ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৫) ॥ দেবো খোঁপায় তারার ফুল


পঞ্চম পর্ব : নজরুল ঘুমিয়ে আছেন। গভীর ঘুমে ডুবে আছেন তিনি। আশালতা তার বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় হয়ে তাকে দেখছে। একটা মায়া, একটা ভালোলাগা কাজ করছে তার ভেতরে। সেই ভালোলাগাটা তার চেহারায় ফুটে উঠেছে।

আশালতা মনে মনে বলে, মনে হচ্ছে আর জ্বর নেই। তারপর সে নজরুলের কপালে হাত বাড়িয়ে দেয়। হাতের স্পর্শে চমকে ওঠেন নজরুল। চোখ মেলে চারদিকটা দেখেন। আশালতাকে দেখে তৃপ্তির হাসি হেসে তার হাতটা চেপে ধরে। আশালতা ছাড়িয়ে নেয়ার কোনো চেষ্টাই করে না। সে আস্তে করে বিছানার পাশে বসে। নরম গলায় বলে, আজ বেশ চাঙ্গা লাগছে আপনাকে।
নজরুল আশালতার কথায় সায় দিয়ে বললেন, বাব্বা! কী যে ঝড় গেলো আমার শরীরের ওপর দিয়ে!
আশালতা বলল, হ্যাঁ গেছেই তো। যে ঝড় মাথায় নিয়ে আপনি দৌলতপুর থেকে এসেছিলেন!
ওরে বাবা! সে কথা মনে পড়লেও গা শিউরে ওঠে। নজরুল বললেন।
আশালতা বলল, আপনার সাহসের তারিফ করতে হয়।
আমিও ভাবছি, সাহসটা একটু বেশিই দেখিয়ে ফেলেছিলাম! তাই না?
হুম। সাহস না দেখালে হয়তো আমার সঙ্গে আর দেখাও হতো না! মুচকি হেসে বলল আশালতা।
তা বটে তা বটে!
এবার হাতটা ছাড়ুন মশাই!

আশালতা দুই দাঁতের পাটিতে জিহবা কামড়ে মনে মনে বলে, মশাই বলাটা কি ঠিক হলো! যাকগে, যা বলা হয়ে গেছে তা তো আর ফিরাতে পারব না! কাজেই চেপে যাওয়াই ভালো। তারপর সে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নজরুল হাত ছাড়লেন না। তিনি চেপে ধরে রাখলেন। আশালতা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, এই! কেউ এসে দেখে ফেলবে তো!
তাতে আমার বয়েই গেলো!
একটুও ভয় ডর নেই বুঝি!
কিছুক্ষণ আগেই তো বললে, আমার অনেক সাহস।
বলেছি তো!
তাহলে ছাড়ব কেন?
এভাবে সারাজীবন ধরে রাখতে পারবেন? আশালতা এক রকম মুখ ফসকে বলে ফেলল কথাটা।

নজরুল আবেগের দৃষ্টিতে আশালতার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটুও দৃষ্টি ফেলছেন না তিনি। এতে আশালতা কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। সে বলে, কি দেখছেন?
তোমাকে দেখছি।
আমি সে রকম সুন্দরী কেউ না।
কী যে বলো! শোন, আমি যদি তোমার একটা নাম দিই! সেই নামে আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে ডাকবে না!
তাই!
হুম। আমি তোমাকে প্রমীলা বলে ডাকব।
বাহ! সুন্দর নাম তো! প্রমীলা..
তোমার পছন্দ হয়েছে?
হুম। খুব পছন্দ হয়েছে।
তাহলে আজ থেকে তুমি আমার প্রমীলা।

নজরুলের কথা শুনে আশালতার শরীরের ধমনিগুলো আনন্দে নেচে ওঠে। খুশির বন্যা বয়ে যায় তার মনের ভেতরে। এতো খুশি সে আগে কখনো হয়নি। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে রইল না। সে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। তার হাসি মুখখানা দেখে বিরজা দেবী বললেন, কি রে, তোকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে! ঘটনা কি?
আশালতা মাথা নীচু করে বলল, কিছু না।
বললেই হোলো কিছু না। অবশ্যই কিছু হয়েছে। বিরজা দেবী বললেন।

