পাঠ-প্রতিক্রিয়া: উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি ॥ লুনা রাহনুমা


বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।এটি লেখক শওকত ওসমানের প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস।৮০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি নাটকের মতো সংলাপ নির্ভর এবং কিছু দৃশ্যের আগে নাটকের মতো আলাদা করে পটভূমির বিবরণ দেওয়া আছে। আবার চরিত্রের আগমন এবং প্রস্থানের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উপন্যাসটির বিস্তার ঘটেছে বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদ এর সময়কালে তাঁর রাজ্যে।

উপন্যাসের শুরুটি হয়েছে সুলতানা জুবাইদা ও তাঁর অত্যন্ত রূপসী এক আরমানি বাঁদীর কথোপকথন দিয়ে। সুলতানা বাঁদী মেহেরজানকে ভালো পোশাক পরিয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে, হাতে আঙুরের থোকা ধরিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে হাবশী গোলাম তাতারীর সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে পাঠাচ্ছেন।এর আগেই সুলতানা নিজের স্বামী হারুনকে না জানিয়ে মেহেরজান এবং তাতারীর বিয়েও দিয়েছেন।

পরের দৃশ্যে দেখা যায় সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ খলিফা হারুনকে তাঁর হারেমখানায় মনোকষ্টে একাকিত্বে ভুগছেন।জল্লাদ এবং খলিফার সহচর মশরুর এসে পৌঁছুলে খলিফা তার কাছে নিজের মনের যাতনা ব্যক্ত করছেন।খলিফা হারুন নিজের বোন আব্বাসাকে হত্যা করেছেন জাফরের সাথে প্রণয়ের কারণে।কিন্তু এখন নিজেই স্মৃতির জালে আটকা পড়েছেন এবং নিজের ভুলের অনুশোচনায় ভীষণ অশান্ত মন।খলিফা বলেন, “মাশরুর আজো নিজের বিচার মানুষ নিজে করতে শেখেনি। সে খোদকসী (আত্মহত্যা) করতে পারে, যেমন সে রোজ গোস্তের জন্য দুম্বা কি গাইকসী করে, কিন্ত নিজের বিচার করে না।”

মশরুর খলিফাকে রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশে বাগানে হাঁটার পরামর্শ দেয়। পরামর্শ অনুযায়ী খলিফা হাঁটতে গিয়ে রাতের আঁধারে মানব-মানবীর অস্পষ্ট হাসির শব্দ শুনতে পান। “কোথা থেকে আসছে এই হাসি?” হাসির উৎস বের করার দায়িত্ব দেন মাশরুরকে।খোঁজ নিয়ে মশরুর জানায় এই হাসি এসেছে হাবশি গোলামের ঘর থেকে।

জল্লাদ মশরুর এ-ও জানায় খলিফা হারুনের বেগম সুলতানা, মেহেরজানের সঙ্গে তাতারীর বিয়ে দিয়েছেন।গোপন বিয়ের ফলস্বরূপ তারা রাতের অন্ধকারে গোপনে সাক্ষাৎ করে পরস্পরের সাথে এবং হৃদয়ে উপচে পড়া খুশির জোয়ারে উচ্ছসিত কণ্ঠে খুশির হাসি হাসে রাত গভীরে।খলিফার খুব লোভ হয় এমন আনন্দের হাসি কিনে নিতে। এক রাতে খলিফা হারুন তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে তাতারীর ঘরে আচমকা উপস্থিত হয়ে সেখানে মেহেরজানকে আবিষ্কার করেন। সেই রাতেই তিনি তাতারীকে মুক্ত ঘোষণা করে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক ঘোষণা করেন।যদিও প্রকৃত অর্থে খলিফা এই উপহারের মাধ্যমে তাতারীকে বন্দি করেন।এবং মেহেরজানকে বন্দি করেন বিয়ে করে নিজের বেগম বানিয়ে।

হাবশী গোলাম তাতারী কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে অঢেল প্রাচুর্যের মোহে একটুও বিগলিত হয় না।মেহেরজানকে পাশে না পেয়ে তার বিমর্ষ মুখে কিছুতেই আর হাসি ফুটে না।হাসি তো দূরের কথা, দাস দাসীদের কেউ তাতারীর মুখের দাঁত পর্যন্ত দেখতে পায় না।খলিফা হারুন একদিন ক্রীতদাস তাতারীর মুখের সেই প্রাণখোলা হাসির শব্দ শোনাবেন বলে বাজি ধরলেন আবুল আতাহিয়া আর আবু নওয়াসের সাথে।কিন্তু খলিফা হারুন-অর-রশিদ এর আদেশ, ভয় ভীতির মুখেও তাতারীর মুখে হাসি ফোটে না।সকল চেষ্টা বৃথা যাওয়ার পর খলিফা কারণ জানতে চান সঙ্গীর কাছে।কবি আবু ইসহাক তখন বলে, “হেকমী দাওয়াই তৈরি করতে যেমন অনেক উপাদান প্রয়োজন হয়, তেমনি হাসির জন্য বহু অনুপান দরকার।”

