ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৪) ॥ দেবো খোঁপায় তারার ফুল


চতুর্থ পর্ব
দুদিন আগেও যে বাড়িতে লোকে গমগম করেছে সেই বাড়িটাতে আজ জনমানবশূন্য। বিয়ে বাড়ির কোনো চিহ্ন নেই। আত্মীয়স্বজনরা চলে গেছে যে যার বাড়িতে। তারা চলে যাওয়াতে বাড়ির লোকরা কিছুটা স্বস্তিবোধ করছে। যেভাবে তারা ফোড়ন কাটা শুরু করেছিল। আর দুএকদিন থাকলে হয়তো আসমাতুন্নেসা পাগল হয়ে যেতেন। এখন আর বাইরের কেউ এই বাড়িতে নেই। যারা আছেন তাদের সবারই মনমরা অবস্থা। মনমরা হয়ে থাকার একটাই কারণ, নার্গিস। নার্গিসের জন্য তাদের মন খারাপ। বাপমরা মেয়ের জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা কে জানত! অথচ নার্গিস নিজেকে নিয়ে মোটেই ভাবছে না। সে ভাবছে নজরুলকে নিয়ে। সে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। নজরুল নামক এক কঠিন ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার ঘোর কিছুতেই কাটছে না। সে চোখে চোখে নজরুলকে দেখছে। তার মুখে নার্গিস ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। ঘরের চারদিক থেকে তার অট্টহাসি ভেসে আসছে। সে কখনো গান গাইছে। কখনো বাঁশি বাজাচ্ছে। আবার কখনো কবিতা আবৃত্তি করে সবাইকে মাতিয়ে তুলছে। এই দৃশ্য নার্গিসের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার।

নজরুল দৌলতপুরে এসেই সবার মন জয় করে ফেলেছেন। এ যেন সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তার পেছনে পেছনে ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে ছুটছে। তাকে যে যা অনুরোধ করছে সঙ্গে সঙ্গে তাই তিনি করছেন। কোনো কিছুতেই তার না নেই। একবার গাঁয়ের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরল। তাদের উদ্দেশে একটি কবিতা লেখার জন্য অনুরোধ জানাল। ওমনি নজরুল লিখে ফেললেন, হার মানা হার কবিতা।
‘তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি!
আমার পথিক-জীবন এমন ক’রে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ ক’রে বাঁধন পরালি।
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে
তা’রা হার মেনে হয় বিদায় নিল কেঁদে
তোরা কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ঐ কচি বাহুর রেশমী ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস,
‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস,
কেন ঘর ছাড়াকে এমন ক’রে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।’

কবিতাটির এই অংশটুকু নার্গিসের মনে পড়ে। সে মনে মনে বলে, কী করে সম্ভব এভাবে মুহূর্তের মধ্যে একটি কবিতা লেখা! এ যেন এক মূর্তিমান বিস্ময়! এমন বিস্ময়কর প্রতিভার কথা সে জীবনে কখনো শোনেনি। আর সেই প্রতিভা তার হাতের নাগালে। হৃদয়ের মণিকোঠায় ঝড়ের বেগে তিনি ঢুকে গেছেন। গভীর ভালোবাসা, গভীর মায়ার বাঁধনে বেঁধেছেন তিনি। ভালোবেসে সৈয়দা খাতুনের নাম দিয়েছেন নার্গিস। নজরুল যখন বলেছেন যে, তাকে তিনি নার্গিস বলে ডাকবেন। তখন তার কী যে আনন্দ হয়েছিল! আনন্দে তার মাটিতে পা পড়ছিল না। সে নাচতে নাচতে বলল, বাহ! সুন্দর নাম তো!
তারপরও নজরুল বললেন, তোমার আপত্তি নেই তো!
সৈয়দা খাতুন উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলল, আপত্তি! কিসের আপত্তি? এ যে আমার পরম পাওয়া!
সেই থেকে সবাই সৈয়দা খাতুনকে নার্গিস বলেই ডাকে। মাত্র কদিনের ব্যবধানে ছোটবেলায় মা বাবার দেয়া ‘সৈয়দ খাতুনের’ নামটি মুছে যায় তার জীবন থেকে। যেন সৈয়দা খাতুন বলে কোনো নামই ছিল না।

