিনোদনমূলক সাহিত্যের।তাতে না ঘটলো মননের শ্রীবৃদ্ধি, না হল জ্ঞানার্জন। কিন্তু সময় কাটলো বেশ। আগেই বলেছি বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা মানুষকে একেকটি মনোহর দ্বীপে পরিণত করেছে। মানুষের ভাবের আদান-প্রদান অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ফেসবুকের নিউজফিডে লেখা থাকে ইটস অন ইউ’র মাইন্ড। মানুষ ফেসবুকের নিউজফিডে লিখতে থাকলো; সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-হতাশার উপাখ্যান। আর তার একেকটা শিরোনাম দিয়ে দিল। এর নাম হয়ে গেল কবিতা।এভাবে একঝাঁক লেখকের আবির্ভাব ঘটে একুশ শতকের শুরুর দিকে।একুশ শতকের জিরো দশকের প্রারম্ভে সৃষ্টি হতে থাকে ফেসবুক সাহিত্য গ্রুপ। যেখানে অধিকাংশ লেখক এবং পাঠকের কোনো দায় থাকে না। পুরোপুরি না পড়েই পাঠক মন্তব্য করতে থাকে অপূর্ব, অনবদ্য, অসাধারণ। অনেক নারী যেমন এসব গ্রুপে যুক্ত হন, তেমনি কর্মজীবী নারীরাও যুক্ত হন। যুক্ত হলেন, বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ সবাই। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যেকোনো কাজেই আদর্শগত বা প্রাণের তাগিদের চেয়ে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বেশি প্রাধান্য পায়।
এই গ্রুপভিত্তিক সাহিত্য চর্চাকে কেন্দ্র করে হিড়িক পড়ে গেলো যৌথ কাব্যগ্রন্থ, যৌথ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের। দুয়েকটা গ্রুপ থেকে হলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।এতো গেল গ্রুপ কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা। মূল ধারায় পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, ওয়েবম্যাগ এসব ক্ষেত্রেও দেখা যায়, একদল সুবিধা দিয়ে কিছু নিতে চান, অন্যদল কিছু দিয়ে হলেও সুবিধা নিতে চান।কিন্তু প্রশ্ন উঠে, সৃষ্টিকে ততখানি পরিণত হতে হবে তো। রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা কিংবা সেলিনা হোসেন এর হাঙর নদী গ্রেনেড কিংবা শহীদুল্লাহ্ কায়সার এর সংসপ্তক কিংবা বিভূতি ভূষণ এর অপরাজিত এরচেয়ে কোনো অংশে কম শৈল্পিক সৃষ্টি?
যেসব নারী-পুরুষ লেখকের সৃষ্টি কালোত্তীর্ণতা পেয়েছে তারা প্রত্যেকেই একনিবিষ্ট সাধক ছিলেন। প্রতিনিয়ত অধ্যয়ন করেছেন সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি সর্বোপরি মানুষের জীবন এবং প্রকৃতি। রিজিয়া রহমান এর সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম তার লেখা পত্রিকায় যায় বলে ওনার বোন শ্বশুরবাড়ি থেকে কথা শুনতেন। কারণ ওনার হাতের লেখা অন্যপুরুষ দেখতে পায়। আর সেলিনা হোসেন বলেছেন লেখক হওয়ার সাধনায় তিনি অনেককিছুই ছেড়েছেন। আজকে আমরা সহজেই ফেসবুকের নিউজফিড কিংবা সাহিত্য গ্রুপে লিখছি আবার লাইভ করে পরিচিত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যা করছি তা কতখানি অর্থবহ কিংবা আদৌ কি কিছু শিখছি? পূর্বসূরীদের চেয়ে আমরা প্রচার এবং চর্চায় অনেক এগিয়েছি। তাই সৃষ্টি কর্মেও এগিয়ে থাকতে হবে। এজন্য নিরবধি সাধনা প্রয়োজন।লেখক বা শিল্পী হতে গেলে অধ্যয়ন এবং সাধনা অত্যাবশকীয়।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম কবি ছিলেন নারী যার নাম এনহেদুয়ান্না। নারীর হাতেই সূচিত হয়েছিল কৃষি বিপ্লব। সাহিত্যেও নারীর হাতে রচিত হতে পারে বিপ্লব। নারীর দেখার দৃষ্টিভঙ্গী অনেক গভীর। হয়তো বা পুরুষের মতো ভ্রমণ করা সম্ভব হয় না। সেই ঘাটতি নারী অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারেন বই পড়ে। সাধনায় নিবিষ্ট হলে হয়তো আপনার, আমার ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসবে অরুন্ধতী, লুইস গ্লিক, এলিস মুনরো!