তৃতীয় পর্ব
ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তদের একান্নবর্তী পরিবার। ভাইবোনরা সবাই বড় হয়ে গেছে। সবাই বিয়ে-থা করেছে। তারপরও পরিবার আলাদা হয়নি। পরিবারটি কুমিল্লা শহরে অভিজাত পরিবার হিসেবে খ্যাত। এরকম শান্তিপূর্ণ একটি পরিবার শহরে দ্বিতীয়টি নেই। ইন্দ্রকুমারের ছোট ভাই বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরার রাজার নায়েব থাকাকালে কুমিল্লার মানুষের বেশ উপকারও করেছেন। সেই কথা মানুষ মনে রেখেছে। সেই জন্য পরিবারটিকে সবাই সমীহ করে।
বসন্তকুমারের আকস্মিক মৃত্যু হলে পরিবারের পুরো দায়িত্ব চাপে ইন্দ্রকুমার সেনের কাঁধে। তিনিই পরিবারের যাবতীয় বিষয়-আশয় দেখভাল করেন। তবে ঘর সামাল দেন তার স্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবী। তার হাতেই সংসারের চাবি। বিরজা দেবী ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। কোনো ঝুটঝামেলাতেই তিনি বিরক্ত হন না। মান-অভিমান করেন না। কেউ ইচ্ছা করেও তাকে রাগাতে পারে না। মাঝেমধ্যে ইন্দ্রকুমারও তার ধৈর্য দেখে বিস্মিত হন। মনে মনে বলেন, এটা কী করে সম্ভব! এতো কিছু কী করে সামাল দেয় সে!
বসন্ত কুমারের মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় স্ত্রী গিরিবালা ও একমাত্র কন্যা আশালতা ওরফে দুলি হতাশায় ভেঙে পড়ে। সেই মুহূর্তে তাদেরকে কাছে টেনে নেন বিরজা দেবী। তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করে বললেন, শোন গিরিবালা, তুমি আমার ছোটবোনের মতো। এই বাড়িতে আমি যখন আসি; তখন আমার কতই বা বয়স! তের কী চৌদ্দ। আমি ছিলাম ভীষণ লজ্জাবতী। সে সময় আমার শাশুড়ি আমাকে খুব সহায়তা করেছিলেন! তিনি না থাকলে আমার যে কী হতো! তিনি সব সময় বলতেন, একান্নবর্তী পরিবারে থাকতে হলে সবাইকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। তুমি এই সংসারের বড় বউ। তোমাকে সবচেয়ে বেশি ছাড় দিতে হবে। তোমার কাছ থেকেই অন্যরা শিখবে। সেই কথা আমার সব সময় কানে বাজে।
সেন বাড়িতে তুমি বউ হয়ে আসার পর থেকেই তো তোমাকে দেখে আসছি! তোমার কোনো ত্রুটি আমি পাইনি। বরং একসঙ্গে থাকার জন্য যতটা সম্ভব সহায়তাই করেছ। তুমি আমার বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আমি সব সময় ছোটবোনোর মতোই জেনে এসেছি। আমি যতদিন আছি তোমাদের কোনো রকম অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমার ছেলে বীরেন্দ্রও তো তোমাকে পছন্দ করে। আমার মেয়ে কমলা ও অঞ্চলি তোমার মেয়ের বয়সের কাছাকাছি। ওদের সঙ্গেই দুলি বড় হবে। ওরাও দুলিকে আপন বোনের মতোই জানবে। আর এ কথার যদি অন্যথা হয় তা হলে তুমি ছোট হয়ে যে শাস্তি দেবে আমি তা মাথা পেতে নেবো। আমি আশা করি, এর পর আর তোমার কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না।
বিরজা দেবীর কথায় আশ্বস্ত হলেন গিরিবালা দেবী। তিনি মনে মনে ভাবেন, বিরজা দেবীর বড় মন। তিনি মুখ দিয়ে একবার যা বলবে তা কখনো উল্টাবে না। মুখে এক আর অন্তরে আরেক, সেই মানুষও তিনি নন। তার মতো বড় মনের অধিকারী আমিও হতে পারিনি। তিনি যে বড় সেই বড়ত্ব তিনি বজায় রেখেছে। সবাইকে আগলে রাখা তার পক্ষেই সম্ভব। তিনি না পারলে আর কারো পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া সংসার পরিচালনার জন্য যে ধৈর্য দরকার তা বিরজা দেবীর আছে। আমার কিন্তু ধৈর্য খুব কম! অল্পতেই আমার মেজাজ চড়ে যায়। ঠাণ্ডা মাথা হলে বড় সংসার সামলানো যায় না। প্রতিবেলার রান্নার যে ঝক্কি তা সামলানোই তো কঠিন ব্যাপার!