নার্গিস পাগলের মতো ছোটাছুটি করে। সে ঘরের মধ্যে এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যায়। নজরুলকে খোঁজে। উঠানে, ঘরের সামনে, পেছনে, ডানে বায়ে উঁকি দিয়ে দেখে। কোথায় আছে নজরুল। তার মনে হয়, নজরুল তাকে ডাকছে। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে যায় তার কাছে। তাকে না পেয়ে আবার অন্য দিকে যায়। তার মনে হয়, তাকে ডেকেই সে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। নার্গিসও ছুটে যায় সেখানে। না পেয়ে আবার অন্য দিকে দৌড়ায়। মনে হচ্ছে যেন লুকোচুরি খেলছে।

আসমাতুন্নেসা অনেকক্ষণ ধরে নার্গিস নার্গিস বলে উঁচু গলায় ডাকেন। কিন্তু তার ডাক সে শুনতে পাচ্ছে না। সে সারাক্ষণ নজরুলের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। তার ডাকেই সে সাড়া দেয়। অন্য কারো ডাক তার কানে পৌছায় না। কখনো সে নজরুলের হাত ধরে হাঁটে। আবার কখনো নজরুলের আবেগের হাত নার্গিসের কাঁধে রাখে। তারপর দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে থাকে। গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে যায় অনেক দূরে। নার্গিসকে তিনি গুণগুণিয়ে গান শোনান।
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সে কী মোর অপরাধ!
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে করোরিণী
বলে না তো কিছু চাঁদ।
চেয়ে চেয়ে দেখি ফোটে যবে ফুল
ফুল বলে না তো সে আমার ভুল
মেঘ হেরি ঝুরে চাতকিনী
মেঘ করে না তো প্রতিবাদ।
জানে সূর্যেরে পাবে না
তবু অবুধ সূর্যমুখী
চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতারে
দেখিয়াই সে যে সুখী।
হেরিতে তোমর রূপ-মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ।’

নার্গিসের কোনো সাড়া না পেয়ে আসমাতুন্নেসা নিজেই ছুটে আসেন তার কাছে। এসে দেখেন, নার্গিস উদাস দৃষ্টিতে এদিক তাকায়। ওদিন তাকায়। কখনো সে শব্দ করে হাসে। কখনো পাগলের মতো প্রলাপ বকে। আসমাতুন্নেসা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে বলেন, এ কী হলো আমার মেয়ের! তার যে মাথা ঠিক নেই! এখন উপায় কী হবে!
আসমাতুন্নেসা কন্যার কাছে ছুটে যান। তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, কি রে মা! তুই এমন করছিস কেন?
নার্গিস তার মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। সে পাল্টা প্রশ্ন করে বলে, মা নজরুল কোথায়? ওকে খাবার দিয়েছ? কি রান্না করেছ মা? তোমার হাতের ছোট মাছের চচ্চরি নাকি খুব ভালো হয়!

আসমাতুন্নেসা কোনো কথা বলেন না। তিনি নার্গিসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নার্গিসকে ভালো করে দেখেন। মেয়ের জন্য তার বড় কষ্ট হয়। কান্না পায়। অনেক কষ্টে তিনি আবেগ সংবরণ করেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর ক্ষুধা পায়নি? চল খেতে চল।
মা যে কী কয়! নজরুলের খাওয়ার আগে আমি খাব? আগে নজরুলকে খাওয়াতে হবে না! তার জন্য খাবার রেডি করছ?
নজরুলকে তুই কোথায় পেলি?
নার্গিস ভ্ররু কুচকে আসমাতুন্নেসার দিকে তাকায়। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, কেন? তুমি নজরুলকে দেখতে পাও না?
কোথায় আমাকে দেখা তো! আসমাতুন্নেসা বললেন।
নার্গিস নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, এই যে! এই এখানে! আমার বুকের মধ্যে।
আসমাতুন্নেসা নির্বাক দৃষ্টিতে নার্গিসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি কি বলবেন ভেবে পান না।
(চলবে)