গড়াই নদী ॥ রকিবুল হাসান


গড়াই নদী। ছবি: উইকিপিডিয়া। গ্রাফিক্স: লংরিড

গড়াই নদী

আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
নদীস্তন পানে একদিন জেগে উঠত সবুজ ফসলের মাঠ
নদীমুখ মুগ্ধতায় ভেসে বেড়াত কাব্যভেলা গ্রাম-নগর
আমার স্বপ্নপাপড়ি পানসি নৌকার ঢেউখেলা নদীটি কোথায়
খোঁপাভাঙা রমণীর মতো ঢেউবতী পরমা নদীটি কোথায়

আমার নদীটি যেন যৌবনেই যৌবনহারা বুকপোড়া সরলারমণী
আমার নদীটি যেন দুগ্ধহীন শুকনো বুকের কঙ্কালসার জননী
আমার নদীটি যেন যৌবনবতী মায়ের যৌবনপোড়া দুঃখকথা
আমার দু’চোখ ভরে থাকা বর্ষাসুখের কেবলি মৃত্যু উৎসব
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

আমার উন্মত্ত মাতাল ঢেউখেলা নদীটি কোথায়
ভরাট লোমশ বুকে দাপিয়ে বেড়ানো বাঘা যতীনের
নদীটি কোথায়
শরৎশশীর জীবনআঁচলে বাঁধা শিশুর সাথে খরস্রোতা প্রবল যুদ্ধ
‘তোমাকে ব্রিটিশ তাড়াতে হবে-যুদ্ধ করো যুদ্ধ শেখো’
ব্রিটিশ তাড়ানো যুদ্ধযৌবন তৈরির সাহসিকা নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

ঋষিকবি রবি ঠাকুরের মুগ্ধবতী বিচিত্ররূপী গড়াই নদীটি কোথায়
‘ছিন্নপত্রে’ পাতায় পাতায় ছড়ানো মুক্তোজ্জ্বল গড়াই নদীটি কোথায়
যে নদীর বুকে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’
যে নদীর বুকে ‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা’ ঘরের কোণে মুক্তি
সেই নদীটি কোথায়- ইটপাথরের সড়ক কেন নদীর বুকে
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

গড়াই নদীতে ভেসেই লালন হয়েছে ছেঁউড়িয়ার-
মানবতা ধর্মবার্তা যেন তিনি দিলেন ছড়িয়ে নদীর
ঢেউয়ে ঢেউয়ে
গাঁয়ের পর গাঁ-দেশ-বিদেশ দূরের সীমানা-সময় গেলে
সাধন হবে না…
পড়শীর কাছে নদীর স্রোতে সাধনকথা
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

লাহিনীর জানালায় নিস্তব্ধতা ভাঙা নদীটি যেন পাড়ার চ লা
চোখে চোখে লেগে থাকা কিশোরিকা-মীরের বুকে কাব্যিকাপ্রণয়
গৌরী গভীরতা ছেনে যেন আঁকলেন রূপের ভয়ংকরতা-
‘বিষাদ-সিন্ধু’ আজো কথা কয় বেদনা সংগীতে
মীর সাহেবের জানালার সাথে লেগে থাকা নদীটি কোথায়
এ কেমন আগুনে বুক পোড়ে সুদর্শনা বালিকার…
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

প্রখর স্পর্ধায় যেন অগ্নিফণা হয়ে উঠত কাঙালের সংবাদ
কেঁপে উঠত জমিদারের ভেতর-বাহির
নদী ছাড়া আর কে পারে এমন করে রক্ত-আগুন জ্বালাতে
সেই স্পর্ধার শাণিত স্রোতে দুর্বার আঘাতে ফুঁসে ওঠা
নদীটি কোথায়
দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল ভয়ার্ত ফণাধারী সেই নদীটি কোথায়
কার অভিশাপে পোড়ে চেতনাশাণিত নদীতিকা বুক
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

অগ্নিফণা তোলা বিষধর গোখরার মতো মরণকামড় কৌশল
কী অদ্ভুতভাবে শিখিয়েছিল একদিন যৌবনা শরীরের মতো নদীটি
নদীর গভীরে নদী থাকে-জীবনের গভীরে জীবন-
ঘরের ভেতরে ঘর
জারজ বলে যাকে দিচ্ছ ছুড়ে সে তোমারই সন্তান-উত্তরাধিকার
সাহসিক উচ্চারণে বানালেন ‘অবাঞ্ছিত’
নদীতীরের আকবর হোসেন
যৌবনবতী নদীটি ছাড়া আর কে পারে জ্বালাতে এমন বারুদ
আমার সেই সাহসিকা যৌবনা জননী কোথায়
আমার সেই যৌবনবতী নদীটি কোথায়…

প্রহসনের খেলায় নবাবের নির্মম পরাজয় ও মৃত্যু এখনো নদীর
গভীরে গভীর বেদনাস্রোত-বুকের পাঁজরে কেঁপে ওঠে রক্তকান্না
গড়াইয়ের তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো তেবাড়িয়ার মৈত্রীয়র
রক্তস্নাত ‘সিরাজউদদৌলা’-গৌরীজল যেন
হয়ে ওঠে সিরাজি রক্ত
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কত সোনার ছেলে এ নদীতে
ভেসে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
পবিত্র রক্তস্রোতধারা জননী নদীটি কোথায়
আমার প্রিয়তমা পরমা নদীটি কোথায়
কোন রাক্ষসী গিলে খায় আমার স্বপ্ন মৌতাত বর্ষাযৌবন
সবুজ জমিন
মিথ্যে প্রেমের মধুকথায় কী অদ্ভুতভাবে দখল করে নেয়
আমার যৌবনবতী মায়ের দুগ্ধভরাট বুক
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়

শিলাইদহ কুঠিবাড়ির চিঠি হাতে নদীতীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে
স্রোতের মতো হেঁটে যায় আপন মনে বাঁধা
‘আমার মনের মানুষ যে রে’ মায়াবী কণ্ঠে গগন হরকরা
আমার এমন মধুর কণ্ঠভরা জননী নদীটি কোথায়

আমার দলিলে কেবলি একটি রহস্যস্বাক্ষর জেগে থাকে-
আমার গড়াই নদীটি আবার যৌবনবতী হয়ে উঠবে…