গিরিবালা দেবী নিজের মেয়েকে সান্ত্বনা দেন। কোনো রকম দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, দিদি তোকেও তার মেয়ের মত ভালোবাসে। তুই কোনো দুশ্চিন্তা করিস না মা। তিনি একথার মানুষ। নিশ্চয়ই তিনি তোর সবকিছু দেখবেন। যদি কখনো কোনো অসুবিধা হয়, তখন বলা যাবে! আমাদের দায়িত্ব তো বিরজা দেবী নিজেই নিয়েছেন! তাই না?
আশালতা মায়ের কথায় সায় দিলেও তার মনে শঙ্কা থেকেই যায়। সে সময় নেয়। বিরজা দেবীকে বোঝার চেষ্টা করে। কিছুদিনের মধ্যেই আশালতা বুঝতে পারে, বিরজা দেবীর ভালোবাসা মেকি নয়। লোকদেখানোও নয়। আশালতার ব্যাপার তিনি খুব আন্তরিক। সে বিরজা দেবীর ভালোবাসায় মুগ্ধ। সেও বিরজা দেবীকে মায়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করে। মেয়ের মনের পরিবর্তন দেখে গিরিবালা তৃপ্তি অনুভব করেন। এই সংসারের কাছে তার যেন আর কোনো চাওয়া পাওয়ার নেই! কন্যা খুশি থাকলেই তিনি খুশি। সংসার নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। তিনি তার মেয়ের দেখাশুনা আর পূজা-অর্চনা করে সময় কাটান।
প্রতিদিনের মতো আজও গিরিবালা পূজা-অর্চনা করে সামনের ঘর ঝার দিতে গেলেন। সামনের ঘরে লোক দেখে চমকে উঠলেন তিনি। এক মুহূর্তও না দাড়িয়ে ছুটে গেলেন বড় জা’র কাছে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন, দিদি সামনের ঘরে কে শুয়ে আছে!
আমার ছেলে।
মানে!
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে আবারও বললেন গিরিবালা। বিরজা দেবী গিরিবালার দিকে তাকান। তারপর বললেন, ছোট বউঠান তুমি আমার ছেলেকে চেন না?
গিরিবালার বিস্ময় কিছুতেই কাটে না। বিরজা দেবীর ছেলেকে তিনি চিনবেন না! তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। না, তিনি কিছুই কিনারা করতে পারলেন না। অবশেষে তিনি আবার বললেন, দিদি রহস্য না করে খুলে বলো? সত্যি আমি বুঝতে পারছি না।
নজরুল গো! আমার ছেলে নজরুল! এর আগে একবার এসে কয়েকদিন থেকে গেলো! তুমি দেখনি! দেখেছ, দেখেছ। এতো দ্রুত ভুলে গেলে কি করে ছোট বউঠান?
গিরিবালা এতোক্ষণ পর যেন বুঝতে পারলেন। তিনি মাথাটা ওপর-নীচ করতে করতে বললেন, মানে ওই কবি!
হ্যাঁ গো হ্যাঁ। জ¦রে তার কঠিন অবস্থা। পারলে দুলিকে একটু ওর কাছে পাঠাও। ছেলেটাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলুক। আমি যে গিয়ে ওকে একটু দেখব তাও কাজের চাপে পারছি না। সকাল থেকে নানা ঝামেলায় আটকে গেছি।
ঠিক আছে দিদি। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।
গিরিবালা ঘরে গিয়ে আশালতাকে নজরুলের অসুস্থতার কথা জানালেন। তাকে বললেন, তুই একটু যা তো মা। ছেলেটাকে একটু দেখ। সে নাকি খুব অসুস্থ।
মায়ের নির্দেশ বলে কথা। তাছাড়া নজরুলকে এর আগেও সে দেখেছে। সেই দেখাটা ছিল একটা স্বপ্নের মতো। তার মনে ঝড় তুলে দিয়ে সে চলে গেছে দৌলতপুরে। সেই মানুষটা আবার এসেছে। এরমধ্যেই শরীরে অসুখ বাঁধিয়েছে। হঠাৎ কী কারণে অসুখ করল! মনে মনে ভাবে আশালতা। তারপর সে ছুটে যায় সামনের ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখে, খাটের ওপর একটা লোক মরার মতো পড়ে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দুটি পাতলা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। দূর থেকে লোকটার নিশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে। ঠাণ্ডা লাগলে নাক থেকে যেমন আওয়াজ বের হয় ঠিক তেমনই। গরগর একটা শব্দ। আশালতা লোকটার মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখে। হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠল। বিদ্যুৎ শকের মতো অবস্থা হলো তার। সে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ও মাই গড! এতো দেখছি সাংঘাতিক জ¦র! শরীরটা যেন তপ্ত আগুনে পুড়ছে!