আশালতা কিছুতেই তার আনন্দের কথা প্রকাশ করতে চাইল না। পরে বিরজা দেবী প্রসঙ্গ পাল্টালেন। নজরুল ঘুম থেকে উঠেছে কিনা জানতে চাইলেন। আশালতা মাথা নেড়ে সায় দিল। বিরজা দেবী বললেন, তাহলে ওকে গিয়ে বল, নাশতা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি যেন নাশতা খেতে আসে।
আশালতা আবার ছুটে যায় নজরুলের কাছে। তাকে নাশতা খাওয়ার তাগিদ দিয়ে আবার ফিরে আসে বিরজা দেবীর কাছে। এখন সে খুবই সাবধানী। কোনোভাবেই যাতে তার মনের ভাব প্রকাশ না পায় সেজন্য নিজের ভেতরেই তার আনন্দ চেপে রাখে। বিরজা দেবী আশালতার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যারে, কেমন দেখলি নজরুলকে? আগের চেয়ে ভালো তো?
আশালতা ইতিবাচক মাথা নাড়ে।
গত দুইদিন কোনো জ¦রটর আসেনি?
আশালতা ডানে-বায়ে মাথা নাড়ে।
তুই নাশতা করেছিস?
আশালতা বলল, না।
নজরুলের নাশতা রেডি করে তুই খেয়ে নে।

আশালতা নজরুলের জন্য নাশতা রেডি করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুল বিরজা দেবীর সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে বিরজা দেবী তড়িঘড়ি করে নাশতার তৈরির তাগাদা দেন। তারপর তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চান, এখন কেমন আছো বাবা?
জি মা; ভালো আছি। এখন একদম সুস্থ মনে হচ্ছে। আপনি যা করলেন! আমাকে চিরদিনের জন্য ঋণী হয়ে গেলাম।
এ কী বলছ তুমি বাবা! মা ছেলের জন্য করবে না তো কার জন্য করবে?
তারপরও মা। আপনি না হলে সত্যিই আমার মরণ দশা হতো!
বাছা আমার কি বলে! মা থাকতে ছেলের মরণ দশা হতে দিলে তো!
মা, আমার এবার যেতে হবে।
আরে যাবে তো! এতো তাড়া কিসের? আরো কিছুদিন থাকো। এখনো তো শরীরের দুর্বলতা কাটেনি!
এখন আর অসুবিধা হবে না মা। কলকাতায় কিছু কাজ আছে। আমি আবার আসব। আপনি যে মায়ার বন্ধনে আমাকে জড়ালেন তা থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় আছে!
কী যে বলো বাবা! অবশ্যই তুমি আসবে। মাকে দেখতে আসবে না! শোন, যেখানে থাকো যেমনই থাকো মায়ের কথা ভুলো না যেন! তাহলে আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব!
না মা। কোনোদিন না। আপনাকে ভুলে থাকা সম্ভব না।
কথাটা মনে থাকে যেন!

এ সময় আশালতা নাশতা নিয়ে হাজির হয়। সে নজরুলের সামনে নাশতা এগিয়ে দেয়। বিরজা দেবী তাকে নাশতা খাওয়ার জন্য বলে নিজের হাতে চা বানান। তারপর চায়ের কাপ এগিয়ে দেন নজরুলের সামনে। আশালতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে উদ্দেশ করে বিরজা দেবী বললেন, তুই যা না দুলি; খেয়ে নে।
পরে খাই! আশালতা বলল।
বিরজা দেবী বললেন, কেন পরে কেন?
আশালতা নীচু গলায় বলল, এমনি।
নজরুল মুখের খাবার গিলতে গিলতে বললেন, মা আমি তাহলে আজই রওয়ানা হই!
জ¦রের কারণে তোমাকে তো কিছু খাওয়াতেই পারলাম না। আর দুদিন পরে যাও। একটু ভালো মন্দ রান্না করি।
প্রতিদিন যা খাচ্ছি! আর কত খাবো মা?
বিরজা দেবী এবার শাসনের সুরেই বললেন, না না; তুমি না কোরো না তো! তোমার জন্য ভালো ভালো রান্না হচ্ছে। আগামী দুদিন ভালোমন্দ খাবে। শরীরটাও ঠিক হয়ে উঠবে। তারপর তোমার যাওয়া।
নজরুল আর কোনো কথা বললেন না। মনে মনে তিনি খুশিই হলেন। কারণ আশালতা। যে সেবা তাকে সে দিয়েছে, এটা আর কেউ দিত কি না সন্দেহ। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ এবং আশালতার প্রতি তার ভালোবাসা তাকে আকড়ে ধরেছে। তার পায়ে যেন শিকল পড়িয়েছে। আরো দুদিন আশালতার সঙ্গ পেলে মন্দ কী!
পাশে দাঁড়িয়ে আশালতা মুচকি মুচকি হাসে। সে নিজেও ভীষণ খুশি। আরো দুদিন নজরুলের সান্নিধ্য পাবে। এটা তার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
(চলবে)