লেখক শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। যখন সমগ্র পাকিস্তানে জারি করা হয়েছে সামরিক শাসন। আর বাঙালিদের ঘাড়ে চেপে রয়েছে আইয়ুব খান। নির্মম একপেশে সেই শাসন ব্যবস্থার ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলা স্বৈরশাসনের অত্যাচার ও নিপীড়নে দোযখে পরিণত হয়েছে। পূর্ব বাংলার সেই সময়রূপ যেন ঠিক এই উপন্যাসের বাগদাদেরই প্রতিচ্ছবি। মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, খলিফার কথার অবাধ্য হলেই মানুষের গর্দান কাটা পড়ছে, খলিফার মতের সাথে অমত হলেই জল্লাদের হাতে প্রাণ দিচ্ছে অসংখ্য দাস, দাসী, সাধারণ প্রজা।উপন্যাসের প্রথম অংকে খলিফার বেগম জুবাইদার মুখে তাই উচ্চারিত হয়, “মরজী যেখানে ইনসাফ সেখানে কোন কিছুর উপর বিশ্বাস রাখতে নেই!” অর্থাৎ যেখানে ন্যায় অন্যায় খলিফার মন মেজাজের উপর নির্ভর করে সেখানে ন্যায়বিচারের আশা করা যায় না।

লেখক শওকত ওসমান এই উপন্যাসে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনকেই ব্যঙ্গ করেছেন।যেখানে রূপক অর্থে পূর্ব বাংলা হয়েছে বাগদাদ, খলিফা হারুন-অর-রশিদ হয়েছে স্বয়ং আইয়ুব খান আর তাতারী হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতিনিধি। আর এই রূপক অর্থকে লুকাতে শওকত ওসমান আশ্রয় নিয়েছেন আরব্য রজনীর ছদ্মবেশ। আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা (সহস্র ও এক রাত্রি)-কে রূপান্তরিত করেছেন আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে (সহস্র ও দুই রাত্রি)-তে, যার শেষ গল্প এই ‘জাহাকুল আবদ’ অর্থাৎ ‘ক্রীতদাসের হাসি’।ক্রীতদাস তাতারীর হাসির মাধ্যমে লেখক বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ফুটিয়ে তুলেছেন যে হাসি বা স্বপ্নকে খলিফা হারুন তথা আইয়ুব খান গায়ের জোরে নিজের করে রেখে দিতে চান। তৎকালীন মূর্খ শাসকগোষ্ঠী উপন্যাসের এই রূপক অর্থ ধরতে পারেনি। আর তাই উপন্যাসটি প্রকাশের একই বছরে এটি বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কার পায়।এবং ইতিহাসের ব্যঙ্গ ভ্রূকুটি হিসেবে কথাশিল্পী শওকত ওসমান এই পুরস্কার গ্রহণ করেন স্বয়ং আইয়ুব খানের হাত থেকেই।আর এই ঘটনার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৯৯৫ সালে ‘পুঁথিঘর লিমিটেড’ থেকে যখন উপন্যাসটির পুনঃমুদ্রণ হয় এবং সেই মুদ্রিত বইয়ের ভূমিকায় শওকত ওসমান লিখেছেন: “জুয়াড়ির মতো আমি দান ধরেছিলাম। হয় জয়, অথবা সর্বনাশ সুনিশ্চিত। জিতে গিয়েছিলাম শাসক শ্রেণীর মূর্খতার জন্যে।”

অসামান্য এই উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি পড়তে শুরু করলে পুরোটা শেষ না করে থামা কঠিন পাঠকের জন্য।পড়তে পড়তে উপন্যাসটির অনেক কথাই বাণীর মতো পাঠক-মস্তিষ্কে গেঁথে যাবে। আমার পছন্দের কয়েকটি লাইন নিচে তুলে দিলাম।
“আমিরুল মুমেনিন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।”
“মনে রেখো, যোগ্যতা থেকে কোন চিজ না পেলে তা ঢিলে লেবাসের মত বেখাপ্পা-ই দেখায়। আর যোগ্যতা-মেহনৎ ব্যতিরেকে যারা পুরস্কার প্রার্থী- তারাই হচ্ছে দুনিয়ার আসল গোলাম।”
“দুঃখ আর মৃত্যু এক জিনিস নয়।দুঃখের গান গাই দুঃখকে দূর করার জন্যে, দুঃখের মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারব, তার জন্যে। যারা এই জীবন জিইয়ে তুলতে পারে না, তারা কবিতা লেখে শকুনদের জন্যে। পারশীরা শকুনের কাছে যেমন মড়া ফেলে দেয়, ওই কবিরা তেমন কবিতা ছুড়ে দেয় পাঠকদের জন্যে।আজান দিয়ে মুসল্লি ডাকে, তুমি কবিতা দিয়ে মানুষ ডাকার বন্দোবস্ত করো। তুমি -”
“দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দি কেনা সম্ভব-! কিন্তু-কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি-না-না-না-না-”।

ক্রীতদাসের হাসি
শওকত ওসমান
বর্তমান মুদ্রণ: সময় প্রকাশন
প্রকাশক: ফরিদ আহমেদ
মূল্য: ১০০ টাকা