আশালতা রান্না ঘরের দিকে ছুটে যায়। কলসি থেকে গামলায় পানি ভরে মগসহ নজরুলের কাছে যায়। সে তার মাথায় পানি ঢালতে থাকে। কপালে পানির পট্টি লাগায়। অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালার পর তার জার কিছুটা কমে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলে তাকায় সে। তার শিওরের পাশে বিরজা দেবী না অন্য কেউ তা সে ঠাহর করতে পারে না। সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আশালতা ভেজা কাপড় দিয়ে নজরুলের মুখ মুছে দেয়। তারপর শুকনো গামছা দিয়ে মাথা মুছে দেয়। এতে আরামবোধ করে নজরুল। কিন্তু ঘুমের রেশ কাটেনি।
আশালতা এবার নজরুলের মুখের দিকে ভালো করে তাকাল। তাকে দেখে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। এই রকম রাজপুতের মতো চেহারার মানুষ সে কালেভদ্রে দেখেছে। মলিন মুখখানা দেখে তার বড্ড মায়া হয়। অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। সে বুঝতে পারে, এই মানুষটার অনেক সেবা লাগবে। সেবা দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলতে হবে।
আশালতা মনে মনে ভাবে, সারারাত নিশ্চয়ই কিছু খায়নি। জ্বরের শরীর। মুখে কোনো কিছু রোচেও না। কিন্তু না খেলে যে শরীর আরো দুর্বল হবে। জ¦র তখন আরো পেয়ে বসবে। কি খাওয়ানো যায়!
আশালতা ভাবতে ভাবতে বিরজা দেবীর কাছে ছুটে যায়। তার কাছে গিয়ে রোগীর অবস্থা সবিস্তারে জানিয়ে বলে, কাকীমা রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। মনে হচ্ছে কঠিন জ¦র। আমি ঘণ্টাধিককাল মাথায় পানি দিয়েছি। কপালে পানির পট্টি দিয়েছি। তারপরও জ¦র পরেনি। রোগীকে এখন না খাওয়ালে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। শিগগির কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন কাকীমা।
আশালতার কাছে রোগীর অবস্থা জেনে বিরজা দেবী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি আশালতাকে বললেন, দুলি তুই তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে খবর দিতে পারবি?
আশালতা কোনো কিছু চিন্তা না করেই বলল, হ্যাঁ পারব।
তাহলে যা ডাক্তারকে খবর দে। এর মধ্যে আমি শাগু রেডি করছি। তুই এসেই খাইয়ে দিবি। যা যা, তাড়াতাড়ি যা।
আশালতা ঘাড় নেড়ে তার কথায় সায় দেয়। তারপর ডাক্তার ডাকার জন্য ছুটে যায়। বিরজা দেবীর কাজে গিরিবালা সহায়তা করেন। শাগু তৈরি হতে না হতেই আশালতা ডাক্তার নিয়ে হাজির হয়। সে তাকে নজরুলের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার নজরুলকে ভালো করে দেখেন। এরমধ্যে শাগুর বাটি নিয়ে বিরজা দেবীও সামনের ঘরে গিয়ে হাজির হন। তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাক্তারের কাছে জানতে চান, এখন কি অবস্থা ডাক্তারবাবু?
সাংঘাতিক জ্বর। এরচেয়ে জ্বরের মাত্রা বেড়ে গেলে বিপদ ঘটে যাবে। আমি মিক্চার বানিয়ে দিচ্ছি। প্রতিবেলা খাওয়ার পর এক দাগ করে খাইয়ে দেবেন। আরেকটা কথা, রোগীর সেবা লাগবে। কঠিন সেবা দিয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে হবে।
বিরজা দেবী ডাক্তার কথা বুঝতে পার বুঝতে পারলেন। তিনি আশালতাকে উদ্দেশ করে বললেন, আমার পুত্রের সেবার যেন ত্রুটি না হয়।
আশালতা মাথা নেড়ে বলে, জি কাকীমা। ত্রুটি হবে না।
(চলবে)