পর্ব-৬
বনানী থেকে শাহবাগে ফিরে যেতে বুবলি বসেছে সামনের সিটে।পিছনে তিনজনের সিটে ওরা চারজন। পথে এলেনবাড়ি কী একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ওরা খেতে নামলো। তন্ময় তখন বুবলির কাছাকাছি থাকতে উসখুস করছিলো। কথা বলছিলো আপনি আপনি করে। তা শুনে বুবলি বললো, আমি তো তোমাকে চাকরিটা দিতে পারিনি! তাই আপনি আপনি বলতে হবে না! চাকরিটা দিতে পারলে না হয় এই বাড়তি সমীহ গিলতাম!
পল্লব বললো, চাকরি হয়নি কিন্তু হতেও তো পারে! তাই তুমি বলে পথটা বন্ধ করার দরকার নেই!’
পল্লবের কথার জের টেনে তমাল বললো, এই তন্ময়, তুই বুবলিকে আপনি এবং ম্যাডাম সম্মোধন করে কথা বলে যা। এখানে ওরও একটা পোস্ট আছে। ও তোকে নিজের সহকারী করে রাখতে পারে…!’
সে তো তুইও পারিস। তোর বাবা তো বড় ডেভলপার!’ বলে বুবলি তমালের মাথায় বেশ জোরে চাটি মেরে দিলো।
এভাবেই পরিচয়টা শুরু হয়েছিলো বুবলির সাথে তন্ময়ের। গ্রুপের কজনের ভেতর তন্ময়ের অবস্থাই কেবল খারাপ ছিলে। তাই ওর জন্য সবারই একআধটু সমবেদনা ছিলো। আর সেটাই তন্ময়ের গলায় কাঁটার মতো ঠেকতো। অথচ সে কোনোদিনই নিজের অবস্থার কথা কাউকেই বলতে ভালোবাসে না। আবার মিথ্যে বাহাদুরিও সে দেখাতে যায় না। সত্যি যা, তা যে যা নিজের মতো করে বুঝুক এটাই তার যাঞ্চা!
বুবলি একদিন তাকে একাই ডেকে চারুকলার পুকুরপাড়ে বসে অনেক কথা বলে ফেলেলো। কিন্তু কথাগুলোর ধরন শুনে তন্ময় এমন ভাব করলো, যে সে কিছু শোনেইনি! সেদিন বুবলি বলেছিলো, ওর ওলেভেল পরীক্ষার আগে ওর মা মারা যাওয়াতে ও পরীক্ষায় ফেল করলো। তারপর আরো একবার পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট আরো খারাপ হলো। তারপর তার আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো না! এর ভেতর মা মারা যাওয়ার পর যারা সমবেদনা জানাতে এসেছে এবং যেসব কাজিনেরা বাড়িতে মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গ দিতে থেকে যেতো, তাদেরই একজন আমার বড় চাচার ছেলে। তাকে ছোটবেলা থেকেই কেন যেন আমার ভালো লাগতো। আমি সবাইকে রেখে তারই অনুকূল ঘেঁষে থাকতে লাগলাম। বাড়ির ছোটমেয়ে বলে আমাকে সবাই ছোট জানলেও, ওর জন্য আমার ভেতরে কী এক কাতরতা কাজ করতো। আমার ভাইয়েরা তখন বাড়িতে। আমি সবার নজর এড়িয়ে সাবধানে সেই কাজিনের রুমে চলে যেতাম। খোলা রুম আমি গিয়ে বন্ধ করতাম। দিনের বেলা কেউ কারো দিকে চোখ তুলে চাইতাম না! কিন্তু রাতের জন্য আমার রক্তে দুর্ণিবার টান তৈরি হতো। আর তাতেই যেন মায়ের শোকটা চাপা পড়ে গেলো।
একসময় সবাইকে যারযার বাড়ি ফিরে যেতে হলো।মরা বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলে কেউ একজন বাড়িতে আসাযাওয়া করলে তো বাড়ির পাহারাদার থেকে বৃদ্ধা আত্মীয়-স্বজনের চোখে পড়বে। আর আগে থেকে ওর একজন পছন্দের মেয়ে ছিলো। আমি তা জানতামও। তবু কেন যে যেতাম এখন হিসেব করে বুঝি না!
তন্ময়ের মনে হচ্ছিলো, বুবলি কেন এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছে! সে বললো, চলো আমরা আজিজ মার্কেটে গিয়ে নতুন আসা পত্র-পত্রিকা দেখি’ বলে উঠতে গেলে বুবলি তাকে হাত ধরে টান দিয়ে বসালো। তারপর আবার বলতে লাগলো, একদিন আমাকে দেখাশোনা করার যে আয়া ছিলো, সে বললো, তুমি যে দুই মাস ধরে স্যানেটারি ন্যাপকিন কিনতে বলো না?’ আমি বলতে পারতাম আগের ছিলো। কিন্তু আমিও ভাবলাম, তাই তো!
পরে তাকেই ডেকে সব বললাম। সে বললো, এখন কি হবে? যদি কনসিভ করে থাকো, খুব ঝামেলা হবে, জানো না তো! কারণ অবিবাহিত মেয়েদের এবরসন কোনো ডাক্তার করতে চান না! পরে সে আয়াই বললো, ওকে বলো তোমাকে বিয়ে করতে!’
আমার তখন আঠারো বছর হয়নি। তবু আমি আয়াকে বললাম, না না, আমি তো নিজের দায়িত্বে ওর কাছে গিয়েছি। এখন ওকে আমি দোষ দিয়ে নিজেকে ছোট করতে পারবো না! তারপর আয়াকে নিয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে ভেতরে জন্মানো জীবনটাকে রিমুভ করে এলাম। কিন্তু এখন হলে রিমুভ করতাম না!
তন্ময় বুবলির সব কথা এতক্ষণ মন নিয়ে না শোনার ভান করলেও বুবলির শেষ কথার পরে বলে উঠলো তাহলে কী করতে?
: আমার রক্তমাংসের ভেতর যে প্রাণ বেড়ে উঠবে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কি আমার নয়! এতবড় পৃথিবীতে তার জায়গা হতো না! সভ্য দেশগুলোতে সিঙ্গেল মাদার হওয়ার ভেতর কোনো গ্লানি নেই। না হয় তেমন একটা দেশে চলে যেতাম! না হয় এই দেশেই আমি কারো সাথেই মিশতাম না!
: তুমি যে ওইটুকু বয়সে নিজের দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে নিজেকে ছোট করোনি এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না! তবে এসব কথা কি তুমি অন্য বন্ধুদেরও বলেছো?
: না! আমার পরে তুমি তৃতীয়। নূরজাহান, মানে আমার সেই আয়া দ্বিতীয়।
: ঠিকাছে আর বলো না। ভুলতে ভুলতে অনেক কিছু মিথ্যে হয়ে যায়। আর মিথ্যেও অনেকবার বললে সত্যের মতো শোনায়। ওটা তোমার শোকের সময়ের একটা বিভ্রম ছিলো। তুমি তোমার কাজিনকে তোমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করোনি, অতএব সিঙ্গেল মাদার হওয়ার অধিকার তোমার ছিলো।এখানেই তুমি আমার কাছে প্রকৃত মানুষ!