ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৬) ॥ দেবো খোঁপায় তারার ফুল


পর্ব-ছয়
খান বাড়ির এ কী হাল! কঠিন এক নীবরতা ভর করেছে বাড়িটার ওপর।বাড়ির মানুষগুলো যেন বোবা কালায় পরিণত হয়েছে।বাড়িতে মানুষ আছে।অথচ তাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই।মানুষগুলো কেমন যেন রোবটের আচরণ করছে।কদিন আগেও খান বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়, গানবাজনায় মেতে ছিল।বাড়ির সবার মুখে হাসি ছিল।নজরুল চলে যাওয়ার পর তাদের হাসিও যেন বিদায় নিল।বন্ধ হয়ে গেলো নার্গিসের ছোটাছুটি।একবারের জন্যও তার পায়ের নূপুরের আওয়াজ কানে আসে না।

পাশের বাড়ির মহিলারা নার্গিসকে নিয়ে আকথা কুকথা বলে।কখনো কখনো টিপ্পনি কাটে।সেই কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করে না খান বাড়ির লোকেরা।আলী আকবর খান অবশ্য অনেক কষ্টে এসব কথা সহ্য করছেন।এক কান দিয়ে শুনছেন আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন। তিনি মনে মনে বলেন, সময় আসবে।অবশ্যই আসবে।তখন এর কঠিন জবাব তিনি দেবেন।আজেবাজে কথার ঝাল তিনি মেটাবেন।

নজরুল চলে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত নার্গিস নিজের ঘর থেকে বাইরে বের হয়নি।আসমাতুন্নেসা অনেকবার তাকে ডাকাডাকি করেছেন।বাইরে বের হওয়ার জন্য বলেছেন।কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।নজরুল চলে যাওয়ার পর ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি সে।এ কারণে তার শরীরটাও তেমন ভালো যাচ্ছে না।সে নিজের ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে।আর সারাক্ষণ নজরুলকে নিয়ে ভাবছে।চোখ বন্ধ করলেই নজরুলের হাসি মুখখানা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।তার সঙ্গে সুখস্মৃতিগুলো নার্গিসের মনে অন্য রকম এক অনুভূতি জাগায়। নজরুল যে চলে গেছে সে কথা বেমালুম ভুলে যায়।সে ভাবে, নজরুল তাদের বাড়িতেই আছে।নজরুল তার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে।সে নজরুলের গান শুনছে।কবিতা শুনছে।দুজন একসঙ্গে হাসিঠাট্টা আর গল্পে মেতে উঠছে।নার্গিস চোখে চোখে দেখছে, পুকুরপাড়ে বসে নজরুল বাঁশি বাজাচ্ছে।সেই বাঁশির সুর এখনো তার কানে বাজে।

একদিন সত্যি সত্যি নজরুল পুকুরপাড়ে বসে বাঁশি বাজিয়েছিলেন।তার পাশে বসে বাঁশি শুনছিল নার্গিস।হৃদয় হরণ করা সেই সুর নার্গিসকে এতোটাই বিমুগ্ধ করল যে, সে আর স্থির থাকতে পারল না।সে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল, এমন জাদুকরী সুর তুমি কোথায় পেলে! আমি যে পাগল হয়ে যাবো!

নার্গিসের কথায় নজরুলও আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না।তিনি আবেগের হাত রাখলেন নার্গিসের হাতে।তারপর আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, তুমি আমার ভালোবাসার নার্গিস! আমার ভালোবাসার ফুল। সারাজীবন তুমি আমার জীবনে সুবাস ছড়াবে।আমার বাউণ্ডুলে জীবনটাকে ভালোবাসার শেকলে বেঁধে রাখবে।

নার্গিসের কাছে কথাগুলো যেন অবিশ্বাস্য লাগছিল।সে কি সত্যি সত্যিই নজরুলের মুখ থেকে কথাগুলো শুনছে! নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখে সে ঠিক আছে কি না! তারপর আবেগজড়ানো কণ্ঠে সে বলল, আপনার এই হাতটা না আমার জন্য সবচেয়ে ভরসার হাত।সারাজীবন যদি আপনার এই হাত আমার হাতের ওপর থাকে তাহলে আমি আর কিছু চাই না।আর কিছুর প্রয়োজন নেই আমার।কথা দিন, আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

ভালোবাসার মানুষকে কি ছেড়ে যাওয়া যায়! নজরুল বললেন।
নার্গিস মনে মনে শুধু বলল, এরচেয়ে ভরসার কথা আর কী হতে পারে! কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারল না।নারীরা অনেক কথাই বলতে পারে না।পুরুষকে নারীর মনের কথা বুঝে নিতে হয়।সে রকমভাবেই বোঝাতে চাইল নার্গিস।সে চুপ করে আছে।কিন্তু মনের মধ্যে তার আনন্দ খেলা করে।আনন্দের সাগরে ভাসে সে।আবেগ তাকে এতোটাই আচ্ছন্ন করল যে, সে আর কোনো কথা বলতে পারল না।

নজরুল কবি মানুষ।তিনি মানুষের মনকে খুব ভালো রিড করতে পারেন।নার্গিসের মনের অবস্থাও সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। সেদিন রাতেই নজরুল লিখে ফেললেন নার্গিসকে নিয়ে একটি কবিতা।কবিতার নাম কার বাঁশী বাজিল।
‘কার বাঁশী বাজিল
নদী পাড়ে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল।
কার বাঁশী বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল করে সুরে সুরে
এত করে ঝুরে ঝুরে
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ তনু মন ঘন ঘন নাচিল।
ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশী বাজিল?
কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো!
না কওয়া কি কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!
মম নারী হিয়া মাঝে
কেন এত ব্যথা বাজে?
কেন ফিরে এনু লাজে
নাহি দিয়ে যা ছিল!
যাচা-প্রাণ নিয়ে আমি কেমনে যে বাঁচি লো?
কেঁদে কেঁদে আজি লো কার বাঁশী বাজিল?’

নজরুলের সেই কথা মনে পড়তেই নার্গিস খুশিতে টগবগ করতে থাকে। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেয়, তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে নার্গিস।অপেক্ষা করতে হবে।এতো উতালা হলে চলবে না।সে তোমাকে কথা দিয়েছে; তোমাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।জরুরি কাজে তাকে কলকাতায় যেতে হয়েছে।কাজ শেষ করেই সে আবার ফিরে আসবে শ্রাবণ মাসের কোনো একদিন!

নার্গিস আবার ভাবে, একটা রাত সে আমার সঙ্গে কাটাতে পারল না! এই রাত কি জীবনে আর আসবে! তার যদি এতোই জরুরি কাজ থাকবে তাহলে তড়িঘরি করে বিয়ের পিঁড়িতে না বসলেই হতো! অপেক্ষাটা না হয় বিয়ের আগে করতাম! নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে! মামা কাবিননামায় ‘ঘরজামাই’ হওয়ার একটা শর্তজুড়ে দিয়েছেন। সেটাই কি তার আকস্মিক চলে যাওয়ার কারণ!
নার্গিস আর ভাবতে পারে না।
(চলবে)